নারী দিবসের লেখা – ১৭
ছোট বেলায় কোনো দুষ্টুমি করলে, দাদী ডাক দিয়ে বলতেন – “খবরদার! তোর দাদা দেখলে কিন্তু বকা দিবে!”
অথবা, আম্মু বলতেন, – “সাবধান! তোর আব্বু দেখলে কিন্তু খবর আছে!”
আমাদের দাদীরা সবসময় দাদাদের ভয় দেখাতেন, আর মায়েরা সবসময় বাবাদের ভয় দেখাতেন।
কিন্তু, বর্তমানে শিশুদেরকে এখন আর বাবা-দাদাদেরর ভয় দেখানো হয় না। তাদেরকে বরং কাল্পনিক ভুত, বাঘ, ভল্লুক, সিংহ, পেঁচা এসবের ভয় দেখানো হয়।
তাতে ক্ষতি কি হয়?
১। শিশুরা তাদের বাবা-মাকে শ্রদ্ধা ও ভয় করতে শিখে না।
২। শিশুরা বাবাকে ভালো মনে করে, কিন্তু মাকে হিংস্র মনে করে।
৩। শিশুরা মনে করে তাদের মা মিথ্যা কথা বলে। কারণ, শিশুরা অন্যায় করে ফেললেও বাঘ ও ভল্লুক কখনো তাদেরকে খেতে আসে না।
প্রশ্ন হলো, আধুনিক নারীরা শিশুদেরকে পুরুষদের ভয় না দেখিয়ে বাঘ-ভল্লুকের ভয় দেখায় কেন?
নারীবাদীরা ভাবেন, আমি যদি বাচ্চাকে তার বাবার ভয় দেখাই, তার মানে হলো, ‘বাচ্চার বাবার চেয়ে আমার গুরুত্ব কম’। তাই তারা সন্তানের সামনে তাদের বাবাকে ততটা গুরুত্ব দেন না, এবং তাদেরকে তাদের বাবার ভয় না দেখিয়ে বাঘ-ভল্লুকের ভয় দেখান।
দেখুন,
পৃথিবীতে কোনো সন্তান জন্ম লাভ করার ক্ষেত্রে বাবার অবদান ১% হলে মায়ের অবদান ৯৯%। ফলে, শিশুরা তার বাবা থেকে যদি ১০% শিখে, তাহলে তার মায়ের কাছ থেকে শিখে ৯০%।
কোনো পরিবারের পুরুষ যদি নারীকে গুরুত্ব প্রদান করে, তাহলে সন্তানেরা তাদের বাবা-মাকে ১০% গুরুত্ব প্রদান করতে শিখবে। কিন্তু সেই পরিবারের নারী যদি পুরুষকে গুরুত্ব প্রদান করে, তাহলে তাদের সন্তানেরা বাবা-মাকে ৯০% গুরুত্ব প্রদান করতে শিখবে। যদি নারী ও পুরুষ উভয়ে উভয়কে শ্রদ্ধা, সম্মান ও গুরুত্ব প্রদান করে, তাহলে সন্তানেরা তাদের বাবা-মাকে ১০০% শ্রদ্ধা, সম্মান ও গুরুত্ব প্রদান করবে। যদি কেউ কাউকে শ্রদ্ধা, সম্মান ও গুরুত্ব প্রদান না করে, তাহলে তাদের সন্তানেরা বাবা-মাকে ০.০০% শ্রদ্ধা, সম্মান ও গুরুত্বও প্রদান করবে না।
আমরা প্রায়ই বলি, আজকাল সন্তানেরা তাদের বাবা-মাকে শ্রদ্ধা, সম্মান ও গুরুত্ব প্রদান করেন না। দেখুন, বাবা-মা যদি বাকশক্তিহীন হয়, তাহলে তাদের সন্তানেরাও বোবা হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। বাবা ও মা যদি পরস্পরকে শ্রদ্ধা না করে, পরস্পরকে সম্মান ও গুরুত্ব না দেয়, তাহলে সন্তানেরা বাবা-মাকে শ্রদ্ধা, সম্মান, গুরুত্ব প্রদান করতে শিখবে কোত্থেকে?
