আহলে কোর’আন, আহলে হাদিস ও আহলে সুন্নাহ
আহলে হাদিসের স্কলারদের মধ্যে মতপার্থক্য:
নাসিরুদ্দীন আলবানী, মুহাম্মদ ইবনে সালেহ আল উসাইমিন, এবং আব্দুল্লাহ বিন বায – এই তিনজনই হলেন আহলে হাদিসের সবচেয়ে বড় আলিম। কিন্তু আকিদা ও ফিকহ বিষয়ে তিনজনের মত ছিলো তিন ধরণের।
এই তিনজন আলিমের প্রায় ৪০০টি মতপার্থক্য নিয়ে ড সায়াদ আল বুরাইক একটি বই লিখেন। নাম – الإيجاز في بعض ما اختلف فيه الألباني وابن عثيمين وابن باز
এই বইতে সায়াদ আর বুরাইক দেখান যে, আকিদা এবং ফিকহ বিষয়ে আহলে হাদিসের বড় বড় ইমামদের নিজেদের মধ্যেই অনেক মতপার্থক্য ছিলো। একজন আহলে হাদিসের আলিম বলেছেন, “এটি সুন্নত”, ঠিক একই কাজকে আহলে হাদিসের অন্য একজন আলিম বলেছেন, “এটি বিদায়াত” ।
যেমন,
আবদুল্লাহ বিন বায বলেছেন – “রুকু থেকে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর পর হাত বাঁধা সুন্নত”। কিন্তু, নাসিরুদ্দীন আলবানী বলেছেন – “রুকু থেকে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর পর হাত বাঁধা একটি বিদায়াত ও গুনাহের কাজ”।
এখানে উভয়েই আহলে হাদিসের বড় ইমাম। কিন্তু একজন আহলে হাদিস যেটিকে সুন্নত বলছেন, অন্য একজন আহলে হাদিস ঠিক একই কাজকে বিদায়াত বলছেন।
[সূত্র: উস্তাদ আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর]
________________________
আহলে সুন্নাহ ও আহলে হাদিসের মাঝে পার্থক্য :
১। ‘আহলে সুন্নাহ’ তাবেঈনদের সময়কার একটি জামায়াত। কিন্তু ‘আহলে হাদিস’ নতুন আবিষ্কৃত আধুনিক কালের একটি গ্রুপ।
২। ‘আহলে সুন্নাহ’ রাসুল (স) এর আমল ও আখলাককে বেশি গুরুত্ব দেয়। কিন্তু ‘আহলে হাদিস’ আমল ও আখলাকের চেয়ে রাসূল (স) এর লিখিত হাদিসকে বেশি গুরুত্ব দেয়।
৩। ‘আহলে সুন্নাহ’ এর মধ্যে মালিকি, হানাফি, শাফি, হাম্বলি সহ অসংখ্য স্কুল ও মতবাদের স্থান রয়েছে। কিন্তু ‘আহলে হাদিস’ তাঁদের বাইরে অন্য মতামত গ্রহণ করতে পারে না।
৪। ‘আহলে সুন্নাহ’ ব্যক্তি ও উস্তাদ নির্ভর। কিন্তু ‘আহলে হাদিস’ গ্রন্থ নির্ভর। কোর’আনের ও হাদিসকে পরিবেশের আলোকে ব্যাখ্যা প্রদান করে আহলে সুন্নাহ। কিন্তু আহলে হাদিস পরিবেশ ও পরিস্থিতিকে গুরুত্ব দেয় না।
৫। সব ধরণের কালামি ও দার্শনিক বিতর্ককে স্বাগত জানায় আহলে সুন্নাহ। কিন্তু, ‘আহলে হাদিস’ কালামি ও দার্শনিক বিতর্কগুলোর মাঝে প্রবেশ করতে পারে না।
________________________
আহলে সুন্নাতের পরিচয়
ইসলামের মধ্যে যখন বিভিন্ন মতবাদ সৃষ্টি হতে শুরু করলো – কেউ খারেজি, কেউ মুতাজিলা, কেউ শিয়া মতবাদ নিয়ে বিভক্ত হতে লাগলো, তখন নতুন আরেকটি চিন্তার প্রসার ঘটলো। এর নাম – ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত’।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আলেমরা তখন বলতে লাগলেন –
“যে কোনো মুসলিম যদি কাবার দিকে ফিরে নামাজ পড়ে, তাহলে সে আমাদের দলভুক্ত হিসাবে বিবেচিত হবে। এবং আমরা তাকে কাফের, ভ্রান্ত বা ফেরকা বলে ফতোয়া দিব না।”
