“আজকে যদি আমার জীবনের শেষ দিন হয়, তাহলে আমি এখন যে কাজটি করছি, তা কি করতাম?”

“আজকে যদি আমার জীবনের শেষ দিন হয়, তাহলে আমি এখন যে কাজটি করছি, তা কি করতাম?” – এটি সফলতার একটি মন্ত্র।
________________

পৃথিবীর সফল মানুষদের একজন হলেন স্টিভ জবস। তিনি ছিলেন বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাপল’ এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। জীবনে তিনি এত বড় সফলতা অর্জন করার পিছনে যে প্রশ্নটি ছিলো, তা হলো – “আজ যদি আমার জীবনের শেষ দিন হতো, তাহলে আমি এখন যা করছি, তা কি করতেম?”

স্টিভ জবস তাঁর জীবনে সফলতার কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে বলেন –

“যখন আমার বয়স ১৭ বছর ছিলো, তখন আমি একটা প্রবাদ পড়েছিলাম – “তুমি যদি প্রতিদিন এমন ভেবে জীবন-যাপন করতে পারো যে, আজকে তোমার জীবনের শেষ দিন; তাহলে একদিন তুমি নিশ্চয় সফল হবে”।

এ প্রবাদটা আমাকে খুবই প্রভাবিত করেছিলো। এটা পড়ার পর থেকে গত ৩৩ বছর প্রতিদিন সকালে আমি আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম, এবং নিজেকে নিজে প্রশ্ন করতাম, “আজকে যদি আমার জীবনের শেষ দিন হয়, তাহলে আজকে আমি যা করতে যাচ্ছি, তা কি করতাম?”

টানা কয়েকদিন এ প্রশ্নটির উত্তর যদি “না” হতো, তাহলে আমি ভাবতাম, আমার কিছু একটা পরিবর্তন করতে হবে।

জীবনে আমাকে অনেক সাহায্য করেছে যে কথাটি, তা হলো – “আমি খুব দ্রুত মারা যাব”। প্রতিনিয়ত মৃত্যুকে স্মরণ করার কারণে আমি জীবনে অনেক বড় বড় সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি। কারণ, যখন আমরা মৃত্যুর কথা স্মরণ করি, তখন আমাদের জীবনে অন্যদের চাপিয়ে দেয়া সব প্রত্যাশা, আমাদের নিজেদের সব গর্ব, সব হীনমন্যতা এবং সব ব্যর্থতার গ্লানি নিমিষেই দূর হয়ে যায়। তখন কেবল সেটাই বাকি থাকে, যা আমাদের জন্যে সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ।

জীবনে কোনো কিছু হারিয়ে ফেলার ভয় করাটা এক ধরণের চিন্তার ফাঁদ। এই ফাঁদ থেকে মুক্ত হবার জন্যে সবচেয়ে ভালো উপায় হলো সবসময় মৃত্যুকে স্মরণ করা। ‘একদিন তো মরেই যাবো’ এ কথাটি মনে-প্রাণে মেনে নিয়ে কাজ করলে জীবনে অনেক অপ্রয়োজনীয় কাজ থেকে বেঁচে থাকা যায়।

সবসময় মৃত্যুর কথা স্মরণ করাটা জীবনের জন্যে অনেক উপকারী, এবং এটি খুবই বুদ্ধিবৃত্তিক একটা চিন্তা। যদিও অনেকে মরতে চায় না। এমনকি যারা জান্নাতে যেতে চায়, তারাও মরতে চায় না। কিন্তু আমাদের সবাইকেই মৃত্যু বরণ করতে হবে। এখনো পর্যন্ত কেউই মৃত্যু থেকে বাঁচতে পারেনি।

মৃত্যুই হলো আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় এবং একমাত্র আবিষ্কার। সফলতার জন্যে মৃত্যু-চিন্তাই কেবল আমাদের জীবনকে পরিবর্তন করে দিতে পারে।” 
___

উপরের কথাগুলো স্টিভ জবস বলেছিলেন ২০০৫ সালে, যখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়েছিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মেধাবী তরুণদেরকে বলেছিলেন, জীবনে সবসময় মৃত্যুর কথা স্মরণ করে সিদ্ধান্ত নেয়াটাই তাঁর জীবনের সফলতা।

বেশি বেশি মৃত্যুর কথা স্মরণ করে স্টিভ জবস একজন সফল প্রযুক্তি-উদ্ভাবক হয়েছেন। কিন্তু, আমরা সে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করার কারণে আজ মৃত্যুকে স্মরণ করতে পারছি না। আমাদের চোখের সামনে সারাদিন মোবাইল, ট্যাব, ল্যাপটপ, কম্পিউটার ও টেলিভিশন জাতীয় নানা প্রযুক্তি থাকার কারণে মৃত্যুকে স্মরণ করার কোনো সময়-ই নেই। অথচ, সফল মানুষরা সবচেয়ে বেশি মৃত্যুকে স্মরণ করতেন।

