আমার বাংলা বই – ইবতেদায়ি প্রথম শ্রেণি
বুক রিভিউ
আমার বাংলা বই – ইবতেদায়ি প্রথম শ্রেণি (২০১৯)
স্কুলের “আমার বাংলা বই” এবং মাদ্রাসার “আমার বাংলা বই” একই রকম। কিন্তু স্কুলের বইটি মাদ্রাসার সিলেবাসে ঢুকাতে গিয়ে কিছু সমস্যা হয়েছে। মাদ্রাসার বই থেকে হিন্দু সংস্কৃতি ও কালচার সরাতে গিয়ে বইয়ে অসংখ্য অসঙ্গতি ও অসামঞ্জস্যতা সৃষ্টি হয়েছে।
স্কুলের বইটিতে সেক্যুলারিজমের নামে অসংখ্য হিন্দু কালচার ও সংস্কৃতি রয়েছে। কিন্তু মাদ্রাসার বইয়ে তো আর হিন্দু কালচার ও সংস্কৃতি পড়ানো সম্ভব না। তাই মাদ্রাসার বইয়ে সামান্য কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। যদিও এখনো মাদ্রাসার বইটিতে অনেক হিন্দু সংস্কৃতি ও কালচার রয়ে গেছে।
যাই হোক, মাদ্রাসার ও স্কুলের বইয়ের পার্থক্যগুলো প্রথমে দেখে নেয়া যাক।
১) স্কুলের বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা। মাদ্রাসার বইয়েও তিনিই ভূমিকা লিখেছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, স্কুলের বইয়ে নারায়ণ চন্দ্র সাহার নামটা থাকলেও মাদ্রাসার বইয়ে উনার নামটা গোপন করা হয়েছে। সম্ভবত, মাদ্রাসার শিক্ষকরা বইয়ের শুরুতেই হিন্দু নাম দেখলে নাখোশ হতে পারেন, তাই চন্দ্র সাহার নামটা গোপন করা হয়েছে।
২) স্কুলের বইয়ে যে ছবিগুলো ব্যবহার করা হয়েছে, সেখানে নারীদের মাথায় ওড়না নেই, পুরুষদের মাথায় টুপি নেই, এবং বাচ্চা মেয়েদের পরনে আছে হাফ-প্যান্ট। কিন্তু, মাদ্রাসার বইয়ের কিছু ছবিতে নারীদের মাথায় ওড়না এবং পুরুষদের মাথায় টুপি পরানো হয়েছে, এবং বাচ্চাদেরকে ফুল-প্যান্ট পরানো হয়েছে। যদিও মাদ্রাসার বইয়ের অধিকাংশ ছবিতে টুপি আর ওড়না পরানো হয়নি। প্রথমে কয়েকটি ছবিতে টুপি ও ওড়না পরানোর পর হয়তো তারা মনে করেছে, বাকি ছবিগুলো স্কুলের মতোই থাকুক; হুজুররা এতো খেয়াল করবেন না।
৩) স্কুলের মতো মাদ্রাসাতেও ছেলে মেয়ে একসাথে খেলা ধুলা করার জন্যে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। বইয়ের ৩ নং পৃষ্ঠায় দেখানো হয়েছে ছেলে-মেয়ে একসাথে কানামাছি খেলছে। অর্থাৎ, ছেলেরা মেয়েদেরকে ছুঁয়ে দিবে, আবার মেয়েরা ছেলেদেরকে ছুঁয়ে দিবে। অবশ্য ছেলেদের মাথায় এখানে টুপি দেয়া হয়েছে, এবং মেয়েদের মাথায় হিজাবও আছে। সম্ভবত, টুপি পরা ছেলেরা হিজাব পরা মেয়েদের ছুঁয়ে দিলে ধর্মীয় কোনো সমস্যা নেই। এরপর ৫০ পৃষ্ঠায় একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে ছেলে-মেয়ে একসাথে ফুটবল খেলছে। ছবির পাশেই লেখা আছে – “ছেলে মেয়ে, খেলা করে”। আমি জানি না পৃথিবীর কোথায় ছেলে-মেয়ে একসাথে ফুটবল খেলে, কিন্তু মাদ্রাসার বইয়ে দেখি ছেলে-মেয়ে একসাথে খুব সুন্দরভাবেই ফুটবল খেলতে পারে।
