শেখ মুজিবুর রহমান – আহমদ ছফা
কথা উঠেছে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে। এক দল বলছেন,শেখ মুজিব সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম বাঙালি, অন্তত বাংলার শ্রেষ্ঠতম সন্তানদের একজন। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘জাতির পিতা’ এবং বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রামের অবিসংবাদিত মহানায়ক। তাঁরই সংগ্রামের উত্তাপ উপমহাদেশের এই প্রত্যন্ত অঞ্চলটিতে হাজার হাজার বছরের পরবশ্যতার সমূহ গ্লানি মুছিয়ে দিয়ে একটি নবীন রাষ্ট্র সম্ভাবিত করেছে।
অন্যরা বলছেন না। শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার জাতীয় ইতিহাসের একজন মস্তবড় ‘ভিলেন’ বা ‘খলনায়ক’। তিনি বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। মুক্তি এবং স্বাধীনতার নামে তিনি বাংলার জনগণকে তাড়িত করে হতাশা এবং অন্ধকারের গোলকধাঁধার মধ্যে ছুঁড়ে দিয়েছেন।
নায়ক পুরুষ, বীর এবং ভিলেন এই দুটি প্রবল মত অদ্যাবধি শেখ মুজিবের নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জোরের সঙ্গে উচ্চারিত হয়ে সর্বত্র ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। প্রকৃতপ্রস্তাবে শেখ মুজিবুর রহমান কী ছিলেন? বাঙালি জাতির মুক্তিদাতা বীর? না কি মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে প্রতারণাকারী বাগাড়ম্বর সর্বস্ব ক্ষমতাদর্পী একজন মানুষ? বাংলার ইতিহাসে শেখ মুজিব কোন ভূমিকাটি পালন করে গেছেন?
শেখ মুজিবুর রহমান কী ছিলেন? বাঙালি জাতির মুক্তিদাতা বীর? না কি মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে প্রতারণাকারী বাগাড়ম্বর সর্বস্ব ক্ষমতাদর্পী একজন মানুষ? না কি, শেখ মুজিব ইতিহাসের সেসব ঘৃণিত ভিলেনদের একজন, যারা জনগণকে মুক্তি এবং স্বাধীনতার নামে জাগায় বটে, কিন্তু সামনে যাওয়ার নাম করে পেছনের দিকে চালনা করে।
আচ্ছা, শেখ মুজিব কি বাঙালি জাতি, বাংলারে জনগণের কাছে একজন মহান শহিদ? যিনি সপরিবারে ঘৃণ্য গুপ্তঘাতকের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন বটে, কিন্তু বাংলার ইতিহাস পরম আদরে এই মহান সন্তানের রুধির-রঞ্জিত স্মৃতি লাল নিশানের মতো ঊর্ধ্বে তুলে নিরবধিকাল এই জাতির সামনে চলার প্রেরণার উৎসস্থল হয়ে বিরাজ করবে? জাতির সংকট মুহূর্তে বিমূর্ততার অন্তরাল ভেদ করে তেজীয়ান প্রাণবান মুজিব আবির্ভূত হয়ে করাঙ্গুলি প্রসারিত করে সংকট ত্রাণের পথ নির্দেশ করবেন?
না কি, শেখ মুজিব ইতিহাসের সেসব ঘৃণিত ভিলেনদের একজন, যারা জনগণকে মুক্তি এবং স্বাধীনতার নামে জাগায় বটে, কিন্তু সামনে যাওয়ার নাম করে পেছনের দিকে চালনা করে। একটা সময় পর্যন্ত জনগণ ভিলেনদের কথা শোনে, তাদের নির্দেশ শিরোধার্য করে মেনে নেয়। কিন্তু যখন তারা বুঝতে পারে শয়তানের প্রলোভনে মুগ্ধ হয়ে ফুল-ফসলে ঘেরা সবুজ উপকূলের আশায় পা বাড়িয়ে ভ্রান্ত স্বপ্নের ছলনায় ভ্রান্ত গন্তব্যে এসে উপনীত হয়েছে; তাদের আশা করার , বাসা করার, ভরসা করার কিছুই নেই, আছে শুধু পথ চলার ক্লান্তি, অনিশ্চয়তার হতাশা এবং প্রখর মরুভূমিতে মরীচিকার নিত্যনতুন ছলনা। তখন তারা তাদের ভাগ্যকে ধিক্কার দেয়, অভিশম্পাতের বাণী উচ্চারণ করে বহুরূপী সঙ নেতার নামে, যার ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠা এবং উচ্চকাংখার পতাকাকে নিরীহ শান্তিপ্রিয় খেটে খাওয়া জনগণ তাদের মুক্তি সনদ বলে ভুল করেছিল। শেখ মুজিবও কি একজন তেমন মানুষ? লক্ষ প্রদীপ জ্বালা স্তুতি নিনাদিত উৎসব মঞ্চের বেদীতলে সপরিবারে যাঁর মৃতদেহ ঢাকা পড়ে রইলে রাজপথে শোকের মাতম উঠল না, ক্রন্দন ধ্বনি আকাশে গিয়ে বিঁধল না, কোথাও বিদ্রোহ-বিক্ষোভের ঢেউ জলস্তম্ভের মতো ফুলে ফুলে জেগে উঠল না। এ কেমন মৃত্যু, এ কেমন পরিণতি শেখ মুজিবের সুদীর্ঘ কর্মময় জীবনের! সব চুপচাপ নিস্তব্ধ! তাহলে কি ধরে নিতে হবে বাংলাদেশের মানুষ যারা তাঁর কথায় হাত ওঠাত, দর্শন মাত্রই জয়ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত করত, তাঁর এমন করুণ এমন ভয়ঙ্কর মৃত্যু দেখেও, ‘বাঁচা গেল’ বলে স্বস্তির নিশ্বাস ত্যাগ করেছে। ইতিহাসের অন্যান্য প্রতারক ভিলেনদের ভাগ্যে সচরাচর যা ঘটে থাকে, শেখ মুজিবের ভাগ্যেও তাই কি ঘটেছে?
