পাগলামি চর্চায় ‘সার্টিফিকেটের’ অবদান

সার্টিফিকেট’ নিয়ে আমাদের দেশে যে ধরনের রঙ্গ প্রদর্শন হয়, তাকে এক ধরণের পাগলামি বলা চলে। ব্যক্তির যোগ্যতার চেয়ে তার কাগুজে সার্টিফিকেটের মূল্য-ই এখানে প্রধান। ফলে ‘সার্টিফিকেট’ নিয়ে এ দেশে চলে নানাবিধ রাজনীতি, কোলাহল বা আন্দোলন; সহজ কথায় মাতলামি আর ধান্ধামি। নিরুপায় হলে আবেদন, আহাজারি আর ক্রন্দন।

কোনও জাতি যখন ‘সার্টিফিকেট’ নির্ভর হয়ে পড়ে তখন সেখানে অবশ্যই দুর্নীতির প্রবণতা দেখা দিবে। ইতোমধ্যে আমাদের দেশ বহুবার সে সাক্ষ্য-প্রমাণ রেখেছে। যোগ্যতা না থাকুক, নাগরিকদের কেউ যে কোনও উপায়ে কয়েকটি ‘সার্টিফিকেট’ জোগাড় করতে পারলেই হল। দেশে নিজেকে সম্মানিত নাগরিক ভাবা যায়, অহংকার প্রদর্শন করা যায় আর উদ্ধত হওয়া যায়। ফলে প্রাইমারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, ছাত্র-শিক্ষক থেকে শিক্ষা মন্ত্রী, সবাই সার্টিফিকেটের মান ধরে রাখার জন্যে, কিম্বা রেকর্ড গড়ার নিমিত্তে দুর্নীতির দুর্দান্ত প্রতিযোগিতায় নেমে পড়বেন, এটাই তো স্বাভাবিক।

স্বাধীনতা দিবসে রবি ঠাকুরের একটি কবিতা, জাতীয় সঙ্গীত, যার দশ লাইন উচ্চারণ করার বিনিময়ে অনেক কিছু পাওয়া গেছে;- বিভিন্ন কোম্পানির বিজ্ঞাপন যুক্ত খাবার, ক্যাপ, ব্যাগ, টি-শার্ট, পতাকা এবং চেতনার ‘সার্টিফিকেট’। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা অবশ্য বাড়তি আরও কিছু পেয়েছেন- সকালের নাস্তা, নগদ ৫০ টাকা এবং পরিবহন সুবিধা। তবে সব কিছুকে ছাড়িয়ে যে সোনার হরিণটা ধরার জন্যে সবাই উন্মাদ হয়ে পড়েছিল তা হল ‘চেতনার সার্টিফিকেট’। হলের এক ছোট ভাইয়ের কাছে শুনলাম, কোন এক বড় ভাই নাকি আর্মি অফিসারের কাছে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, ‘স্যার, আগামী পরশু আমার ভাইবা পরীক্ষা, প্লীজ… আমাকে একটা সার্টিফিকেট দিন’। কি চমৎকার দৃশ্য!!!

বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ভর্তি হলাম, দেখলাম, বন্ধুরা বিভিন্ন ‘সামাজিক’/‘কালচারাল’ সংগঠনে যুক্ত হচ্ছে, সদস্য হচ্ছে; বললাম, কেন? বলল, ‘সার্টিফিকেট দিবে! চাকরিতে কাজে লাগবে!’  কিছু কিছু বন্ধু তো আগ থেকেই বন্দুকের সন্তান, তাদের সার্টিফিকেট-চিন্তা ততটা নেই। কিন্তু বাকিদের অবস্থা চরম বেগতিক, তারা কোনও না কোনোভাবে এদিক-সেদিক থেকে চার-পাঁচটা সার্টিফিকেট জোগাড় করতে পারলে অন্তত জানে বাঁচে, কিছুটা হলেও চাকরির কারখানায় যাবার সাহস করে; সেক্ষেত্রে চেতনার একখানা ‘সার্টিফিকেট’ থাকলে তো আর কথাই নেই।

শুধু বস্তু-চিন্তার মানুষেরা এমন হলে আমাদের তেমন নাক গলানোর দরকার হত না, কিন্তু আধ্যাত্মিক-চিন্তার মানুষদেরও যখন দেখি ‘সার্টিফিকেট’ ধাঁধাঁয় ঘুরপাক খাচ্ছেন, তখন আসলেই খুব খারাপ লাগে। সম্প্রতি লক্ষ্য করলাম, ইসলামী শিক্ষা মূলক কিছু অনুষ্ঠানে বা প্রশিক্ষণে ‘সার্টিফিকেটের’ লোভ দেখানো হচ্ছে, প্রশিক্ষণের প্রচার-শিরনামে ‘সার্টিফিকেট কোর্স’ জাতীয় শব্দ যুক্ত হচ্ছে। জানি না, তাঁদের মাকাসিদ কি! 

একটি দেশের ‘শিক্ষিত’ মেয়ে-ছেলেরা যখন কাগজের বৌ আর কাগজের স্বামী হয়ে যায়, তখন দেশটাও কাগজের হয়ে যায়, যে কেউ যখন-তখন ইচ্ছা করলেই ছিঁড়ে ফেলতে পারে।

March 27, 2014 at 8:27 PM · 

আরো পোস্ট