এখানে রাজনৈতিক আলাপ নিষেধ!

এখানে রাজনৈতিক আলাপ নিষেধ।’ – এ কথাটা অনেক শুনেছি ও দেখেছি। কিন্তু আমাদের সমাজে কে, কেনো ও কিভাবে এ কথাটার প্রচলন ঘটিয়েছ, তা আগে না বুঝলেও এখন কিছুটা বুঝার চেষ্টা করছি।

সাধারণত, গ্রাম বা মহল্লার ডাক্তারি ফার্মেসি, লাইব্রেরি এবং ছোট-খাট উন্নয়ন মূলক সংস্থাগুলোতে লেখা থাকে – ‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ নিষেধ।’

প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘রাজনৈতিক আলাপ’ বলতে আসলে কি বুঝায়? এবং কেনইবা বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানে ‘রাজনৈতিক আলাপ নিষেধ’ এ কথাটা বলতে হয়? আজকে প্রথম প্রশ্নটি নিয়ে বলছি; দ্বিতীয় প্রশ্নটি অন্যদিন বলা যাবে।

গ্রাম বা মহল্লার মানুষ এক জনের সাথে অন্য জনের দেখা হলে তারা বলেন – ‘কি অবস্থা ভাই?’, ‘কেমন আছেন?’, শরীরটা ভালো তো?, ‘বাচ্চাদের পড়াশুনার কি অবস্থা?’ এসব। এগুলোকে সমাজে ‘রাজনৈতিক আলাপ’ মনে করা হয় না; বরং ‘সামাজিক আলাপ’ মনে করা হয়। তাহলে ‘রাজনৈতিক আলাপ’ মানে আসলে কি?

রাজনৈতিক আলাপ শুরু হয় এভাবে, ‘আচ্ছা বলেন তো – শেখ মুজিব যদি ৭ই মার্চে ভাষণটা না দিত, তাহলে কি দেশ স্বাধীন হত?’ অথবা অন্য পক্ষ শুরু করবে এভাবে, ‘আচ্ছা, জিয়াউর রহমান যদি ২৬ মার্চে স্বাধীনতার ঘোষণা না করত, তা হলে কি দেশ স্বাধীন হত?’ এরপর চলতে থাকে তর্ক আর বিতর্ক। শেষ হয় মারামারিতে গিয়ে।

বাংলাদেশে ‘রাজনৈতিক আলাপ’ মানে অনর্থক ও অবান্তর কথাবার্তা; যা বাংলাদেশের ভাগ্য পরিবর্তন কারী কোনো মানুষই পছন্দ করেন না। এসব পুরানো দিনের অনর্থক ও অবান্তর আলাপের কারণেই বাংলাদেশ আজ এগিয়ে যেতে পারছে না। এখনো থেমে আছে সেই ১৯৭১ সালে।

ডানপন্থী কি বামপন্থী; কেউই বিশ্বাস করতে চান না যে, ক’দিন পরেই ২০১৬ শুরু হতে যাচ্ছে। দেশের অধিকাংশ রাজনীতি প্রিয় এখনো মানুষ সেই ১৯৭১-কে নিয়ে পড়ে থাকতেই বেশি পছন্দ করেন; হোক পক্ষে বা বিপক্ষে।

অতীতের বা ৭১-এর ভালো-মন্দ যাচাইয়ের মাধ্যমে আমাদের বর্তমান মানুষদের আসলে কি কোনো কল্যাণ আছে? তা ঠিক জানি না। তবে আমার ছোট্ট বুদ্ধিতে এতটুকু বুঝি যে, ১৯৭১-এর পুরানো কাহিনী সব বাদ দিয়ে, কোনো পক্ষে বা বিপক্ষে না গিয়ে, দেশের বর্তমান মানুষদের জন্যে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করা বা আখিরাতের প্রস্তুতি নেয়াই এখন বুদ্ধিমান দেশ-প্রেমিকের একমাত্র কাজ হওয়া উচিত।

যেমনটা কোর‘আনেও বলা হয়েছে –

وَلَلْءَاخِرَةُ خَيْرٌۭ لَّكَ مِنَ ٱلْأُولَىٰ
[আর আপনার জন্যে অতীতের চেয়ে ভবিষ্যতে বেশি কল্যাণ রয়েছে।] (সূরা দুহা; আয়াত – ৪)

ইউরোপ বা অ্যামেরিকার মত উন্নত দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কখনো অতীতের বিষয় নিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। তারা কখনো অতীত নিয়ে রাজনীতি করেন না; তারা রাজনীতি করেন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে। ভবিষ্যতের জন্যে কে কত ভালো ও উন্নত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পেরেছে, তার উপর নির্ভর করে তাদের রাজনীতি সামনে চলে। অথচ, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে উল্টো নিয়ম। এখানে যিনি যতবেশি পুরানো দিনের কাহিনী নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করতে পারবেন, তিনি ততবড় বুদ্ধিজীবী। এবং যিনি যতবেশি পুরানো দিনের ঘটনাগুলোকে হাজির করতে পারবেন, তিনি ততবড় রাজনৈতিক।

এ দেশে ‘রাজনীতি’ শব্দটা আসলেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সেই পুরানো দিনের কিচ্ছা-কাহিনী নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক-বিতর্ক করা ছাড়া রাজনীতিতে আর কিছু নেই। সমাজের সাধারণ মানুষ এসব পছন্দ করে না। মানুষ ভবিষ্যতের পরিকল্পনা বা আখিরাতের প্রস্তুতি নিতেই বেশি পছন্দ করেন। আর তাই দেখা যায়, যখনি কেউ পুরানো দিনের অনর্থক, অবান্তর এবং বর্তমানের জন্যে অকার্যকর তর্ক-বিতর্কগুলো শুরু করেন, তখনি পাশের ভদ্রলোকটি বলে উঠেন – ‘ভাই, রাজনৈতিক আলাপ এবার বন্ধ করেন!’

December 20, 2015 at 8:14 PM ·

আরো পোস্ট