একটি সদুত্তর প্রয়োজন। কী ছিলেন মুজিব? বীর? প্রতারক? অনমনীয় একগুঁয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, চরম ক্ষমতালোভী একজন একনায়ক? একটা জবাব টেনে বের করে আনতে না পারলে বাংলার ভাবী ইতিহাসের পরিরেখাটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে না। বারংবার শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ভূমিকাটি অনির্ণীত থেকে যাচ্ছে বলেই বাংলার, বাঙালি জাতির, ইতিহাসের পরিক্রমণ পথটি ক্রমাগত ঝাপসা, অস্পষ্ট এবং কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে উঠছে। এই ঐতিহাসিক অলাতচক্র যার মধ্যে দিনের আলোতে সবাই পথ হারায়, রাতে রাতকানা হয়ে থাকে। তবে ভেতর থেকে কেটে চিরে সামনে চলার পাথেয় স্বরূপ একটা অবলম্বন অবশ্যই খাড়া করতে হবে।
শুধু শেখ মুজিব নয়, উনিশশো একাত্তর সালে যে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়ে গেছে এবং যার গর্ভ থেকে বর্তমানের স্বাধীন বাংলাদেশে ভূমিষ্ঠ হয়েছে, তার চরিত্রটিও নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং শেখ মুজিবুর রহমান এ দুটো যমজ শব্দ, একটা আরেকটার পরিপূরক এবং দুটো মিলে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের উজ্জ্বল -প্রোজ্জ্বল এক অচিন্ত্যপূর্ব কালান্তরের সূচনা করেছে। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে দুর্বার গণআন্দোলনটি সৃজিত হয়েছিল তার লক্ষ্যের অস্পষ্টতা, সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি, এ সমস্ত বিষয়ে কারও দ্বিমত থাকার নয়। তদুপরি স্বায়ওশাসনের আন্দোলন রাতারাতি স্বাধীনতার সংগ্রামে রূপলাভ ক’রে এশিয়ার একটি সেরা দুর্ধর্ষ বাহিনীর বিপক্ষে বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণকে বলির পাঁঠার মতো দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। শেখ মুজিব এবং তাঁর দল আওয়ামি লিগ কারোরই এই প্রচণ্ড-পরিস্থিতির মোকাবেলা করার ক্ষমতা ছিল না। ফল যা হবার হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিরোধ যুদ্ধ এবং মুক্তিসংগ্রাম পায়ে হেঁটে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় যাঞ্চা করতে গেল আর তেজোদ্দীপ্ত মুজিব পাকিস্তানের কারাগারে চলে গেলেন। এ হল নিরেট সত্য কথা। যদি আর কিন্তু দিয়ে ইতিহাস রচিত হয় না। যা ঘটেছে তাই-ই ইতিহাস।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের জড়িয়ে পড়া, সোভিয়েত রাশিয়ার সক্রিয় অংশগ্রহণ, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং যুদ্ধে পাকিস্তানের চূড়ান্ত পরাজয়ের কারণে বর্তমান বাংলাদেশের অভ্যুদয় — এসকল সত্য যদি সবাই অম্লান বদনে বিনা দ্বিধায় মেনে নিতে পারে, তাহলে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এ পর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমানের যে একটি ভূমিকা ছিল সেটুকু মেনে নিতে বাধাটা কোথায়? বাংলাদেশের জন্মপ্রক্রিয়ায় ভারত তার স্বার্থ ছিল বলেই ধাত্রীর কাজ করেছে, একথা মিথ্যে নয়। কিন্তু পৃথিবীর কোন দেশটি ইতিহাসের কোন পর্যায়ে এক ধরনের না এক ধরনের স্বার্থ ছাড়া অন্য দেশের প্রতি সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করেছে? ভারত পাকিস্তানকে ভাঙার জন্য আওয়ামি লিগকে সব রকমের সাহায্য সহযোগিতা দিয়েছে এবং রাশিয়া তার দুনিয়া জোড়া সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব অটুট রাখার জন্য পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ তো স্বাধীনতা চেয়েছিল এবং স্বাধীনতা অর্জন করার জন্য সকল শ্রেণীর জনগণ মরণপণ করে স্বাধীনতা সংগ্রাম ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। উনিশশো একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে বাংলাদেশের নানা শ্রেণীর মানুষ নানান দৃষ্টিকোণ থেকে যেভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে, ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করেছে, বাংলার ইতিহাসের কোনও পর্যায়ে এমন সর্বাত্মক সার্বজনীন জাতীয় যুদ্ধ এবং গণযুদ্ধের সন্ধান কেউ দিতে পারবেন কি?
মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে-বাংলাদেশ জন্মগ্রহণ করেছে তাকে মেনে নিতে কারও আপত্তি নেই। এমনকি যে সকল শ্রেণী,গোষ্ঠী ও স্বার্থবাদীচক্র বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে, তাদের বাংলাদেশের বাস্তবতা মেনে নিতে বাধছে না। কিন্তু মুজিবের অস্তিবাচক ভূমিকাটুকু মেনে নিতে তাতের ঘোর আপত্তি। এ এক মর্বিড মানসিকতা। বাংলাদেশের ঐতিহাসিক অভিযাত্রার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক না থাকার যে লজ্জা, যে গ্লানি, সেটুকু রাখার অপকৌশল হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে তারা অক্ষম।
অবশ্য কথা উঠতে পারে, উঠতে পারে কেন অবশ্যই উঠবে–বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশের অগ্রযাত্রায় এক পর্যায় সরাসরি বিরোধিতা করেছিলেন শেখ মুজিব। যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশে একটি মধ্যশ্রেণী গড়ে না উঠেছে ততদিন শেখ মুজিব পশ্চিমা পাকিস্তানি ধনিকদের লেজুড়বৃত্তি করেছেন, বাঙালি স্বার্থের বিরোধিতা করতেও কুণ্ঠিত হননি। অনেককাল পর্যন্ত ধনিকদের মতাদর্শই তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল। তাঁর মতো ইঙ্গ-মার্কিন শক্তির এমন একনিষ্ঠ সেবক তৎকালীন পূর্বপাস্তিানে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যেত কি না সন্দেহ আছে। তিনি তখনই বাঙালি জাতিয়বাদের প্রশ্নটি নিয়ে মাঠে নেমেছেন যখন এদেশে একটি মধ্যশ্রেণী সৃষ্টি হয়ে গেছে। পশ্চিমাদের দ্বারা ক্রমাগত নিগৃহীত হয়ে এই শ্রেণীটি যখন সোচ্চার হতে শিখেছে, সেই সময়েই শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর দল আওয়ামি লিগকে মধ্যশ্রেণীর প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন হিসেবে দাঁড় করান। সুতরাং শেখ মুজিবের বাঙালি জাতীয়তাবাদ জাতীয় মধ্যশ্রেণীর জাতীয়তাবাদ। যেটি সমাজের শোষিত শ্রেণী নয়। ক্ষুদে শোষক শ্রেণী, বড় শোষক সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সংযোগ তার প্রত্যক্ষ নয়। পাকিস্তানি শোষকদের মাধ্যমেই তার লেনদেন চলছিল। অর্থনৈতিক এবং শ্রেণী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলতেই হবে সাম্রাজ্যবাদী শোষকদের সঙ্গে একটা প্রত্যক্ষ সংযোগ স্থাপন করাই ছিল বাঙালি মধ্যশ্যেণীর মূল অভীষ্ট।
শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের মাধ্যশ্রেণীর দাবিদাওয়ার মোড়ক, যা চিহ্নিত হয়েছিল ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ নামে, তাই নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন এবং অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে গোটা বাংলাদেশের জনমত তাঁর সপক্ষে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। এটা একমাত্র বক্তব্য নয় — বারো হাত কাঁকুড়ের তের হাত বীচির মতো, তার পেছনে আরও বক্তব্য রয়েছে। গোড়া থেকেই আওয়ামি লিগের রাজনীতি মূলত পুঁজিবাদী রাজনীতি এবং স্পষ্ট ও প্রকাশ্যভাবে সমাজতন্ত্রের বিরোধিতা করাই ছিল আওয়ামি লিগ দলটির অন্যতম বৈশিষ্টসমূহের একটি।
যেসকল বামপন্থি সংগঠন পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের কথা বলত, দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা উচ্চারণ করত, আওয়ামী লিগ বারবার তাদের বিরোধিতা করেই এসেছে। পাকিস্তানের ইঙ্গমর্কিন সামরিক জোটে অংশগ্রহণের প্রশ্নে সুহরাওয়ার্দি এবং মওলানা ভাসানিকে কেন্দ্র করে সেই যে আওয়ামি লিগ, আওয়মি লিগ এবং ন্যাশনাল আওয়ামি পার্টি নাম নিয়ে দ্বিখণ্ডিত হল, তারপর থেকে বলতে গেলে উনশশো আটষট্টি উনসত্তর সাল পর্যন্তও আওয়ামি লিগ সমাজতন্ত্রের বিরোধিতা করে এসেছে। এমনকি ছয়দফা যখন বাংলাদেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে তখনও আওয়ামি লিগ সমাজতন্ত্রের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করছে।
তৎকালীন পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে যেসকল বামপন্থী রাজনৈতিক দল প্রথমেই আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন তাঁদের চূড়ান্ত ব্যর্থতা শেখ মুজিবুর রহমানের অভূতপূর্ব সাফল্যের অন্যতম কারণ বললে খুব বেশি বলা হবে না। তাঁরা জাতিসত্তার মুক্তির প্রশ্নটি উচ্চারণ করেছিলেন বটে, কিন্তু জাতি যখন ভেতর থেকে জাগ্রত হয়ে দাবি আদায়ের পথে প্রচণ্ড বেগে অগ্রসর হচ্ছিল, তাঁরা কোনও হাল ধরতে পারেননি। এই পরিস্থিতির সুযোগ পুরোপুরি গ্রহণ করেছেন শেখ মুজিব এবং তাঁর দল আওয়ামি লিগ। এটা কেন ঘটল, কেমন করে ঘটল, অনেকে অনেক কথা বলবেন। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের দ্বিধাবিভক্তই,বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে তাঁর প্রতিক্রিয়া –এক অংশের মস্কোর প্রতি অনবচ্ছিন্ন আনুগত্য এবং অন্য অংশের পিকিংয়ের নির্লজ্জ লেজুড়বৃত্তি-এসব বিষয় অবশ্যই ধর্তব্যের মধ্যে আসবে। তাছাড়া পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ, সেই যুদ্ধে মস্কোর মধ্যস্থতা এবং তার মাধ্যমে ভারত-পাকিস্তান মিলিয়ে এশিয়ায় চীন-বিরোধী একটা ব্লক তৈরি করার সোভিয়েত অভিপ্রায় এবং অন্যদিকে যুদ্ধে সরাসরি চীনের পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন, চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক, মওলানা ভাসানি এবং চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির আইয়ুব খানের প্রতি দুর্বলতা, তাছাড়া পশ্চিম বাংলার নকশাল নেতা চারু মজুমদারের সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির মড়কের মতো প্রভাব, বামপন্থী দলগুলোকে জাতিসত্তার মুক্তির দাবি থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়েছিল। সত্য বটে উনিশশো সত্তরের নির্বাচনের প্রাক্কালে ন্যাপ এবং কমিউনিস্ট পার্টির মস্কো সমর্থক অংশ জাতিসত্তার মুক্তির দাবিতে আওয়ামি লিগের সঙ্গে একমত পোষণ করে মাঠে নেমেছিলেন, কিন্তু , তখন অনেক বিলম্ব ঘটে গেছে। নির্বাচনের সময় থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় পর্যন্ত এমন কি তার পরেও শেখ মুজিবুর রহমান যতদিন জীবিত ছিলেন, আওয়ামি লিগের তল্পিবহন করে মস্কোর নামে জয়ধ্বনি উচ্চরণ করা ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে সত্যিকার অর্থে পালনীয় কোনও ভূমিকা তাদের ছিল না। বড় তরফের কাছে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য অম্লান বদনে আত্মসমর্পণ –একে যথার্থ যুক্তফ্রন্ট বলা যাবে কি না তা সত্যি সত্যি বিতর্কের বিষয়।র
সে যাই হোক, বামপন্থী রাজনীতির অন্যান্য অংশসমূহ সেই যে জাতীয় রাজনীতির প্রধান স্রোতধারা থেকে, মূল শিকড় থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছিল, সেই খাতে অদ্যাবধি আর ফিরে আসতে পারেননি। শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জাতীয় মধ্যশ্রেণীর রাজনৈতিক প্রতিনিধি। তিনি তাঁর দৃষ্টিকোণ থেকে, তাঁর নিজস্ব শ্রেণীটির স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে মুক্তিসংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন। এই জাতীয় মাধ্যশ্রেণীটি দুধের সরের মতো সবেমাত্র ভাসতে সুরু করেছে। আপন মেরুদণ্ডের ওপর থিতু হয়ে দাঁড়াবার ক্ষমতা তার নেই। মধ্যশ্রেণীর দাবির সঙ্গে জাতীয় মুক্তির প্রশ্নে বাংলাদেশের শোষিত মানুষের দাবি সমসূত্রে এসে মেশার ফলে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন নতুন বেগ এবং আবেগ সঞ্চয় করে রাতারাতি জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের রূপ পরিগ্রহ করে। বাংলাদেশের সকল শ্রেণীর মানুষ অগ্নিতে পতঙ্গের মতো এই মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ব্যাপ্তি এবং গভীরতার দিক দিয়ে বিচার করলে উনিশশো একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামের মতো ঘটনা বাংলার আবহমান ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি নেই ।
শেখ মুজিবুর রহমান মধ্যশ্রেণীভুক্ত মানুষ-মধ্যশ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করাই হল তাঁর আনুপূর্বিক রাজনৈতিক জীবনের সারকথা। এই মুক্তিসংগ্রামের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে, জাতীয় আকাংখার নিরিখে যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা বা শিক্ষা কোনটাই তাঁর ছিল না। ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের মাটি থেকে নির্বাসিত হয়ে ভারতে আশ্রয় ভিক্ষা করতে গেল।
এ তো হল চিত্রের এক দিক। অপর দিকে দৃষ্টিপাত করলে কী দেখতে পাই? শেখ মুজিবের সুবিধাবাদী দোদুল্যমান নেতৃত্ব নেগেট করতে পারার মতো বিকল্প নেতৃত্বের অস্তিত্বে সেদিন বাংলাদেশে কোথায়? শেখ মুজিবুর রহমানের দোদুল্যমান নেতৃত্ব এবং সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যে ভারতের যুদ্ধে পরিণত হল, এর জন্য অনেকে শেখ মুজিকে দায়ী করেন এবং তাঁকে জাতীয় বেঈমান ইত্যাদিও আখ্যা দিয়ে থাকেন। কিন্তু একটার পর একটা ভুলের মাধ্যমে আওয়ামি লিগের বিকল্প নেতৃত্ব নির্মাণের সুযোগ হেলায় অপব্যয় করে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে সাক্ষীগোপালের ভূমিকা পালন করেছেন কিংবা স্থলবিশেষে জাতির শক্রদের সাথে হাত মিলিয়েছেন, তাঁরাই বা জাতির প্রতি এমন কি বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়েছেন? শেখ মুজিব কী ভূমিকা পালন করেছে, অন্য দশটা রাজনৈতিক দল এবং নেতা কী ভূমিকা পালন করেছেন সেই মানদণ্ডেই তা নির্ণয় করতে হবে। সেদিন যদি শেখ মুজিব তাঁর শ্রেণীগত ভূমিকাটি পালন না করতেন তাহলে কি খুব ভালো করতেন?
