ধন-সম্পদ, বংশমর্যাদা ও ক্ষমতা সাধারণত চার পুরুষ পর্যন্ত স্থায়ী হয়

//এক পুরুষে করে ধন, এক পুরুষে খায়// আর এক পুরুষ এসে দেখে খাওয়ার কিছু নাই// আমার তিন পুরুষ//

উপরোক্ত গানের সাথে ইবনে খালদুনের একটি থিউরির মিল রয়েছে। পার্থক্য হলো, গায়ক আইয়ুব বাচ্চু বলেছেন, তিন পুরুষ; কিন্তু ইবনে খালদুন বলেছেন, চার পুরুষ।

ইবনে খালদুনের মতে, কোনো একটি গোষ্ঠীর ধন-সম্পদ, বংশমর্যাদা ও ক্ষমতা সাধারণত চার পুরুষ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। তবে, কখনো কখনো তৃতীয় পুরুষের কাছে এসেই ধন-সম্পদ ও ক্ষমতা শেষ হয়ে যায়, আবার কখনো কখনো, পঞ্চম পুরুষের কাছে গিয়ে ধন-সম্পদ ও ক্ষমতা শেষ হয়ে যায়।

ইবনে খালদুন বলেন –

إن نهايته في أربعة آباء و ذلك أن باني المجد عالم يما عاناه في بنائه و محافظ على الخلال التي هي أسباب كونه و بقائه و ابنه من بعده مباشر لأبيه فقد سمع منه ذلك و أخذه عنه إلا أنه مقصر في ذلك تقصير السامع بالشيء عن المعاني له ثم إذا جاء الثالث كان حظه الاقتفاء و التقليد خاصة فقصر عن الثاني تقصير المقلد عن المجتهد ثم إذا جاء الرابع قصر عن طريقتيهم جملة و أضاع الخلال الحافظة لبناء مجدهم و احتقرها و توهم

অর্থাৎ,

[ নিশ্চয় চার পুরুষের মধ্যেই (ধন-সম্পদ, বংশমর্যাদা ও ক্ষমতা) শেষ হয়ে যায়। এর কারণ হলো, (প্রথম পুরুষ ধন-সম্পদ, মর্যাদা ও ক্ষমতা অর্জন করেন করেন)। তাই প্রথম পুরুষ জানেন, কিভাবে এবং কিসের মাধ্যমে ধন-সম্পদ ও ক্ষমতা অর্জন করা যায়। ফলে, তিনি ধন-সম্পদ, মর্যাদা ও ক্ষমতা অর্জনের কারণগুলো ভালোভাবে পালন করেন এবং সংরক্ষণ করেন।

প্রথম পুরুষের সন্তান বা দ্বিতীয় পুরুষ এসে প্রথম পুরুষের উত্তরাধিকারী হয়, এবং প্রথম পুরুষ থেকে কিছু কৌশল শিখে নেয়, যাতে পিতার অর্জিত ধন-সম্পদ, মর্যাদা ও ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখা যায়। কিন্তু এতে কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়। কারণ, কোনো কিছু নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে দেখা এবং অন্যের থেকে শুনা, এ দুয়ের মাঝে পার্থক্য রয়েছে।

এরপর, তৃতীয় পুরুষ এসে দ্বিতীয় পুরুষ বা তাঁর বাবা-মাকে অন্ধ অনুকরণ করতে থাকে। ফলে, ধন-সম্পদ, মর্যাদা ও ক্ষমতা অর্জনের আসল হাকিকত বুঝতে পারে না। ফলে, দাদা-নানাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, মর্যাদা ও ক্ষমতা নাতি এসে হারাতে শুরু করে।

তারপর, চতুর্থ পুরুষ এসে প্রথম পুরুষের ধন-সম্পদ, মর্যাদা ও ক্ষমতাকে একেবারেই নিঃশেষ করে দেয়। ]

ইবনে খালদুনের উপরোক্ত থিউরির ভিত্তিতে এবার দুটি উদাহরণ দেখুন।

উদাহরণ – ১

১৯৭১ সালে লক্ষলক্ষ মানুষ যুদ্ধ করে বাংলাদেশকে অর্জন করেছেন। যারা যুদ্ধ করেছিলেন, তারা ছিলেন প্রথম পুরুষ। প্রথম পুরুষ যুদ্ধ করেছিলেন যাতে বাংলার মানুষ সমান অধিকার পায়, এবং সরকারী চাকরিতে যেন বাংলার মানুষ বৈষম্যের স্বীকার না হয়।

এরপর, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান বা দ্বিতীয় প্রজন্ম এসে তাদের বাবাদের থেকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে লাগলো, এবং বিভিন্ন সরকারী চাকরিতে ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটা’র মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ফল ভোগ করতে লাগলো। অথচ, তারা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক চেতনা ধরতে পারেনি। ফলে, যেই চেতনার মাধ্যমে বাংলার মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করেছিলো, সেই চেতনার মাঝে ফাটল ধরতে শুরু করলো।

তারপর, মুক্তিযোদ্ধাদের নাতী বা তৃতীয় প্রজন্ম এসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অন্ধভাবে অনুকরণ করতে লাগলো, এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনাশ হতে শুরু করলো। ফলে, দেশের মানুষ আবার সংঘবদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধ কোটা ও চেতনার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলো।

আর কিছুদিন পর, অর্থাৎ, চতুর্থ পুরুষের সময়ে, ইবনে খালদুনের তত্ত্ব অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে আর কিছু থাকবে না।

উদাহরণ – ২

শেখ মুজিব ছিলেন প্রথম পুরুষ, তিনি ও তাঁর বন্ধুরা মিলে আওয়ামী লীগ গড়েছেন। শেখ হাসিনা সেই আওয়ামী লীগের নাম বিক্রি করে খাচ্ছেন। এরপর, সজীব ওয়াজেদ জয় বা তৃতীয় পুরুষের কেউ কেউ এসে হয়তো আওয়ামী লীগের নাম-গন্ধ খুঁজে পাবেন। কিন্তু, চতুর্থ পুরুষ এসে আওয়ামী লীগের কোনো অস্তিত্ব-ই পাবেন না। এটাই ইবনে খালদুনের চার পুরুষের তত্ত্ব।

আর, এ কারণেই আইয়ুব বাচ্চু গেয়েছেন – //এক পুরুষে করে ধন, এক পুরুষে খায়// আর এক পুরুষ এসে দেখে খাওয়ার কিছু নাই// আমার তিন পুরুষ//

23 September 2018 at 19:31 

আরো পোস্ট