________________________
সালফে সালেহীন এবং আধুনিক সালাফীদের মধ্যে একটি বড় পার্থক্য
সালফে সালেহীনগণ নতুন নতুন জ্ঞানের শাখা সৃষ্টি করতে ব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু, আধুনিক সালাফীগন জ্ঞানের বিভিন্ন শাখাগুলোকে বন্ধ করতে ব্যস্ত থাকেন।
________________________
ইসলামের দ্বিতীয় উৎস সুন্নাহ, সহীহ হাদিস নয়
‘কোর’আন ও সহীহ হাদিস ছাড়া আমরা কিছু মানি না’ – এ কথাটির মাঝে একটি সমস্যা আছে।
ইসলামের দ্বিতীয় উৎস হলো সুন্নাহ, সহীহ হাদিস নয়। কেউ যখন সুন্নাহ শব্দের স্থানে হাদিস এবং হাদিস শব্দটির স্থানে সুন্নাহ শব্দটি ব্যবহার করেন, তখন বেশ কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়।
অনেকে বলেন, সুন্নাহ মানেই সহীহ হাদিস, আর, সহীহ হাদিস মানেই সুন্নাহ। দু’টি বিষয় একই।
আসলে কিন্তু তা না। সুন্নাহ ও সহীহ হাদিসের মাঝে অনেক বড় পার্থক্য রয়েছে। প্রতিটি সুন্নাহ-ই হাদিস, কিন্তু প্রতিটি হাদিস সুন্নাহ নয়।
মোহাম্মদ (স) একজন মানুষ হিসাবে এবং একজন রাসূল হিসাবে অনেক কিছুই বলেছেন বা করেছেন। তিনি যা যা বলেছেন, অথবা, তিনি যা যা করেছেন, সব কিছুই হাদিস হিসাবে গণ্য হয়, কিন্তু সব কিছু আমাদের জন্যে সুন্নাহ নয়।
যেমন, রাসূল (স) চারটির অধিক বিয়ে করেছেন, এটা সহীহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হলেও, এটা পালন করা আমাদের জন্যে সুন্নাহ নয়।
একইভাবে, মোহাম্মদ (স) একজন মানুষ হিসাবে কিছু কাজ করেছেন এবং কিছু আদেশ দিয়েছেন, যা সহীহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হলেও তা আমাদের জন্যে সুন্নাত বা পালনীয় নয়।
রাসূল (স) নিজেই বলেছেন,
إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ ، إِذَا أَمَرْتُكُمْ بِشَيْءٍ مِنْ دِينِكُمْ ، فَخُذُوا بِهِ ، وَإِذَا أَمَرْتُكُمْ بِشَيْءٍ مِنْ رَأْيٍ ، فَإِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ
“আমি একজন মানুষ। যখন আমি ধর্ম সম্পর্কে কিছু আদেশ করব, তখন তা গ্রহণ করবে। কিন্তু আমি যদি আমার নিজের মতামত থেকে কিছু আদেশ করি, তাহলে তো একজন মানুষ-ই।” [সহীহ মুসলিম, মাকতাবায়ে শামেলা, হাদিস নং – ২৩৬২]
সুতরাং, কোনো কিছু সহীহ হাদিসের কিতাবে থাকলেই, তা আমাদের জন্যে সুন্নাহ বা পালনীয় হিসাবে নির্ধারিত হয় না। বরং, সহীহ হাদিসমূহকে কোর’আন আলোকে এবং সমসাময়িক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেই সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত করতে হয়।
যেমন, ইমাম মালিক (র) অনেক হাদিসকেই সহীহ মনে করতেন, কিন্তু তা সুন্নাত হিসাবে পালন করতেন না। কোনো কিছু সহীহ হাদিসের গ্রন্থে থাকলেই তা আমাদের জন্যে সুন্নাত বা পালনীয় হয়ে যায় না।
ইসলামের দ্বিতীয় উৎস হলো রাসুল (স) –এর সুন্নাহ, সহীহ হাদিস নয়।