একটি প্রশ্ন অবশ্যই জিজ্ঞাস্য। শেখ মুজিব সময়ের সন্তান, না সময়ের পিতা? সেই সময়ের বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক বাস্তবতা বিরাজ করছিল তাতে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা প্রয়োগ করে তিনি তার কতদূর গুণগত পরিবর্তন সাধন করতে পেরেছিলেন? না কি সময়ের স্রোতে বাহিত হয়ে কেবলমাত্র তাঁর ভাবমূর্তিটাই উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর রূপে ক্রমাগত অভ্রভেদী হয়ে উঠেছিল। এ প্রশ্নে আমাদের স্পষ্ট উত্তর, শেখ মুজিব সময়ের সন্তান, সময়ের পিতা নন। সেসময়ে বাংলাদেশের সামন্তবাদী মুসলিম লিগ রাজনীতির ক্ষীণতম প্রভাবটুকু আর অবশিষ্ট নেই। বামপন্থী রাজনীতি দিশেহারা, বিপথগামী, শতধা বিচ্ছিন্ন এবং পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত। মাঠে শেখ মুজিব ছাড়া আর কেউ নেই। আর জাতির অন্তরের মুক্তিপিপাসা সমুদ্রের কটাল জোয়ারের তরঙ্গের মতো ফেটে ফেটে পড়ছে। শেখ মুজিবুর রহমান সেইসময় জাতিকে অঙ্গুলি হেলনে ডাইনে বাঁয়ে সামনে পেছনে যেদিকে ইচ্ছা পরিচালিত করতে পারতেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভয়াবহ প্লাবনে গোটা দেশ ভেসে যাচ্ছে।
কিন্তু এ কোন বাঙালি জাতীয়তাবাদ? মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্বের ভিত পচে গলে একাকার, ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার শেষ শেকড়টাও উপড়ে ফেলে দশ কোটি মানুষের সামনে যে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা মূর্তিমান হয়ে দেখা দিয়েছে তাকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বললে ভুল করা হয়না। কিন্তু একটি লাগসই ব্যাখ্যা প্রয়োজন। উনিশশো সাতচল্লিশ সালে হিন্দু জাতীয়তা এবং মুসলিম জাতীয়তার ভিত্তিতে বিভক্ত হয়ে ভারত এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিল। যদিও ভারতীয় রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা স্বীকার করেননি যে হিন্দু জাতীয়তাই হল ভারত রাষ্ট্রের ভিত্তি। মুসলিম জাতীয়তার ভিত ভেঙে বাংলাদেশে যখন নতুনতর জাতীয় সংগ্রাম দাবানলের মতো জ্বলে উঠতে শুরু করেছে তখন ভারতের ক্ষমতাসীন শাসক কংগ্রসের তাত্ত্বিকের বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভুল সংশোধন হিসাবে ব্যাখ্যা করতে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। তাঁদের মতামত আওয়ামি লিগের চিন্তাধারাকে যে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। জাতীয় সংগ্রাম যখন তুঙ্গে সেইসময় মুজিবের ভক্তরা তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ আখ্যা দিচ্ছেন, নতুন ধরনের মুজিব কোট, মুজিব টুপি চালু করছেন। বঙ্গবন্ধু শব্দটির সঙ্গে দেশবন্ধুর একটি সাদৃশ্য অতি সহজে চোখে পড়ে। মুজিব কোটের সঙ্গে জওহরলাল নেহরু ব্যবহৃত জ্যাকেট এবং মুজিব টুপির সঙ্গে সুভাষবসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের টুপির ঈষৎ পরিবর্তিত মিল দেখলে অতি সহজেই বোধগম্য হয় যে-সকল প্রতীক ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে ভারতীয় কংগ্রেস অনুসৃত ভারতীয় জাতীয়তার স্মারক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলোই সামান্য পরিবর্তিত চেহারায় বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে নতুনভাবে জেগে উঠতে শুরু করেছে। এমন কি শেখ মুজিবুর রহমানের অহিংস অসহযোগ আন্দোলনটির কথাও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলাদেশে আবার মহাত্মা গান্ধীর আদর্শের নব-উত্থান লক্ষ করে অনেক ভারতীয়ই উল্লসিত হয়ে উঠেছিলেন, এ কারণে যে কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন অনতিবিলম্বে তা পূর্ণ হতে যাচ্ছে। পাকিস্তান ভেঙ্গে পড়ছে এবং খণ্ডিত ভারত আবার জোড়া লেগে অখণ্ড রূপে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। উনিশশো একাত্তর সালের বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্বের রূপটি দর্শন করে ভারতের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর এ মনোভাব জাগ্রত হওয়া একটুও অস্বাভাবিক নয় যে বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাঠামো থেকে বেরিয়ে এসে ভারতের সঙ্গে মিলেমিশে না যাক, অন্তত ভারতের কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছে। সে কারণে অনেকেই শেখ মুজিবুর রহমানকে মহাত্মা গান্ধীর মানসপুত্র বলে অভিহিত করতে কুণ্ঠিত হননি।
অথচ বাংলাদেশে উনিশশো বাহান্ন সালে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে উনিশশো আটষট্টি-উনসত্তরের স্বাধিকার আন্দোলন এবং উনিশশো একাত্তরের মুক্তিসংগ্রাম পর্যন্ত সংগ্রামের ধারাটি এবং ভারতের অবহেলিত রাজ্যগুলোতে তার যে প্রভাব পড়েছে, বিশ্লেষণ করে দেখলে ভারতের শোষিত অঞ্চল এবং জনগোষ্ঠীর শোষণমুক্তির সংগ্রামের সঙ্গে একটা সাযুজ্য, একটা মিল, একটি প্রবহমানতা অনায়াসে আবিষ্কার করা যায়। উদাহরণ স্বরূপ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলনের কথা ধরা যেতে পারে। এ আন্দোলনের অব্যবহিত পরেই হিন্দি ভাষার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তামিল ভাষাভাষী অঞ্চলে এবং সংস্কৃতির অবাধ বিকাশের দাবিতে আন্দোলন এবং বিক্ষোভ সংঘটিত হয়। পরবর্তীকালে অন্যান্য ভাষাভাষী অঞ্চলেও কমবেশি এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ভারতের রাজ্যসমূহের অনেকগুলোতে যে নতুন করে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে বিক্ষোভ, সংঘর্ষ এবং তুমুল গণসংগ্রাম ভারতীয় ইউনিয়নের ঐক্যের ভিতটিকে একরকম কাঁপিয়ে তুলেছে তার স্বরূপটি উপলব্ধি করলেই বাংলাদেশের জাতীয় সংগ্রামের চরিত্রটি অনায়াসে উদঘাটন করা সম্ভব হবে। আসলে ভারতবর্ষ হিন্দু-মুসলমান দু’জাতির দেশ নয়। ভারত বহু জাতি, বহু ভাষা, বহু সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের দেশ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিদায়কালে অবহেলিত অঞ্চল, জনগোষ্ঠী এবং সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যসমূহ ভারতীয় হিন্দু-মুসলমান বুর্জোয়া শ্রেণীর চাপে সোচ্চার এবং মারমুখী হয়ে উঠতে পারেনি। অবহেলিত অঞ্চল এবং জনগোষ্ঠীর মানুষেরা সংগঠিত হয়ে বুর্জোয়া নেতৃত্বের কোনও চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি এবং আপোষে হিন্দু এবং মুসলিম বুর্জোয়া