ইহুদিরা শ্রেষ্ঠ হবার কারণ কি?
“ইহুদিরা ভালো খায়, তাই তারা ভালো চিন্তা করতে পারে, এবং এ কারণে তারা আজ সারা বিশ্বের নেতৃত্ব দিচ্ছে। সুতরাং, মুসলিমদেরকেও এখন তাদের অনুকরণ করা উচিত।”
– এ কথাটা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ বিতর্ক হচ্ছে দেখলাম। তাই, আমিও একটু অংশ নিলাম।
মানুষের খাবার তার চিন্তা-ভাবনায় অনেক প্রভাব ফেলে, এ কথাটি খুবই সত্য। ইবনে খালদুন তাঁর মুকাদ্দিমায় এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আমরা সে আলোচনায় না গিয়ে কোর’আন ও হাদিস থেকে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করছি।
আল্লাহ তায়ালা তাঁর সকল নবী ও রাসূলদেরকে উত্তম ও ভালো খাবার খেতে বলেছেন।
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلرُّسُلُ كُلُوا۟ مِنَ ٱلطَّيِّبَـٰتِ وَٱعْمَلُوا۟ صَـٰلِحًا ۖ إِنِّى بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌۭ
“হে রসূলগণ, তোমরা উত্তম খাদ্য আহার কর এবং সৎকাজ কর। তোমরা যা কর, সে বিষয়ে আমি পরিজ্ঞাত”। [সূরা ২৩/ মুমিনূন – ৫১]
মুমিনদের-ই একটি বৈশিষ্ট্য হলো তারা পুষ্টিকর ও উত্তম খাবার খায়। এ কারণেই সূরা মু’মিনে ভালো খাবারের আলোচনাটি এসেছে। শুধু তাই নয়, পুষ্টিকর ও উত্তম খাদ্য খাবারের জন্যে আল্লাহ তায়ালা তাঁর মুমিন বান্দাদেরকে নির্দেশও দিয়েছেন।
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ كُلُوا۟ مِن طَيِّبَـٰتِ مَا رَزَقْنَـٰكُمْ وَٱشْكُرُوا۟ لِلَّهِ إِن كُنتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ
“হে ঈমানদারগণ, আমি তোমাদেরকে যে রিজিক দান করেছি, তা থেকে উত্তম খাদ্য আহার কর। এবং আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, যদি তোমরা তাঁরই বন্দেগী কর”। [সূরা ২/ বাকারা – ১৭২]
রাসূল (স)-এর অনেকগুলো হাদিস থেকেও জানা যায় যে, হালাল ও উত্তম খাবারের সাথে চিন্তা-ভাবনা ও কাজের সম্পর্ক রয়েছে।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ” أَيُّهَا النَّاسُ، إِنَّ اللهَ طَيِّبٌ لَا يَقْبَلُ إِلَّا طَيِّبًا، وَإِنَّ اللهَ أَمَرَ الْمُؤْمِنِينَ بِمَا أَمَرَ بِهِ الْمُرْسَلِينَ، فَقَالَ: {يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا، إِنِّي بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ} [المؤمنون: 51] وَقَالَ: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ} [البقرة: 172] ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلَ يُطِيلُ السَّفَرَ أَشْعَثَ أَغْبَرَ، يَمُدُّ يَدَيْهِ إِلَى السَّمَاءِ، يَا رَبِّ، يَا رَبِّ، وَمَطْعَمُهُ حَرَامٌ، وَمَشْرَبُهُ حَرَامٌ، وَمَلْبَسُهُ حَرَامٌ، وَغُذِيَ بِالْحَرَامِ، فَأَنَّى يُسْتَجَابُ لِذَلِكَ؟ ”
“রাসূল (স) বলেন – এক ব্যক্তি আকাশের দিকে দু’হাত তুলে ব্যাকুলভাবে বলতে থাকে, “ইয়া রব! ইয়া রব!”। কিন্তু সে ব্যক্তির খাদ্যসামগ্রী হারাম উপার্জনের, তার পানীয় হারাম উপার্জনের, তার পরিধেয় পোশাক-পরিচ্ছদ হারাম হারাম উপার্জনের, এমতাবস্থায় তার দোয়া কি করে কবুল হতে পারে?”