আমার এক নারী আত্মীয়া আছেন। তিনি তাঁর পুরুষ সঙ্গীকে [ধরুন] “রহিম” নাম ধরে ডাকে। তাদের ছেলে হওয়ার পর ঐ ছেলেও তার বাবাকে “রহিম” নামে ডাকতে শুরু করলো। প্রথম প্রথম আমাদের সবার কাছেই শুনতে ভালো লাগত। কিন্তু বড় হওয়ার পর আজো সেই ছেলে তার বাবাকে “বাবা” বা “আব্বু” বলে ডাকছে না। ফলে, বাবা ও ছেলের মাঝে একটি অনিবার্য দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে।
সন্তান তার মায়ের কাছ থেকেই সবকিছু শিখে। মা যদি সন্তানের বাবাকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করেন, তাহলে সন্তান বাবা-মা উভয়কে শ্রদ্ধা ও সম্মান করতে শিখে।
তো,
আম্মু যখন আমাদেরকে আব্বুর ভয় দেখাতেন, তখন আব্বুকে কিছুটা কঠোর মনে হলেও, আম্মুকে খুবই দয়ালু মনে হত। আব্বু কখনো মারতে শুরু করলে আম্মু এসে বলতেন, “যথেষ্ট হয়েছে, আর মারার দরকার নেই”। দাদী এসে আব্বুকে বকা দিতেন।
–এই যে বাবাদের কঠোরতার বিপরীতে মায়েদের ভালোবাসা ও দয়া প্রদর্শন, এতে সন্তানদের আচরণে একটি ভারসাম্য তৈরি হয়। কিন্তু কোনো সংসারে মা যদি বাবার চেয়ে বেশি কঠোর হন, তাহলে সন্তানেরা মায়েদেরকে ভালোবাসার পরিবর্তে ভয় করতে শুরু করে, এবং আস্তে আস্তে মায়েদের থেকে দূরে সরে যায়।
কোনো পরিবারে মায়ের কঠোরতা বা কর্তৃত্ব বেশি থাকলে, সন্তানেরা মায়েদের থেকে যে ৯০% শেখার কথা ছিল, তা আর ভালোভাবে শিখতে পারে না। ফলে সে পরিবারের সন্তানেরা অপূর্ণ ও অসুস্থ মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠে। বাবার ভয় ও মায়ের ভালোবাসা যদি কোনো সন্তান উপলব্ধি করতে না পারে, তাহলে সে পরিবারে অনিবার্যভাবে অসংখ্য সমস্যা সৃষ্টি হতে থাকে।
যেমন,
নারীরা যদি সন্তানদেরকে পুরুষদের ভয় না দেখান, তাহলে শাসন করার জন্যে তাদের নিজেদেরকেই কঠোর হতে হয়। কিন্তু, নারীরা যখন কঠোর হয়, তখন তাদের সন্তানেরা নিজের অজান্তেই তাদের মাকে ঘৃণা ও অশ্রদ্ধা করতে শুরু করে। কারণ, শিশুদের মনে ভয় ও ভালোবাসা একসাথে থাকে না।
এ কারণেই, পশ্চিমা বিশ্বের অধিকাংশ সন্তানেরা তাদের বাবা-মাকে শ্রদ্ধা, সম্মান ও গুরুত্ব প্রদান করে না। তারা বাবা-মাকে ভালোবাসার জন্যে বছরে একদিন “মা দিবস” ও একদিন “বাবা দিবস” চালু করেছে।
এই যে ১৪ মে নাকি “মা দিবস”।
আমার কাছে বছরের ৩৬৫ দিন-ই মা দিবস। বিশ্বের যেখানে বা যে অবস্থায় থাকি না কেন, বছরের ৩৬৫ দিন-ই আম্মুর সাথে কথা বলি, আলহামদুলিল্লাহ।এর কারণ হলো, আমাদের পরিবারে কোনো নারীবাদ ছিল না, ছিল – “আব্বুর ভয় ও আম্মুর ভালোবাসা”।
12 মে, 2017, 7:19 PM