আমাদের প্রিয় নবী (স) ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে সফল একজন মানুষ। কারণ, মাত্র ২৩ বছরে তাঁর মতো অন্য কেউ পৃথিবীকে এতো বেশি পরিবর্তন করতে পারেনি। নবিজী প্রতিদিন ৭০ বারের অধিক মৃত্যুকে স্মরণ করতেন। শুধু তাই নয়, তিনি বলেছেন, “বিশ্বাসীদের মধ্যে সবচেয়ে প্রজ্ঞাবান সে ব্যক্তি, যে মৃত্যুর কথা স্মরণ করে সবসময় ভালো কাজ করে।”

হাদিসে এসেছে –

عَنْ ابْنِ عُمَرَ أَنَّهُ قَالَ قَالَ رَجُلٌ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَيُّ الْمُؤْمِنِينَ أَفْضَلُ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَحْسَنُهُمْ خُلُقًا قَالَ فَأَيُّ الْمُؤْمِنِينَ أَكْيَسُ قَالَ أَكْثَرُهُمْ لِلْمَوْتِ ذِكْرًا وَأَحْسَنُهُمْ لِمَا بَعْدَهُ اسْتِعْدَادًا أُولَئِكَ الْأَكْيَاسُ

“ইবনে উমার (রা) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূল (স)-কে প্রশ্ন করলেন, ‘হে, আল্লাহর রাসূল, মুমিনদের মাঝে কারা সবচেয়ে উত্তম? রাসূল (স) বললেন, ‘যারা চারিত্রিকভাবে উত্তম”। এরপর লোকটি রাসূল (স)-কে বললেন, “মুমিনদের মাঝে কারা সবচেয়ে প্রজ্ঞাবান?” রাসূল (স) বললেন, “যারা মৃত্যুকে বেশি বেশি স্মরণ করে, এবং পরবর্তী জীবনের প্রস্তুতির জন্যে ভালো কাজ করে, তারাই সবচেয়ে প্রজ্ঞাবান”। [ইবনে মাজাহ, ৪২৫৯, মাকতাবায়ে শামেলা]

অর্থাৎ, জ্ঞানী ও সফল মানুষরাই মৃত্যুকে সবচেয়ে বেশি স্মরণ করেন। এখানে একটা বিষয় বলে রাখা ভালো, মৃত্যুর কথা স্মরণ করা মানে মৃত্যুকে কামনা করা না। কারণ, রাসূল নিষেধ করেছেন, কেউ যেন মৃত্যুকে কামনা না করে।

হাদিসে এসেছে –

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لَا يَتَمَنَّى أَحَدُكُمْ الْمَوْتَ إِمَّا مُحْسِنًا فَلَعَلَّهُ يَزْدَادُ وَإِمَّا مُسِيئًا فَلَعَلَّهُ يَسْتَعْتِبُ

“আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত, রাসূল (স) বলেছেন, “কোনো ব্যক্তি মৃত্যুকে কামনা করা উচিত নয়। কারণ, যদি সে ধার্মিক হয়, তবে সে তার ভাল কাজের বৃদ্ধি করতে পারবে, এবং যদি সে পাপী হয়, তবে সে তওবা করতে পারবে।” [বুখারি, ৭২৩৫, মাকতাবায়ে শামেলা]

উপরে উল্লেখিত দু’টি হাদিস এবং স্টিভ জবসের কথাগুলো মূলত কোর’আনের একটি আয়াতের-ই ব্যাখ্যা। আল্লাহ তায়ালা বলছেন –

كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ ۗ وَإِنَّمَا تُوَفَّوْنَ أُجُورَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ۖ فَمَن زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ ۗ وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ

“জীবনমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে তোমাদের কাজের প্রতিদান পূর্ণমাত্রায় দেয়া হবে। যাকে আগুন থেকে দূরে রাখা হবে, এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, সে-ই সফলতা লাভ করবে। আর, পৃথিবীর জীবন হলো সুখের ধোঁকা, এ ছাড়া আর কিছুই নেই”। [সূরা ৩/আলে ইমরান – ১৮৫]

অর্থাৎ, দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনে সফলতা লাভ করার সূত্র হলো, সর্বদা মৃত্যুকে স্মরণ করার মাধ্যমে কেবল গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করা। এবং যে কাজগুলো গুরুত্বপূর্ণ নয়, সে কাজগুলো মৃত্যুকে স্মরণ করার মাধ্যমে বাদ দেয়া। এটাই হলো সফলতার সঠিক ও একমাত্র মন্ত্র।

সুতরাং, স্টিভ জবসের মতো আমাদের নিজেদেরকেও আমরা সবসময় জিজ্ঞেস করা প্রয়োজন, “আজকে যদি আমার জীবনের শেষ দিন হয়, তাহলে আমি এখন যা করছি, তা কি করতাম?

5 April 2018 at 20:55 ·

আরো পোস্ট