[সহীহ মুসলিম, মাকতাবায়ে শামেলা, হাদিস নং – ১০১৫]
উপরোক্ত আয়াত ও হাদিসগুলো থেকে কয়েকটি অনুসিদ্ধান্তে আসা যায়।
১। আমরা যা খাই, সবি আল্লাহর রিজিক। কোনো খাদ্য হালাল হলেও তা উত্তম [طَيِّبٌ] খাদ্য নাও হতে পারে।
২। হালাল খাদ্যের মধ্যে যেগুলো উত্তম খাদ্য, সেগুলো খাওয়া জন্যে আল্লাহ তায়ালা সকল নবী-রাসূল এবং মুমিনদেরকে আদেশ করেছেন।
৩। খাদ্যের সাথে আমাদের চিন্তা-ভাবনা ও কাজের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
________
এবার আসি, ইহুদিদের আলোচনায়। মূলত এই আলোচনা করার জন্যেই উপরের ভূমিকাটি দিতে হলো।
“ইহুদিরা ভালো খাদ্য খায়, এবং তারা পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ ” – এ কথাটা কোর’আনেই বলা হয়েছে।
وَلَقَدْ ءَاتَيْنَا بَنِىٓ إِسْرَٰٓءِيلَ ٱلْكِتَـٰبَ وَٱلْحُكْمَ وَٱلنُّبُوَّةَ وَرَزَقْنَـٰهُم مِّنَ ٱلطَّيِّبَـٰتِ وَفَضَّلْنَـٰهُمْ عَلَى ٱلْعَـٰلَمِينَ
“আমি বনী ইসরাইলকে কিতাব, কর্তৃত্ব ও নবুওয়ত দান করেছিলাম। তাদেরকে পরিচ্ছন্ন খাদ্য-পানীয় দিয়েছিলাম এবং বিশ্ববাসীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছিলাম”। [সূরা ৪৫/জাছিয়া – ১৬]
কিন্তু, ঘটনা এখানেই শেষ নয়। এই সূরার পরবর্তী আরো চার আয়াত পড়তে হবে। তাহলে আসল কাহিনী বুঝা যাবে।
وَءَاتَيْنَـٰهُم بَيِّنَـٰتٍۢ مِّنَ ٱلْأَمْرِ ۖ فَمَا ٱخْتَلَفُوٓا۟ إِلَّا مِنۢ بَعْدِ مَا جَآءَهُمُ ٱلْعِلْمُ بَغْيًۢا بَيْنَهُمْ ۚ إِنَّ رَبَّكَ يَقْضِى بَيْنَهُمْ يَوْمَ ٱلْقِيَـٰمَةِ فِيمَا كَانُوا۟ فِيهِ يَخْتَلِفُونَ
“আমি তাদেরকে ধর্মের সুস্পষ্ট প্রমাণাদি দিয়েছিলাম। অতঃপর তারা জ্ঞান লাভ করার পর শুধু পারস্পরিক জেদের বশবর্তী হয়ে মতভেদ সৃষ্টি করেছে। তারা যে বিষয়ে মতভেদ করত, আপনার পালনকর্তা কেয়ামতের দিন তার ফয়সালা করে দেবেন।” [সূরা ৪৫/জাছিয়া – ১৭]
এ আয়াতে স্পষ্ট যে, জ্ঞানের কারণে তাঁরা শ্রেষ্ঠ হবার পর পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ শুরু করে। ফলে তাদের মাঝে মতবিরোধ শুরু হয়। এবং তারা আস্তে আস্তে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব হারিয়ে ফেলে।
এর পরের আয়াতে আসি।
ثُمَّ جَعَلْنَـٰكَ عَلَىٰ شَرِيعَةٍۢ مِّنَ ٱلْأَمْرِ فَٱتَّبِعْهَا وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَآءَ ٱلَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ
“এরপর আমি আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি ধর্মের একটি বিশেষ বিধানের উপর। অতএব, আপনি এর অনুসরণ করুন এবং অজ্ঞদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করবেন না”। [সূরা ৪৫/জাছিয়া – ১৮]
অর্থাৎ, ইহুদিদের যায়গায় এবার মুসলিমদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু বলে দেয়া হয়েছে যে, আপনি অজ্ঞদের অনুসরণ করবেন না।
এখন প্রশ্ন হলো, কারা এই অজ্ঞের দল?