________________________
তিন মতবাদের পার্থক্য
আহলে কোর’আন – যারা কেবল কোর’আন থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
আহলে হাদিস – যারা কেবল হাদিসের কিতাব থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
আহলে সুন্নাহ – যারা কোর’আন, হাদিস ও সাহাবীদের কর্মপদ্ধতিকে আমলে নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
________________________
কোর’আনের গুরুত্ব
আহলে সুন্নাহের ফকিহ যারা, তাঁরা কোনো সহীহ হাদিস পেলে প্রথমে তা কোর’আন দিয়ে যাচাই করেন। যদি কোর’আনের সাথে সামঞ্জস্য হয়, তাহলে তা আমল করার জন্যে গ্রহণ করেন। কিন্তু কোর’আনের সাথে সামঞ্জস্য না হলে হাদিসটিকে সহীহ হিসাবে স্বীকার করেন, কিন্তু আমল করেন না।
অন্যদিকে আহলে হাদিসের মুহাদ্দিসগন কেবল হাদিসের সনদ যাচাই করেন, কিন্তু হাদিসের মতন কোর’আনের সাথে সমঞ্জস্য আছে কি না তা যাচাই করেন না।
________________________
বিজ্ঞান ও আহলে হাদিস
১। বিজ্ঞান ও টেকনোলজির মধ্যে অনেক বড় পার্থক্য রয়েছে। বিজ্ঞান হলো একটি মতাদর্শের নাম, কিন্তু টেকনোলজি হলো যন্ত্র আবিষ্কার পদ্ধতির নাম। টেকনোলজিকে ভালো উপায়ে ব্যবহার করা যায়, আবার খারাপ উপায়েও ব্যবহার করা যায়। মানবতা ও পরিবেশকে ধ্বংসের জন্যে আধুনিক বিজ্ঞান খারাপভাবে টেকনোলজিকে ব্যাবহার করছে।
২। আহলে হাদিস ও সহীহ হাদিসের মাঝে অনেক বড় পার্থক্য রয়েছে। আহলে হাদিস হলো একটি মতাদর্শের নাম, কিন্তু সহীহ হাদিস হলো রাসূল (স)-এর বাণী। সহীহ হাদিসগুলো দিয়ে উম্মতের জন্যে দ্বীনকে যেমন সহজ ও রহমত স্বরূপ উপস্থাপন করা যায়, আবার, কঠিন হিসাবেও উপস্থাপন করা যায়। আহলে হাদিস স্কুলটি ইসলাম ধর্মকে কঠিন হিসাবে উপস্থাপনের জন্যে সহীহ হাদিসকে ব্যবহার করেন।
________________________
আহলে হাদিস ও সালাফীদের সাথে রাসূল (স) ও সাহাবী পার্থক্য
বর্তমানের আহলে হাদীস বা সালাফীগণ মনে করেন, একটি হাদিসের কেবল একটিমাত্র অর্থ হতে পারে। আসলে এটি একটি ভুল আকিদা। রাসূল (স)-এর একটি সহীহ হাদিসের একাধিক অর্থ হতে পারে।
উদাহরণ স্বরূপ, নিচের হাদিসটি লক্ষ করুন –
عَنِ ابْنِ عُمَرَ، قَالَ: قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَنَا لَمَّا رَجَعَ مِنَ الأَحْزَابِ: «لاَ يُصَلِّيَنَّ أَحَدٌ العَصْرَ إِلَّا فِي بَنِي قُرَيْظَةَ» فَأَدْرَكَ بَعْضَهُمُ العَصْرُ فِي الطَّرِيقِ، فَقَالَ بَعْضُهُمْ: لاَ نُصَلِّي حَتَّى نَأْتِيَهَا، وَقَالَ بَعْضُهُمْ: بَلْ نُصَلِّي، لَمْ يُرَدْ مِنَّا ذَلِكَ، فَذُكِرَ لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَلَمْ يُعَنِّفْ وَاحِدًا مِنْهُمْ
