নারী দিবসের লেখা – ২৫

অনেকে অভিযোগ করে বলেন, সূরা বাকারার ২৮২ নং আয়াত এবং সূরা নিসার ১১, ৩৪, ১৭৬ নং আয়াতে নারী ও পুরুষের মাঝে বৈষম্য করা হয়েছে।

দেখুন, কোর’আনের যতগুলো আয়াতে নারী ও পুরুষের মাঝে বৈষম্য রয়েছে বলে দাবী করা হয়, সবগুলো আয়াত-ই সম্পদ সম্পর্কিত।

সুতরাং, ইসলামে সম্পদের ধারণা কি তা ভালোভাবে না বুঝলে এই আয়াতগুলোর অর্থ বোঝা মুশকিল।

পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা পৃথিবীতে নিজেদের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেছে। পৃথিবীকে যে যতটুকু দখল করতে পারে, সে ততবড় ধনী। আর যে পৃথিবীকে দখল করতে পারে না, সে গরিব। মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীরা পৃথিবীকে কখনো স্থায়ীভাবে ভাগাভাগি করে না। ফলে তাদের মাঝে কেউ ধনী বা কেউ গরিব নেই।

আল্লাহ তায়ালা মানুষকে বলেছেন পাখীদের থেকে শিক্ষা নিতে। রাসূল (স) পাখিদের মত রিজিকের সন্ধান করতে বলেছেন। কারণ, পাখিরা পৃথিবীকে দখল করে রাখে না, এবং পৃথিবীতে মালিকানা প্রতিষ্ঠা করে না। পাখীরা সকালে খালি পেটে বের হয়, এবং সন্ধ্যায় ভরা পেটে ফিরে আসে। মানুষ যদি পৃথিবীতে নিজেদের মালিকানা প্রতিষ্ঠা না করে, পাখিদের মত কেবল আল্লাহর উপর-ই তাওয়াককুল করতে পারে, তাহলে মানুষেরাও পাখিদের মত স্বাধীন ও সুখী হতে পারে। সুখী হবার মূল মন্ত্র এটাই, সম্পদ নয়।

পৃথিবীতে মানুষে মানুষে যত বৈষম্য, সব সম্পদের কারণে সৃষ্টি হয়েছে। তাই, আল্লাহ তায়ালা সম্পদ দিয়ে মানুষকে বিচার করেন না। বরং অন্যান্য প্রাণীদের মত মানুষের সৎকাজের ভিত্তিতে আল্লাহ মানুষকে মূল্যায়ন করেন। ইসলামেও মানুষকে মূল্যায়ন করার মানদণ্ড সম্পদ নয়, বরং সৎকাজ।

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মর্যাদাবান মানুষেরা বা নবী রাসূলদের অধিকাংশ-ই ছিলেন গরিব। ইসলাম গ্রহণ করার পর আবু বকর (রা), উমর (রা), উসমান (রা) ও খাদিজা (রা) সহ অসংখ্য সাহাবী ধনী থেকে গরিব হয়েছেন। কিন্তু তাঁদের সম্মান বেড়ে গিয়েছিল, এবং তাঁরা সবাই জিরো থেকে হিরো হয়ে গিয়েছিলেন। সম্মান বেড়েছে তাঁদের সৎকাজের ভিত্তিতে, সম্পদের ভিত্তিতে নয়।

ইসলামে সম্পদ ও মর্যাদা দুটি বিষয় অনেকটা পরস্পর বিরোধী। কিন্তু বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে, সম্মান মানে সম্পদ, আর সম্মান মানে সম্পদ।

কোর’আনে সম্পদের ভালোবাসাকে খুবই নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়। ইসলামে সম্পদের প্রতি ভালোবাসাকে শিরক বলা হয়। কারণ, সম্পদ পৃথিবীতে একটি কৃত্রিম মায়াজাল সৃষ্টি করে, এটি মানুষের ক্ষতি ডেকে আনে, এবং মানুষকে কুফরির দিকে নিয়ে যায়।