শ্রেণী দেশবিভাগের ঐক্যমতে পৌছায়। মোটামুটি হিসেবে দশকোটি মুসলমান এবং ত্রিশকোটি হিন্দু ধরে নিয়ে ভারতবর্ষকে বিভক্ত করা হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির বেলায় দু’অঞ্চলের ভৌগোলিক দূরত্ব এবং সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে কোনও গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। শুধু মুসলমান পরিচয়টাকেই একমাত্র পরিচয় বলে ধরা হয়েছে। তেমনি হিন্দু পরিচয়ের ক্ষেত্রেও অনেকগুলো পর্বতপ্রমাণ বৈষম্যকে ধর্তব্যের বিষয় বলেই গণ্য করা হয়নি। হিন্দুদের মধ্যে বর্ণহিন্দু এবং হরিজন রয়েছে। তাদের মধ্যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক যে ব্যবধান, যে দূরত্ব যে বৈষম্য বিরাজমান তা হিন্দু-মুসলমানের দূরেত্বের চাইতে কম নয়। এ ছাড়াও রয়েছে আদিবাসী এবং শিখ। এক সম্প্রদায় কর্তৃক অন্য সম্প্রদায়ের এক অঞ্চল কর্তৃক অন্য অঞ্চলের শোষণ এবং এক জাতিগোষ্ঠী কর্তৃক অন্যান্য জাতিগোষ্ঠির নিপীড়ন সমানে চলে আসছে। সেদিক দিয়ে দেখতে গেরে ভারত বহু জাতি , বহু ভাষা এবং বহু সংস্কৃতির দেশ। এখানে সাবেক সোভিয়েত রাশিয়া কিংবা চীনের মতো একটা বিপ্লব ঘটে গেলে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে এই দ্বন্দ্বসমূহের হয়তো নির্বাসন করা সম্ভব হত। ভারতের হিন্দু-মুসলমান বুর্জোয়া তাদের শ্রেণীগত কারণে একটা বিপ্লবের পথরোধ করার উদ্দেশ্যেই ভারত বিভাগকে কবুল করে নিয়েছিল।
ঐতিহাসিকভাবে ভারত উপমহাদেশের সমস্ত অঞ্চল দীর্ঘকাল একসঙ্গে অবস্থান করার কারণে রাষ্ট্রীয় সীমানা আলাদা হওয়া সত্ত্বেও একের প্রভাব অন্যের উপর পড়তে বাধ্য। এখন আসা যাক বাংলাদেশের জাতীয় সংগ্রামের স্বরূপটি নিরূপণের প্রশ্নে। ভারত বহুভাষিক, বহুজাতিক দেশ। বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সেই সত্যকে আরও প্রোজ্জ্বল এবং আরও বাস্তবভাবে তুলে ধরেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে বাংলাদেশের সামনে কতিপয় সুযোগ ছিল। তাই প্রথম চোটেই সে মাথা তুলে দাঁড়াতে পেড়েছে। অপরপক্ষে ভারতের রাজ্যসমূহের সে সুযোগ ছিল না। ক্রমাগত যতই দিন এগিয়ে যাচ্ছে এই দ্বন্দ্বসমূহ একসার অগ্নিগিরির মতো একটা পর একটা জ্বলে উঠতে আরম্ভ করছে। ভারতীয় রাজনীতি কেন্দ্রমুখী এবং কেন্দ্রবিরোধী এই দুটি ধারা মূলত গোষ্ঠীবিশেষের শোষণ এবং তার বিরুদ্ধে শোষিত অঞ্চল এবং গণগোষ্ঠীসমূহের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ মিলেই গড়ে উঠেছে। শোষিত জাতিসত্তাসমূহের জাতীয়তার দাবি রাষ্ট্রের সহায়তা আরোপিত ভারতীয় জাতীয়তার জগদ্দল পাথরের তলায় চাপা পড়ে রয়েছে। অতি সাম্প্রতিককালে তা পাঞ্জাব, আসাম, কাশ্মীর, মিজেরাম এবং নাগাল্যান্ড ইত্যাদি অঞ্চলে প্রবল ঝঞ্ঝার বেগ নিয়ে জাগ্রত হয়ে উঠতে আরম্ভ করেছে।
বাংলাদেশের জাতীয়তার যে সংগ্রাম, শ্রেণী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যাবে ভারতে নির্যাতিত জাতিসমূহের সংগ্রামের সঙ্গে তার অনেক বেশি সাযুজ্য। তাই বাংলাদেশের জাতীয়তাকে কিছুতেই মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের ভুল সংশোধন বলা যাবে না। বরঞ্চ একথা বলাই যুক্তি সঙ্গত যে বাংলাদেশের জাতীয়তার সংগ্রাম ভারতবর্ষের বহুজাতীয়তার সংগ্রামের পূর্বাভাস মাত্র। বাঙালি জাতীয়তার এই দুটি পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যে শেখ মুজিব প্রথমটাকেই মেনে নিয়েছিলেন,অর্থাৎ তিনি এবং তাঁর দল রাজনীতির ভিত্তি স্বরূপ দ্বিজাতিতত্ত্বের ব্যর্থতাকেই আসল অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। অত্যাচার নির্যাতন এবং অবদমনের কংসকারায় ভারতীয় রাজ্যসমূহের জাতীয়তার যে নতুন অভিধা তৈরি হচ্ছিল, তার সবটুকু দৃষ্টিগোচর নয়। প্রবল প্রক্ষোভে কোথাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে, কোথাও একেবারে ভ্রণাবস্থায় সংগুপ্ত রয়েছে। বাংলাদেশ নিজের মুক্তির সংগ্রাম করতে গিয়ে এই জাতিসত্তাসমূহের সংগ্রামে নেতৃত্ব দান করেছেন — এই সত্য মুজিব কিংবা আওয়ামি লিগ কখনও উপলব্ধি করেননি। ব্রিটিশ বিরোধী টুটাফাটা ভারতীয় কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের উপজীব্য বলে ধরে নিয়েছিলেন তিনি। বাংলাদেশের মধ্যশ্রেণী যাদের অধিকাংশই শুরুতে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের পর্যন্ত বিরোধিতা করেছিল তারাই শেখ মুজিবের চারপাশের জুটে সমস্ত পরিবেশটাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।
শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতীয়তার আসল প্রেক্ষিতটাই নির্ণয় করেননি। গোটা জাতি যখন চূড়ান্ত সংগ্রাম কাঁধে নেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত তিনি জনগণকে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য তৈরি না করে তাদেরকে একটার পর একটা তামাশার মধ্যে ঠেলে দিয়ে অনাবশ্যক সময় হরণ করেছেন। আর ইত্যবসরে পাকিস্তানিরা জাহাজে প্লেন বোঝাই করে পশ্চিমাঞ্চল থেকে সৈন্য এবং মারণাস্ত্র এনে সেনা ছাউনিগুলি বোঝাই করে ফেলেছে। সেই সম্ভাবনাময় সময়ের কোনও সুযোগ তিনি গ্রহণ করতে পারেননি। কারণ তাঁর ভয় ছিল, করতে গেলে মধ্যশ্রেণীর নেতৃত্ব কাচের ঘরের মতো চুরমার হয়ে ভেঙে পড়বে। তথাপি জনমতের প্রবল ঝড়ের ঠেলায় তাঁকে স্বাধীনতার নামটি উচ্চারণ করতে হয়েছিল। ব্যাস ওইটুকুই। বস্তুত বাঙালি সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্য গীতাঞ্জলি নয়, সোনার তরী নয়, ‘আর দাবায়ে রাখাবার পারবা না’। সহস্রাধিক বছরের পরাধীন জীবনের অস্তিত্বের প্রতি সরাসরি অস্বীকৃতি জানিয়ে এই উচ্চারণের মাধ্যমে গোটা জাতির চিত্তলোকে তিনি এমন একটা অনমনীয় আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি করেছিলেন যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরাট এক প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। এই গৌরব শেখ মুজিবকে অবশ্যই দিতে হবে।