“ইবনে উমার (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা যখন আহযাব যুদ্ধ থেকে ফিরছিলাম, তখন নবীজি (স) আমাদেরকে বললেন, ‘বনী কোরাইজায় পৌঁছা ব্যতীত একজনও আসরের সালাত পড়বে না”। তারপর কিছু সাহাবী রাস্তায় আসরের সালাত পড়তে চাইলেন। তখন অন্য কিছু সাহাবী বলবেন, ‘আমরা বনী কোরাইজায় পোঁছা ব্যতীত আসরের সালাত পড়বো না’। এরপর কিছু সাহাবী বললেন, ‘আমরা এখানে রাস্তায় আসরের সালাত পড়ে ফেলবো, কারণ, রাসূল (স) আমাদের কাছে বনী কোরাইজায় গিয়ে সালাত পড়াটা চাননি’। অতঃপর, উক্ত ঘটনাটি রাসূল (স)-কে জানানো হলো, তিনি দু’দলের কাউকেই কিছু বলেননি।”
[সহীহ বুখারী, ৯৪৬, মাকতাবায়ে শামেলা]
বর্তমানের আহলে হাদিস ও সালাফীদের সাথে রাসূল (স) ও সাহাবী পার্থক্য এটাই। রাসূল (স)-তাঁর একটি কথার দুটি অর্থকেই সমর্থন করেছিলেন, কিন্তু আধুনিক সালাফীগণ একটি হাদিসের দুটি অর্থকে সমর্থন করেন না।
________________________
মাজহাবের প্রয়োজনীয়তা
বিভিন্ন মাজহাবের উৎপত্তি ধর্মকে বিভক্তি করে না, বরং ধর্মকে বিভক্তি থেকে রক্ষা করে। মাজহাব মানে ধর্মকে বোঝার একটি গবেষণা পদ্ধতি বা মেথোডোলজি।
উদাহরণ স্বরূপ, হানাফি মাজহাবের কথা কল্পনা করা যাক। হানাফি মাজহাব ইমাম আবু হানিফার নামে প্রতিষ্ঠিত হলেও এখানে মূলত অসংখ্য বড় বড় ইমামের সম্মেলিত অবদান রয়েছে।
ইমাম আবু হানিফার যুগে অনেক আলেম ছিলেন, একেক জন একেক রকম ফতোয়া দিতেন। তখন ইমাম আবু হানিফা এমন একটি গবেষণা পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন, যাতে সবার চিন্তা মোটামুটি একই ফলাফলে এসে উপনীত হয়। এই যে পদ্ধতিটা ইমাম আবু হানিফা আবিষ্কার করলেন, এর নাম হানাফি মাজহাব।
অর্থাৎ, প্রত্যেক মানুষ ভিন্ন ভিন্নভাবে ফতোয়া না দিয়ে সবাই যাতে একটি গবেষণা পদ্ধতি অবলম্বন করে মোটামুটি একই ফলাফলে পৌঁছাতে পারে, সে জন্যেই বিভিন্ন গবেষণা পদ্ধতি বা মাজহাবের উৎপত্তি।
________________________
কোর’আন, হাদিস ও ফিকহের সম্পর্ক
কোর’আনে সালাত পড়ার আদেশ যেমন আছে, তেমনি খাওয়ার আদেশও আছে। কিন্তু কোন আদেশটি কতটুকু গুরুত্ব পাবে, সেটা নির্ধারিত হয় হাদিস দ্বারা।
হাদিসে ডান হাতে খাবার গ্রহণের কথা যেমন আছে, তেমনি উটে চড়ে যাতায়াত করার কথাও বলা আছে। কিন্তু কোন কাজটি কতটুকু গুরুত্ব পাবে, তা নির্ধারিত হয় ফিকহের মাধ্যমে।
ফিকহে একই কাজকে কেউ সঠিক মনে করেন, আবার একই কাজকে কেউ ভুল মনে করেন। ফিকহ নির্ধারিত হয় স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় মানুষের যুক্তি-বুদ্ধির সাহায্যে।
অর্থাৎ,
Al Quran is categorized by Hadith. Hadith is categorized by Fiqh, and Fiqh is categorized by intellect or inner Revelation.
আসসালামু আলাইকুম
পোস্ট টি পড়ে ভাল লাগল। এই বিষয়ে আরো বিস্তারিত পোস্ট চায়। সঠিক বিবাচনার আরো যুক্তি তুলে ধরুক।
ধন্যবাদ
আসসালামু আলাইকুম
পোস্ট টি পড়ে ভাল লাগল। এই বিষয়ে আরো বিস্তারিত পোস্ট চায়। সঠিক বিবাচনার আরো যুক্তি তুলে ধরুক।
ধন্যবাদ
h
বুঝলাম অনেক কিছু।
জাযাকাল্লাহ খায়রান
মাযহাব একটি হলে তো কথা ছিল, মাযহাব তো ৪ টা। এদের মধ্যে মতপার্থক্যও আছে। তো কোন মাযহাব অনুসরণ করা উওম??