৪) আলীয়া মাদ্রাসার ছেলেরা টুপি ছাড়া ক্লাস করে কিনা আমি জানি না, কিন্তু বইয়ের ৩ নং পৃষ্ঠায় দেখানো হয়েছে ছেলেরা টুপি ছাড়া এবং দুইটা মেয়ে ওড়না ছাড়া ক্লাস করছে। তাও সমস্যা ছিলো না, যদি ছেলে-মেয়েদের নামগুলো একটু ইসলামী ভাবধারার হতো। মাদ্রাসায় ক্লাস করতে আসা একটা ছেলের নাম উমং, আরেকটা ছেলের নাম ঔছন, আর একটা মেয়ের নাম ঋতু। পৃথিবীর কোথাও মুসলমান ছেলেদের এমন নাম আছে কিনা আল্লাহু আলাম। হতে পারে হিন্দু-খ্রিস্টানরাও এখন মাদ্রাসায় পড়ে।
৫) স্কুলের বইয়ের ১৪ নং পৃষ্ঠায় অর্ধ-উলঙ্গ একজন হিন্দু ঋষির ছবি দেয়া হয়েছে, আর মাদ্রাসার বইয়ে হিন্দু ঋষির ছবির পরিবর্তন করে দাড়ি-টুপি ওয়ালা একজন বৃদ্ধের ছবি দেয়া হয়েছে। অন্তত এই দুইটা ছবি দেখে যে কেউ অনুমান করতে পারবেন যে, স্কুলের বইটা হিন্দুদের জন্যে লিখা, আর মাদ্রাসার বইটা মুসলমানদের জন্যে লিখা। অবশ্য মাদ্রাসার বইটির ৫১ পৃষ্ঠায় দেখানো হয়েছে যে, মাদ্রাসার ছেলে-মেয়েরাও মেলায় গিয়ে মানুষের মূর্তি কিনে।
৬) ইসলামে বাদ্য যন্ত্র বা ঢোল-তবলাকে হারাম বলেছেন অনেকেই। কিন্তু মাদ্রাসার ১ম শ্রেণীর বাংলা বইয়ের ২৪ নং পৃষ্ঠায় দেখানো হয়েছে একটা ছেলে ঢোল-তবলা বাজিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, আর পিছন থেকে একটা মেয়ে তাকে ফুল দেয়ার জন্যে হেঁটে আসছে। এরপর ৫২ পৃষ্ঠায়ও বাদ্যযন্ত্রের দুটি ছবি রয়েছে। একটিতে ছবিতে একটি মেয়ে খাচ্ছে পাশেই একটা ঢোল। অন্য ছবিতে একটা ছেলে সেই ঢোলটা বাজাচ্ছে। মনে হচ্ছে মাদ্রাসার ছেলে-মেয়েদেরকে ‘আধুনিক’ হবার জন্যে ঢোল-তবলা শেখানোর কোনো বিকল্প নেই।
৭) সবচেয়ে বেশি মজা পাবেন বইয়ের ৩৬ নং পৃষ্ঠায় আসলে। স্কুলের বইয়ে একটা মেলার ছবি দিয়ে বলা হয়েছে – “উৎসব মাঝে, সং সাজে” । কিন্তু মাদ্রাসার বইয়ে একটা ঈদের ছবি দিয়ে বলা হয়েছে – “উৎসব মাঝে, সং সাজে”। আমার জীবনে আমি কখনো দেখিনি, ঈদের অনুষ্ঠানে কেউ সং সেজে যায়। অথচ, এই অদ্ভুত বিষয়টাও মাদ্রাসার প্রথম শ্রেণির বাচ্চাদের শেখানো হচ্ছে।