যা বলছিলাম, শেখ মুজিব সময়ের সন্তান, পিতা নন। ঘটনার গতি তাঁকে ঠেলে নিয়ে গিয়েছিল, তিনি ঘটনাস্রোত নিয়ন্ত্রণ করে একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যের পানে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। সময় শেখ মুজিবকে সৃষ্টি করেছে। অভিনব সম্ভাবনা সম্পন্ন সময়ের স্রষ্টা তিনি নন। তাঁর জাতীয়তার বোধ অতীতের, ভবিষ্যতের নয়। অতীতচারী জাতীয়তার মোহে আবিষ্ট শেখ মুজিব মধ্যযুগীয় নাইটের মতো বীরত্ব সহকারে পাকিস্তানের কারাগারে চলে গেলেন। প্রতিরোধ সংগ্রামে লণ্ড ভণ্ড ছত্রখা হয়ে পড়ল। আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নিল। ভারত সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর থেকে মুক্তিযুদ্ধের চরিত্র সম্পূর্ণ পালটে যায়। শেখ মুজিবুর রহমানের দোদুল্যমান এই নেতৃত্ব জাতিকে সংগ্রাম করে স্বাধীনতা অর্জনের পুরোপুরি গৌরব থেকে চিরকালের জন্য বঞ্চিত করছে এবং ভারতের সহায়তায় স্বাধীনতা অর্জনের মাশুল অনেকদিন পর্যন্ত শোধ করতে হল বাংলাদেশকে।
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম যে ভারতের নিজস্ব যুদ্ধে পরিণত হল তার পেছনে যে কারণটি সক্রিয় তা হল শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন মধ্যশ্রেণীভুক্ত আওয়ামি লিগের শ্রেণীচরিত্র। বঙ্গোপসাগরের সুনীল জলধিতল মন্থিত করে নতুন ভূখণ্ড জেগে ওঠার মতো প্রতিরোধের প্রবল আকাংখা নিয়ে বাংলাদেশের নিচের দিকের সামাজিক স্তরসমূহ ঠেলে উপরদিকে উঠে এসেছে। এই জাগরিত জনসংখ্যা এই নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা দর্শন করে শেখ মুজিব আশান্বিত হওয়ার চেয়ে অধিক আতঙ্কিতই হয়েছিলেন। কারণ শেখ মুজিব তাঁর শ্রেণীর দম কতদূর, লক্ষ কোথায়, এদের নিয়ে কতখানি যেতে পারবে,ন জানতেন। এই সংকটপূর্ণ সময়ে একচুল এদিক ওদিক হলে কাচের তৈজসপত্রের মতো নেতৃত্ব যে খানখান হয়ে ভেঙে পড়বে তিনি সে বিষয় বিলক্ষণ অবগত ছিলেন। নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা অর্থাৎ যুদ্ধ করবার সংকল্প নিয়ে জেগে ওঠা জাতিকে যুদ্ধ করার প্রস্তুতির দিকে চালিত না করে, তিনি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা পথ বেছে নিলেন। আলোচনার ছল করে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান থেকে নৌপথে, আকাশপথে সৈন্য এনে ব্যারাক ভর্তি করে চরম মুহূর্তটির অপেক্ষা করছেন। পঁচিশে মার্চে রাত্রে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিস্তব্ধ নগরীর নিরস্ত্র জনগণের উপর যখন ঝাঁপিয়ে পড়ল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খাওয়া ছাড়া আর উপায় ছিল কী? তথাপি বাংলাদেশের জনগণের প্রতিরোধ সংগ্রাম নির্মূল করা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষে সম্ভব হয়নি। জনগণ, হাতের কাছে যা পেয়েছে, তাই দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছে। কামান, বন্দুক, স্যাভার জেটের সামনে বলতে গেলে খালি হাতে কতদূর! খুনি, জল্লাদ ইয়াহিয়া বাহিনীর হাতে মারের পর মার খেয়ে উলঙ্গ অসহায় অবস্থায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভারতের মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল।
শেখ মুজিব কিংবা আওয়ামি লিগের যুদ্ধ করার কোনও পূর্ব-পরিকল্পনা থাকলে,ভারত থেকে আগেভাগে প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র আনিয়ে রাখতেন। বাংলাদেশের একটা অঞ্চল যদি মুক্তিসেনাদের দখলে থাকত এবং সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধ চালানো হত, আমাদের মুক্তিসংগ্রামের চরিত্রটি সম্পূর্ণ পালটে যেতে পারত। আমাদের মুক্তিসেনাদের সাহসের অভাব ছিল না, আত্মত্যাগের বেলায় তারা পরন্মুখ হননি। কিন্তু অভাব ছিল অস্ত্রের। একমাত্র উন্নত অস্ত্রশস্ত্রের মোকাবিলায় টিকতে না পেরে আমাদের প্রতিরোধ সংগ্রাম বারবার পিছু হটে শেষ যাত্রার ভারতে পলায়ন করতে বাধ্য হয়েছে। ভারতে আশ্রয় নেওয়ার কারণে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সম্বন্ধে পাকিস্তানিদের ভ্রান্ত প্রচারণা আন্তর্জাতিক মহলে অনেক সংশয় সৃষ্টি করেছে। বলতে হবে শেখ মুজিব এবং আওয়ামি লিগ নেতৃত্ব ইচ্ছে করে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলেন অথবা একটি সশস্ত্র জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কোনও পরিপূর্ণ ধারণাই তাঁদের ছিল না। আশা করি সকলে একমত হবেন বিমান এবং ট্যাংক ধ্বংসী কিছু অস্ত্রসহ শুরুতে অন্তত দু’তিনটি জেলায় ঘাঁটি গেড়ে বসা যেত, বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে ওই যুদ্ধ সম্পন্ন করা যেত। পাকিস্তানিদের সঙ্গে যুদ্ধটা সরাসরি বাঙালিদের সঙ্গে বাংলাদেশের মাটিতে হলে বাংলাদেশি জনগণের মনেও ভিন্নরকম প্রতিক্রিয়া হত। মুক্তিযুদ্ধকে ভারতের আগ্রাসী যুদ্ধ মনে করে অনেক দেশপ্রেমিক নাগরিক এ যুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। সেটি ঘটতে পারত না।
‘গলদ আমাদের চরিত্রের মধ্যে, গ্রহ-নক্ষত্র সে জন্যে দায়ী নয়।’ শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যাপারে পর্যালোচনার কালে শেক্সপীয়র উল্লেখিত পাঙক্তিটি খুবই সারগর্ভ এবং তাৎপর্যবহ বলে প্রতীয়মান হবে। মানুষ জীবন দিয়েই তো সবকিছু করে। তার কোনও কর্মই জীবন থেকে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন নয়। শেখ সাহেব তাঁর নিজের সম্পর্কে কিছু লিখেননি বা অন্য কেউই এ পর্যন্ত অনুসন্ধান বা গবেষণা ইত্যাদির সাহায্যে তাঁর জীবনকথা রচনা করেননি। তাঁর ওপর আজতক যেসমস্ত পুস্তক আমাদের দেশে প্রকাশিত হয়েছে তাতে তাঁর মানস গঠনের চরিত্র কেউ তুলে ধরেননি। শেখ মুজিবের পোশাকি জীবন এবং তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের খতিয়ান হয়ত পাওয়া যাবে, কিন্তু ব্যক্তি মুজিবকে সেখানে থেকে খুঁজে বের করা অনেকটা খড়ের গাদায় সূচের তালাশ করার মতই দুরূহ ব্যাপার।