আল্লাহ তায়ালা বলেন –

اعْلَمُوا أَنَّمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا لَعِبٌ وَلَهْوٌ وَزِينَةٌ وَتَفَاخُرٌ بَيْنَكُمْ وَتَكَاثُرٌ فِي الْأَمْوَالِ وَالْأَوْلَادِ كَمَثَلِ غَيْثٍ أَعْجَبَ الْكُفَّارَ نَبَاتُهُ ثُمَّ يَهِيجُ فَتَرَاهُ مُصْفَرًّا ثُمَّ يَكُونُ حُطَامًا وَفِي الْآخِرَةِ عَذَابٌ شَدِيدٌ وَمَغْفِرَةٌ مِّنَ اللَّهِ وَرِضْوَانٌ وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ

“তোমরা জেনে রাখ, পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক, সাজ-সজ্জা, পারস্পরিক অহমিকা এবং ধন-সম্পদ ও সন্তানসন্ততির প্রাচুর্য ব্যতীত আর কিছু নয়। এর উদাহরণ একপশলা বৃষ্টির মত। (বৃষ্টির কারণে) সবুজ ফসল কৃষকদেরকে চমৎকৃত করে। কিন্তু এরপর তা শুকিয়ে যায়, ফলে তুমি তাকে পীতবর্ণ দেখতে পাও, এরপর তা খড়কুটা হয়ে যায়। আর পরকালে আছে কঠিন শাস্তি এবং আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। পার্থিব জীবন প্রতারণার উপকরণ ছাড়া আর কিছু নয়”। [সূরা ৫৭/হাদীদ – ২০]

অন্য আয়াতে বলেন –

وَاعْلَمُوا أَنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ وَأَنَّ اللَّهَ عِندَهُ أَجْرٌ عَظِيمٌ

জেনে রাখ, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি অকল্যাণের সম্মুখীনকারী। বস্তুত: আল্লাহর নিকট রয়েছে মহাপুরস্কার। [সূরা ৮/আনফাল – ২৮]

এ ধরণের অনেকগুলো আয়াতে, আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর ধন-সম্পদকে একটি অস্থায়ী ও ক্ষতিকর মানদণ্ড হিসাবে উল্লেখ করেছেন। ইসলামের প্রকৃত, উন্নত ও একমাত্র মানদণ্ড হলো মানুষের সৎকাজ। আর, সৎকাজের ভিত্তিতে নারী-পুরুষের মাঝে কোনো বৈষম্য নেই। কোর’আনের যেসব আয়াতে, আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, নারী ও পুরুষের মাঝে যে বৈষম্য আছে, তা আসলে বস্তুবাদী, অস্থায়ী ও ক্ষতিকর সম্পদের মানদণ্ডে মানুষকে মূল্যায়ন করার ফলে সৃষ্টি হয়েছে।

সম্পদের ভিত্তিতে মানুষকে মূল্যায়ন করলে, কেবল নারী ও পুরুষ নয়, পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের মাঝে বৈষম্য সৃষ্টি হবে। পৃথিবীতে এমন দুইজন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যাদের সকল সম্পত্তি সমানে সমান। আপনি যে বাড়ীর মালিক, পৃথিবীর আর কেউই সেই বাড়ির মালিক নয়। সুতরাং, সম্পদের মানদণ্ডে কারো মর্যাদা নির্ণয় করাটা একটি কৃত্রিম পদ্ধতি।

কোর’আনে মানুষের মর্যাদা নির্ণয়ের মানদণ্ড হিসাবে সম্পদকে যেহেতু গণ্য করা হয় না, তাই সম্পদ কম বা বেশির কারণে নারী ও পুরুষের মাঝে কোনো বৈষম্য তৈরি হয় না। কিন্তু, বস্তুবাদীদের কাছে সম্পদ-ই হলো মানুষকে মূল্যায়ন করার একমাত্র মানদণ্ড। এ কারণে, বস্তুবাদীরা ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে এসে বলেন, ইসলাম নারী ও পুরুষের মাঝে বৈষম্য সৃষ্টি করেছে।

কেবল ধর্ম বিদ্বেষীরা নয়, যারাই বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ইসলামকে দেখে, তারাই বলেন – “ইসলাম নারী ও পুরুষের মাঝে বৈষম্য সৃষ্টি করেছে”।

1 মে, 2017, 7:58 PM

আরো পোস্ট