উত্তর – ইহুদিরা।
কেন?
কারণ, তারা অহংকার ও বিদ্বেষের কারণে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল।
এবার, পরের আয়াতে আসি।
إِنَّهُمْ لَن يُغْنُوا۟ عَنكَ مِنَ ٱللَّهِ شَيْـًۭٔا ۚ وَإِنَّ ٱلظَّـٰلِمِينَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَآءُ بَعْضٍۢ ۖ وَٱللَّهُ وَلِىُّ ٱلْمُتَّقِينَ
“আল্লাহর সামনে তারা আপনার কোন উপকারে আসবে না। জালেমরা একে অপরের বন্ধু। আর আল্লাহ পরহেজগারদের বন্ধু”। [সূরা ৪৫/জাছিয়া – ১৮]
অর্থাৎ, ইহুদিরা যতই শ্রেষ্ঠ হোক না কেনো, তাদের দ্বারা মুসলিমদের কোনো উপকার হবে না। কারণ, তারা শ্রেষ্ঠ হয়েছে জুলুম করার মাধ্যমে। কিন্তু জুলুমের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ হবার কোনো সুযোগ ইসলামে নেই।
তাহলে পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ হবার উপাই কি? পরবর্তী আয়াতে তাই বলা হচ্ছে।
هَـٰذَا بَصَـٰٓئِرُ لِلنَّاسِ وَهُدًۭى وَرَحْمَةٌۭ لِّقَوْمٍۢ يُوقِنُونَ
“এই কোর’আন মানুষের জন্যে দৃষ্টিশক্তি দানকারী এবং বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য পথ-প্রদর্শনকারী ও রহমত”। [সূরা ৪৫/জাছিয়া – ১৮]
অর্থাৎ, ইহুদীদের মত জুলুম করে নয়, বরং কোর’আনের সাহায্যেই মুসলিমদেরকে শ্রেষ্ঠ হতে হবে।
________
সবগুলো কথার সারমর্ম করে ফেলি এবার।
১। পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ হবার জন্যে জ্ঞানের প্রয়োজন। আর জ্ঞানের জন্যে উত্তম ও পুষ্টিকর খাবারের প্রয়োজন। কিন্তু, কেবল উত্তম খাবার খেলেই মানুষ শ্রেষ্ঠ হতে পারে না। শ্রেষ্ঠ হবার জন্যে আসলে একতার প্রয়োজন।
২। ফিলিস্তিন দখল করে বিশ্বের সকল ইহুদী সেখানে একতাবদ্ধ হয়। এর ফলে, কোর’আনের নিয়ম অনুযায়ী, তারা আস্তে আস্তে শক্তিশালী হতে শুরু করে।
৩। মুসলিমরা তাদের অহংকার ও বিদ্বেষের কারণে এবং কোর’আন থেকে দূরে সরে যাবার কারণে নানা দলে উপদলে বিভক্ত হতে শুরু করে। এ কারণে, কোর’আনের নিয়ম অনুযায়ী, মুসলিমরা দুর্বল হতে থাকে।
৪। ইহুদিরা একতাবদ্ধ হবার কারণে তারা শ্রেষ্ঠ হয়েছে ঠিক, কিন্তু তাদের কাছে আল্লাহর কিতাব না থাকার কারণে তারা সারা বিশ্বে একটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জুলুম প্রতিষ্ঠা করেছে।
৫। ইহুদিরা জুলুমের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ হবার কারণে তাদেরকে অনুসরণ করা যাবে না। রাজনৈতিকভাবে ইহুদীরা কখনোই মুসলিমদের বন্ধু হতে পারে না।
৬। মুসলিমরা যদি পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ হতে চায়, তাহলে তাদেরকে প্রথমত হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে একতাবদ্ধ হতে হবে। আর, একতাবদ্ধ হবার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো আল-কোর’আন। মুসলিমরা কোর’আন থেকে যত দূরে সরে যাবে, তারা তত বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল হতে থাকবে। আর, তারা কোর’আনের যত কাছে আসতে থাকবে, তত একতাবদ্ধ ও শক্তিশালী হতে পারবে।
৭। ইহুদীদের মত জুলুম না করে মুসলিমদের জন্যে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ হবার একমাত্র উপায় হলো আল-কোর’আন।