যে যাই হোক, শেখ সাহেবের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ঘটে কলকাতা শহরে। ফরিদপুরের গোপালগঞ্জ থেকে আনুমানিক ত্রিশের দশকের একেবারে শেষ এবং চল্লিশের দশকের শুরুর দিকে তিনি ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র হিসেবে কলকাতা শহরে আসেন। তখন অবিভক্ত বাংলায় শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হকের মুখ্যমন্ত্রীত্বের কাল। মুসলিম লিগের দাবিতে পাকিস্তান আন্দোলনের হাওয়া জোরেশোরে বইতে শুরু করেছে। কংগ্রেস রাজনীতি গান্ধী এবং সুভাষ বসুর মতাদর্শগত পার্থক্যকে কেন্দ্র করে দুই মেরুতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। যুবক মুজিবের কলকাতা আগমনের অনতিকাল পূর্বে সুভাষ বুসু জাপান-জার্মনির সহায়তায় সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ভারতবর্ষ স্বাধীন করার ব্রত নিয়ে দেশ থেকে অন্তর্ধান করেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ফরওয়ার্ড ব্লক জাতীয় রাজনীতিতে অত্যন্ত সক্রিয়। কমিউনিস্ট পার্টি কলে মিলে কারখানায়, কৃষক সমাজে এবং প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অনেকখানি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। শেখ মুজিবের মতো আত্মপ্রত্যয় সম্পন্ন গতিশীল একজন যুবক কলকাতা শহরে এসে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি অঙ্গিকার ক’রে মুসলিম লিগে নাম লেখালেন। তখনকার পরিবেশ পরিস্থিতির বিচারে এটাই হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু মুজিবের পরবর্তী কর্মকাণ্ড বিবেচনার মধ্যে ধরলে তা খানিকটা বিস্মিত করে। হুমায়ুন কবিরও ফরিদপুর জেলার মানুষ। তৎকালীন মুসলিম ছাত্রসমাজে তিনি ছিলেন একটা দৃষ্টান্ত। হুমায়ুন কবির কংগ্রেস রাজনীতিতে নিজেকে সমর্পণ করেছেন। তৎকালীন পূর্ববাংলার কৃষক সমাজ থেকে আগত কমরেড মুজফফর আহমদ কমিউনিস্ট রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেছেনে। তাঁর (মুজিবের) রাজনৈতিক জীবনের সূচনাপর্বে এ দু’জনের কেউই তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেননি। মুজিবের মতো একজন প্রাণবান তোজাদ্দীপ্ত যুবক অতি সহজে নেতাজি সুভাষ বসুর ফরোয়ার্ড ব্লকে যোগদান করতেন পারতেন, এটা আশা করা মোটেই অন্যায় নয়। কিন্তু তিনি মুসলিম লিগের রাজনীতিকে কবুল করলেন। বাংলার মুসলিম লিগের মধ্যে আবার তিনটি উপদল। একটির নেতৃত্ব ছিল খাজা নাজিমুদ্দিন। সামন্ত ভূস্বামী গোষ্ঠীর লোকেরাই ছিল এই উপদলের সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষক। অন্য অংশের নেতৃত্বে ছিলেন আবুল হাসিম। রাজনীতি সচেতন, বামপন্থী চিন্তাচেতনায় প্রভাবিত মুসলিম ছাত্র এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণী এই অংশের ঘোরতর সমর্থক ছিল। এই দুটি ছাড়া তৃতীয় উপদলটির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন হোসেন শহিদ সুহরাওয়ার্দি। শেখ সাহেব সুহ্রাওয়ার্দি সাহেবের উপদলে গিয়ে জুটলেন। সুহরাওয়ার্দি সাহেব সাহেব শহর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এমন ডাকসাইটে লড়াকু কর্মীবাহিনী সহযোগে আধুনিক রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তেলার প্রয়োজনীয়তা সর্বপ্রথম অনুভব করে সেরকম সংগঠন গড়ে তুলতে প্রবৃত্ত হলেন। তাঁর কাছে উদ্দেশ্যই হল প্রধান, উপায় নির্ধারণের বেলায় তাঁর মধ্যে নৈতিকতা বোধের বিশেষ বালাই ছিল না বলে মনে করার কারণে গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের সময় শহিদ সুহরাওয়ার্দি দাঙ্গাকারীর ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন বলে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়।
এইসময় হোসেন সুহরাওয়ার্দির সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের পরিচয় ঘটা এবং তাঁর একজন বিশ্বস্ত কর্মীতে পরিণত হওয়া, সবকিছুকে কাকতালীয় ব্যাপার বলে উড়িয়ে দেওয়ার কোন উপায় নেই। পারস্পরিক প্রয়োজনের ভিত্তিতেই এই ধরনের গুরু শিষ্যের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সুহরাওয়ার্দির শিষ্যত্ব গ্রহণ শেখ মুজিবের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার। রাজনীতির প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির ধরনটার মূল পরিচয়ও এতে পাওয়া যাবে। তাঁর উচ্চকাংখা ছিল, দৃঢ়তা ছিল, আর ছিল তীব্র গতিশীলতা। কোনও পর্যায়ে রাজনৈতিক আদর্শবাদ তাঁর জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করেনি। বুদ্ধি মেধা, প্রতিভা কিংবা দূরদর্শিতা কখনও তাঁর মধ্যে অধিক দেখা যায়নি। রাজনীতি বলতে ক্ষমতা, ক্ষমতা দখলের উপায় – এটুকু তালিম তিনি শহিদ সুহরাওয়ার্দি সাহেবের কাছ থেকে ভালোভাবে পেয়েছিলেন। চোখের সামনে যা দেখা যায়, যা স্পর্শ করা, তার বাইরে কোনও কিছুকে তলিয়ে দেখার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। দৃষ্টিভঙ্গির সংকীর্ণতা এবং অনমনীয় ইচ্ছাশক্তি এ দুটোই ছিল শেখ মুজিবের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য । জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি এ দুটো পরিহার করতে পারেননি। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘পলিটিক্স অব এক্সিজেনসি’; তিনি গোটা জীবনভর সেই ধরনের রাজনীতিই করে গেছেন। সুযোগ যখন তাঁকে যতদূর নিয়ে গেছে, তিনি সেখানেই দাঁড়িয়ে পরবর্তী সুযোগের অপেক্ষা করেছেন। মওলানা ভাসানি এবং হোসেন শহিদ সুহ্রাওয়ার্দির মধ্যে যখন ইঙ্গ-মার্কিন জোটে যোগদান এবং স্বাধীন জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে বিভেদ দেখা দেয়শেখ মুজিব অবলীলায় সুহ্রাওয়ার্দিকে সমর্থন দিয়েছেন এবং ইঙ্গ-মার্কিন জোটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন। আবার যখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে সুহ্রাওয়ার্দি সরকারের অনুসৃত নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে, তার জবাবে সুহ্রাওয়ার্দি বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানকে শতকরা আটানব্বই ভাগ স্বায়ত্তশাসন এরই মধ্যে দেওয়া হয়েছে। সেদিন শেখ মুজিব তাঁর নেতার বিরুদ্ধে বলার মতো কিছুই খুঁজে পাননি বরং সুহ্রাওয়ার্দি যা বলেছেন তাকে ধ্রুবসত্য ধরে নিয়ে তাঁর নির্দেশ মেনে কাজ করে গেছেন। এটা সত্যি খুব আশ্চর্যের যে, যে-মানুষটিকে বাঙালির ‘জাতির পিতা’ বলে অভিহিত করা হয় সে একই মানুষ উনিশশো পঁয়ষট্টি সনের পূর্বে কখনও বাংলাদেশের রাজনৈতিক গন্তব্য নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামিয়েছেন, এমন কোনও প্রমাণ বড় একটা পাওয়া যায় না। এমনকি সেই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানকে যারা পূর্বা বাংলা বলত, তাদেরকে, পাকিস্তান ভিত্তিক দক্ষিণপন্থী অন্যান্য দলের মতো, বিদেশের বিশেষ করে ভারত-রাশিয়ার চর বলে সম্বোধন করতে তিনি বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হননি।
