ইসলামে এতো ভাগ কেন?
ইসলাম তো এক, তাহলে হানাফী, সালাফি, সুফি, মুতাজিলা, আশয়ারি, মাতুরিদি এতো ভাগ কেন?
প্রথমেই একটি হাসপাতাল কল্পনা করুন। হাসপাতালের রোগীর সংখ্যা যখন খুব কম ছিলো তখন একজন ডাক্তার দিয়েই সব রুগীকে চিকিৎসা দেয়া হতো। কিন্তু, রুগীর সংখ্যা যখন বাড়তে লাগলো, তখন হাসপাতালের ডাক্তারের সংখ্যাও বাড়াতে হলো। এরপর, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগের শ্রেণীবিন্যাস করতে শুরু করলো। নাক-কান-গলা বিভাগ, চক্ষু বিভাগ, গাইনি বিভাগ, শিশু বিভাগ, ডাইবেটিস বিভাগ, ডেন্টাল বিভাগ ও সার্জারি বিভাগ সহ আরো বিভিন্ন বিভাগ। এখানে সবগুলো বিভাগের উদ্দেশ্য একটাই, রোগীকে সুস্থ করা; কিন্তু, রুগী ও ডাক্তারের সংখ্যা বাড়ায় হাসপাতালকে রোগের শ্রেণীবিন্যাস করে বিভিন্ন বিভাগ গঠন করতে হয়েছে।
অথবা, একটি গাছ কল্পনা করুন। যে কোনো গাছ যখন জন্ম লাভ করে, তখন সে গাছের একটিমাত্র কাণ্ড থাকে। কিন্তু, সময়ের সাথে সাথে গাছটি যখন বড় হতে থাকে, তখন গাছের ডালপালা বাড়তে থাকে।
ঠিক তেমনি, হিজাজে যখন ইসলাম এসেছে, তখন হিজাজে মানুষের সংখ্যা খুবই কম ছিলো। যেমন, বদরের যুদ্ধে মুসলিমদের সংখ্যা ছিলো ৩১৩ জন, আর কুরাইশদের সংখ্যা ছিলো প্রায় ১০০০ জন। আশেপাশের রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যের তুলনায় হিজাজে লোকজন তখন খুবই কম ছিলো। অন্যদিকে, হিজাজের মানুষ রোমান, গ্রিক বা পারস্য সভ্যতার তুলনায় খুবই জাহেল বা মূর্খ ছিলো। হিজাজের লোকজন লেখাপড়া করতে জানতেন না, এমনকি হিসাব করতেও পারতেন না। হিজাজের মানুষদের দু’একজন ভালো কবিতা আবৃতি করতে পারলেও ভালো যুক্তিবিদ্যা বা শিল্পকলা হিজাজে ছিলো না।
যেমনটা রাসূল (স) বলেছেন –
إِنَّا أُمَّةٌ أُمِّيَّةٌ، لاَ نَكْتُبُ وَلاَ نَحْسُبُ، الشَّهْرُ هَكَذَا وَهَكَذَا
[صحيح البخاري 3/ 28]
“আমরা অজ্ঞ জাতী। আমরা লিখতে জানি না, এবং হিসাব করতেও জানি না। এক মাস সমান এই এই এই।” [বুখারী – ১৯১৩]
যেহেতু হিজাজের মানুষ সংখ্যা বা হিসাব জানতেন না, তাই রাসূল (স) হাতের দশ আঙ্গুলকে তিনবার দেখিয়ে বলেছেন যে, এক মাস সমান ২৯ বা ৩০ দিন।
এখানে একটি প্রশ্নের উত্তর জেনে নেয়া প্রয়োজন, কেন ইসলাম একটি জাহেল বা মূর্খ জাতীর কাছে আসলো? উত্তরটা খুব সহজ। যদি রোমান, গ্রিক বা পারস্য সাম্রাজ্যে ইসলাম আগমন করতো, তাহলে পরবর্তী যুগের মানুষরা বলতো, রাসূল (স) একটি প্রতিষ্ঠিত সভ্যতায় জন্মগ্রহণ করেছেন বলে ইসলামের এতো প্রচার ও প্রসার করতে পেরেছেন। রাসূল যদি আমাদের মতো মূর্খ সমাজে আসতেন, তাহলে কিছুই করতে পারতেন না। এই অভিযোগ থেকে দূরে থাকার জন্যেই আল্লাহ তায়ালা রাসূল (স)-কে পৃথিবীর সবচেয়ে জাহেল ও মূর্খ সমাজে একজন শিক্ষক হিসাবে পাঠিয়েছেন।
যাই হোক, মূল কথায় আসি। হিজাজের মূর্খ জনগণকে যখন রাসূল (স) শিক্ষা দিতে লাগলেন, তখন তারা আলিফ-বা-তা শিখতে লাগলেন মাত্র। তখনো মুসলিমরা ছিলেন প্রাথমিক ক্লাসের ছাত্র। রাসূল (স) সম্পূর্ণ সিলেবাস জনগণকে জানিয়ে মৃত্যু বরণ করলেও জনগণ তখনো জ্ঞানের শাখা বা বিভাগ খোলার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেননি।
রাসূলের পর সাহাবীরা যখন বিভিন্ন সভ্যতা ও সাম্রাজ্য জয় করতে শুরু করলেন, তখন হিজাজের লোকদের সাথে পারস্য, গ্রিক বা রোমান সভ্যতার একাডেমিক ডিবেট শুরু হলো। অন্য সভ্যতার বুদ্ধিজীবীদের সাথে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্যে তখন কালাম বা ধর্মীয় যুক্তিবিদ্যার বিভাগ খুলতে হয়েছে। এভাবে মুসলিমদের সংখ্যা যত বাড়তে লাগলো, তাদেরকে তত বেশী একাডেমিক সমস্যার সমাধান করার জন্যে হাসপাতালের মতো বিভিন্ন বিভাগ খুলতে হলো বা বিভিন্ন স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে হলো। আর, এভাবেই সৃষ্টি হলো হানাফী, সালাফি, সুফি, মুতাজিলা, আশয়ারি, মাতুরিদি সহ বিভিন্ন স্কুল।
হাসপাতালে যেমন নাক-কান-গলা বিভাগ, চক্ষু বিভাগ ও গাইনি বিভাগ সব বিভাগের কাজ ভিন্ন ভিন্ন হলেও উদ্দেশ্য একটাই যে, রুগীর সেবা করা। তেমনি হানাফী, সালাফি, সুফি, মুতাজিলা, আশয়ারি, মাতুরিদি সহ ইসলামের সকল স্কুলের মেথডলজি ভিন্ন ভিন্ন হলেও উদ্দেশ্য একটাই যে, আল্লাহর ইবাদত করা।