শয়তান নয়, আমরাই আমাদেরকে বিপদে ফেলি

মুসলিমদের কোনো ক্ষতি, ভুল বা অন্যায় হলে আমরা অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা নির্দোষ সাজার চেষ্টা করি। যেমন, মুসলিম সভ্যতার কোনো অধঃপতন হলে আমরা বলি এটা দাজ্জালের কারণে হয়েছে। মুসলিম দেশে কোনো যুদ্ধ হলে আমরা বলি এটা ইজরাইল-ইউরোপ-আমেরিকার কারণে হয়েছে। ব্যক্তি মুসলিম কোনো অন্যায় করলে আমরা বলি এটা শয়তানের কারণে হয়েছে। অর্থাৎ, মুসলিমদের যে কোনো ভুলের জন্যে আমরা অন্যের উপর দায় চাপিয়ে দিয়ে নিজেদেরকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করি।

অথচ, পৃথিবীর ইতিহাসে মুসলিমরা সব সময় নিজেদের ভুলের দায় স্বীকার করে নিয়েছিলো। কখনো নিজেদের ক্ষতি, ভুল বা অন্যায়ের জন্যে দাজ্জাল বা শয়তানের উপর দোষ চাপিয়ে দেয়নি।

পৃথিবীতে যে কোনো ক্ষতি হোক, ভুল হোক বা অন্যায় হোক, তা দাজ্জাল বা শয়তানের কারণে হয় না। বরং মানুষের নিজের কারণেই হয়।

যেমন,

১। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম মানুষ হত্যার যে ঘটনাটি ঘটেছিলো, অর্থাৎ, কাবিল যে হাবিলকে হত্যা করেছিলো, তা ইবলিশ বা দাজ্জালের কারণে করেনি। বরং নিজের নফসের কারণেই সে ভ্রাতৃহত্যায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলো।

কোর’আনে এসেছে –

فَطَوَّعَتْ لَهُ نَفْسُهُ قَتْلَ أَخِيهِ فَقَتَلَهُ فَأَصْبَحَ مِنَ الْخَاسِرِينَ

“অতঃপর তার নফস তাকে ভ্রাতৃহত্যায় উদ্বুদ্ধ করল। ফলে সে তাকে হত্যা করল। তাই সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।”[সূরা ৫/মায়িদা – ৩০]

অর্থাৎ, ইবলিশ বা দাজ্জালের কারণে নয়, বরং কাবিল তার নিজের নফসের কারণেই হাবিলকে হত্যা করেছিলো।

২। বনী ইসরাইলের মধ্যে প্রথম যে ব্যক্তিটি গরুর মূর্তি তৈরি করে, সবাইকে নিয়ে পূজা করতে শুরু করেছিলো, সে ইবলিস বা দাজ্জালের কারণে তা করেনি। বরং নিজের নফসের কারণেই শিরক করেছিলো।

কোর’আনে এসেছে –

قَالَ بَصُرْتُ بِمَا لَمْ يَبْصُرُوا بِهِ فَقَبَضْتُ قَبْضَةً مِّنْ أَثَرِ الرَّسُولِ فَنَبَذْتُهَا وَكَذَٰلِكَ سَوَّلَتْ لِي نَفْسِي

“সে বলল: আমি যা দেখলাম তা অন্যেরা দেখেনি। অতঃপর আমি সেই প্রেরিত ব্যক্তির পদচিহ্ন থেকে একমুষ্টি মাটি নিয়ে নিলাম। অতঃপর আমি তা নিক্ষেপ করলাম। এভাবেই আমার নফস আমাকে এই মন্ত্রণা দিয়েছিলো।” [সূরা ২০/ তাহা – ৯৬]

অর্থাৎ, সামেরী ইবলিশ বা দাজ্জালের কারণে নয়, বরং তার নিজের নফসের কারণেই মূর্তি পূজা শুরু করেছিলো।

৩। ইউসুফ (আ)-এর সাথে যে নারীটি অবৈধ সম্পর্ক করতে করতে চেয়েছিলো, তা সে ইবলিশ বা দাজ্জালের কারণে করেনি। বরং তার নিজের নফসের কারণেই করেছিলো।

কোর’আনে এসেছে, ঐ নারীটি বলছে –

وَمَا أُبَرِّئُ نَفْسِي ۚ إِنَّ النَّفْسَ لَأَمَّارَةٌ بِالسُّوءِ إِلَّا مَا رَحِمَ رَبِّي ۚ إِنَّ رَبِّي غَفُورٌ رَّحِيمٌ

“আমি নিজেকে নির্দেশ মনে করি না। নিশ্চয় মানুষের নফস মন্দ কর্ম-প্রবণ। কিন্তু সে নয়, আমার পালনকর্তা যার প্রতি অনুগ্রহ করেন। নিশ্চয় আমার পালনকর্তা ক্ষমাশীল, দয়ালু।”[সূরা ১২/ ইউসুফ – ৫৩]

অর্থাৎ, আজিজের স্ত্রী জোলেখা ইবলিশ বা দাজ্জালের কারণে নয়, বরং তার নিজের নফসের কারণেই জিনা করার চেষ্টা করেছিলো।

আমাদের অনেকেই মুসলিমদের বিভিন্ন সমস্যার কারণে দাজ্জালকে ও শয়তানকে দোষ দেয়। অবশ্যই শয়তান ভালো কেউ নয়। কিন্তু, আমাদের ক্ষতি এবং আমাদের দোষের জন্যে শয়তান বা অন্য কাউকে দোষ দেয়া ঠিক নয়।

ইমাম আবু হানিফা বলেন,

لا يجوز أن نقول : إن الشيطان يسلب الإيمان من العبد المؤمن قهرا و جبرا، ولكن نقول : العبد يع الإيمان يتد يلهمه الشيطان

“আমাদের জন্যে এ কথা বলা জায়েজ নেই যে, “শয়তান জোর-যবরদস্ত করে মুমিন বান্দার ঈমান নিয়ে গেছে।” বরং আমরা এভাবে বলতে পারি যে, “বান্দা যখন ঈমান ত্যাগ করে, তখন শয়তান তা নিয়ে যায়”। [ফিকহুল আকবর]

অর্থাৎ, আমরা নিজেরা নিজেদের নফসের কারণে যখন কোনো অন্যায় করি, তখন শয়তান সে সুযোগটা নেয়। একইভাবে, মুসলিম বিশ্ব নিজেরা যখন নিজেদের ক্ষতি করতে শুরু করে, তখন ইউরোপ-আমেরিকা সে সুযোগটা নেয়।

কেবল শয়তান, দাজ্জাল, ইউরোপ, আমেরিকা, ইজরাইলের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে না দিয়ে, আমাদের নিজেদের আত্ম-সমালোচনা করা প্রয়োজন।

আরো পোস্ট