উনিশশো পঁয়ষট্টি সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের সংখ্যাধিক্য জনগণ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে যে, তাদের আসল বিপদের সময় পাকিস্তান সত্যি সত্যি পাশে এসে দাঁড়াতে সক্ষম নয়। অখণ্ড পাকিস্তানের প্রতি জনগণের যেটুকু নাড়ির যোগ ছিল তার আবেদন একেবারে অবদমিত হয়ে যায়। সেই সময়ে বাঙালি মধ্যশ্রেণীর রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামি লিগ ‘ছয় দফা’ দাবি নিয়ে জনগণের সামনে এসে হাজির হয়। এটা উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন যে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ছয় দফ দাবি ব্যাপক সাড়ার সঞ্চার করে এবং এই আন্দোলনের মাধ্যমেই শেখ মুজিবুর রহমানের নতুন ভাবমূর্তি জাগ্রত হয়। এই সময়ও একটা কথা সত্যি যে আওয়ামি লিগ বা আওয়ামি লিগের অঙ্গ সগঠনসমূহ বিশ্বাসে, আচরণে ছিল চূড়ান্তভাবে সমাজতন্ত্র বিরোধী। উনিশশোসত্তরের নির্বাচনের পর ছাত্ররা যখন তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে রাজনীতি স্পিরিট এবং বাহন দুইইহয়ে দাঁড়ায় এবং এগারো দফা কর্মসূচী প্রণয়ন করে, বাধ্য হয়ে আওয়ামি লিগ হাইকমান্ডকে এক ধরনের আপোষমূলক মনোভাব পোষণ করতে হয়। ছয় দফার সংকীর্ণ মধ্যশ্রেণীভিত্তিক রাজনীতি এবং এগারো দফার অধিকতর প্রগতিশীল রাজনীতি একই রাজনৈতিক অঙ্গনে আলাদা আলাদা খাতে প্রবাহিত হতে থাকে। তেল-জলের মতো দুটি মিশ খায়নি। মুক্তিযুদ্ধ যদি সত্যকার মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠতে পারত, এই রাজনীতির মধ্যে সংশ্লেষ সাধিত হয়ে বৃহত্তর একটা জাতীয় জঙ্গি-ঐক্যের ভিত রচনা করতে পারত। কিন্তু পঁচিশে মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আক্রমণ করে বসল। শেখ মুজিব কারারুদ্ধ হলেন, আওয়ামি লিগ নেতৃত্ব ভারতে পলায়ন করল, প্রতিরোধ আন্দোলন চুরমার হয়ে গেল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভারতের নিজস্ব যুদ্ধ হয়ে দাঁড়াল। ভারত আওয়ামি লিগকে বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন করার অভিপ্রায়ে যুদ্ধে নেমে পড়ল। কারণ বিলম্বে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের চরিত্র পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। পেছন থেকে রাশিয়া এসে জুটল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পরাজিত হল। আর উনিশশো একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হল।
শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে এলেন। যে ‘উইল টু পাওয়ার’ তিনি অন্তরে লালন করেছেন, সেই আশ্চর্য ক্ষমতামনস্কতা তাঁকে বাংলাদেশের সর্বময় কর্তৃত্বের আসনে বসাল। কিন্তু এ কোন বাংলাদেশ? চারিদিকে ধ্বংসের স্তূপ। বাতাসে রোদন ধ্বনি, হত্যা, লুটপাট সমানে চলছে। আওয়ামি লিগের লোকেরা শবভূক শকুনের মতো চক্কর দিয়ে বেড়াচ্ছে। কী করবেন শেখ মুজিব? তাঁর কী করার আছে? যে অনমনীয় আকাঙ্ক্ষার আগুন তাঁকে ঠেলে এতদূরে নিয়ে এসেছে, সেই আকাংখাই তাঁকে পাকে পাকে বেঁধে ফেলেছে। পুরাতন বাংলাদেশ নেই, পুরাতন মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাঁর পেছনে নেই। তাঁকে ঘোষণা দিতে হল, তিনি সমাজতন্ত্র করবেন। আওয়ামি লিগের লোকজন কথা নেড়ে সায় দিল। তিনি দল ভেঙ্গে একদল করলেন। ইতিহাসের ঘূর্ণাবর্তে অসহায় বন্দী শেখ মুজিব নিজেও ভালো করে জানতেন না, তিনি কী করতে যাচ্ছেন। পেছনে তিনি ফেরত যেতে পারবেন না, সামনে উত্তাল সমুদ্র, সাঁতার দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাঁর থাকলেও অভ্যাস নেই। তাঁর লোকজন যারা এতদূর তাঁর সঙ্গে এসেছেন, আর যেতে রাজি হবে না। ভেতর থেকে কোনও ভরসা না পেয়ে তিনি বাইরের দিকে তাকাতে আরম্ভ করেছেন। মস্কোপন্থী দলগুলো বুদ্ধিপরামর্শ এবং মন্ত্রণা দিতে এল। শেখ মুজিবুর রহমান সারাজীবনের রাজনীতিতে যা করেননি তাই করতে বাধ্য হলেন। মস্কোর কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। তিনি মনে করছেন রশি তাঁর হাতে আছে, কেননা এখনও মানুষ তাঁকে দর্শন মাত্রই জয়ধ্বনি করে, তাঁর কথায় হাত ওঠায়। উষ্ণহৃদয় মুজিব চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী হয়েও বিরোধী দলের নেতার মতো বক্তৃতা দিতে পারেন। এবং হয়তো মনে করেন, এখনও পর্যন্ত ভুখানাঙ্গা মানুষের মনে কণ্ঠস্বরের যাদুমন্ত্রে আশার আলো জ্বালিয়ে তুলতে পারেন। ক্ষমতার উঁচুমঞ্চে অবস্থান করে এখনও মনে করেন বাংলাদেশের জন্য তিনি অনিবার্য। এদিকে ঘটনার নিজস্ব নিয়মে ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। গোটা জীবন ঘটনাটা ঘটে যেতে দিয়ে তিনি অপেক্ষা করেছেন এবং প্রতিবারই ভাগ্য তাঁর প্রতি প্রসন্ন হাসি হেসেছে।
কিন্তু তিনি না পারলেন পুরনো পুঁজিবাদী অবস্থায় ফিরে যেতে, না পারলেন একটা প্রগতিশীল অর্থনীতির ভিত প্রতিষ্ঠা করতে। তিনি পাকিস্তানিদের বিচার করতে পারলেন না যেমন, স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রতিও তেমন রূঢ় হতে পারলেন না। আবার আপন দলের মানুষ এমনকি আপন পরিবারের লোকজনদেরও স্বেচ্ছাচারিতা নিবৃত্ত করতে ব্যর্থ হলেন। ত্রিশ লাখ, না ধরে নিলাম দশ লাখ মানুষের রক্তের দরিয়ার ওপারে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড প্রচণ্ড হুংকার দেওয়া ছাড়া কিছুই করতে পারছেন না। লুটপাট অত্যাচার নির্যাতন খুন গুমখুন সমানে চলছে। ঘটনাস্রোত নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যতই হস্ত প্রসারিত করেন ততই আউলা হয়ে পড়ে। জনগণ তাঁর কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে হ্যামলিনের যাদুকরের মতো পেছনে অনুসরণ করেছে। তাঁকে অনুসরণ করার অভ্যাস জনগণের বহুদিনের, ভেড়ার পালের মতো তাদের তাড়িত করার স্বভাবটিও তাঁর বহু পুরনো। তাই তিনি তখনও মনে করতেন তিনি বাংলার মানুষকে ভালোবাসেন, আর বাংলার মানুষও তাঁকে ভালোবাসেন। এরই মধ্যে অন্তিম ঘটনানাটি দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে আসছে। অবশেষে দেখা গেল চৌদ্দই আগষ্টের রাত্রে সপরিবারে গুলিবিদ্ধ মুজিবের দীর্ঘদেহী শরীর চাপচাপ জমাট বাঁধা রক্তের মধ্যে পড়ে আছে নিস্তব্ধ নিথর। হায় রে শেখ মুজিব, তোমার জন্য অশ্রু তোমার জন্য বেদনা।
উত্থাপিত প্রশ্নের জবাবে কী বলব? শেখ মুজিব কি একজন বীর? না। একজন ভিলেন? তাও না। বীরত্বের উপাদান তাঁর মধ্যে ছিল, কিন্তু ইতিহাসের আসল প্রেক্ষিতের সঙ্গে তার মিল ঘটেনি। তাই তিনি একজন প্রকৃত বীর হয়ে উঠতে পারেননি। খুব সম্ভবত শেখ মুজিব একজন করুণ বীর, তাঁর চরিত্র অবলম্বন করে ভবিষ্যতে সার্থক বিয়োগান্ত নাটক লেখা হবে-কিন্তু তাঁর আদর্শ অনুসরণ করে বাংলার ইতিহাসের মুক্তি ঘটানো যাবে না।
(প্রথম প্রকাশিত, গৌতম চৌধুরী সম্পাদিত ‘যুক্তাক্ষর’ (মে ১৯৯৬)