“হাসান আত তুরাবী”

সুদানের এক বন্ধুকে বললাম – হাসান আত তুরাবীর নাম শুনেছ? সে অবাক হয়ে আমায় বললো – কি বল! আমার দেশের বাচ্চারাও তো হাসান আত তুরাবীকে চেনে। কারণ জানতে চাইলাম – সে যা বললো, তাতে পুরাই হাসান আত-তুরাবীর ভক্ত হয়ে গেলাম।

বর্তমান যুগের অনেক ইসলামী চিন্তাবিদদের সাথে হাসান আত তুরাবীর একটি মৌলিক পার্থক্য হলো – তিনি কেবল চিন্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেন না, তাঁর চিন্তা-ভাবনাকে কাজে পরিণত করার জন্যে নিয়মিত সংগ্রাম ও ত্যাগ স্বীকার করে যাচ্ছেন।

ইসলামী রাষ্ট্র সম্পর্কে তাঁর চিন্তা-ভাবনা অসাধারণ। পশ্চিমা রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করে ইসলামী রাজনীতির এমন ধারণা এর আগে আমি পাইনি। তাই তাঁর একটি সাক্ষাতকার ক’দিন আগে অনুবাদ করলাম। Masud ভাই কষ্টকরে সম্পাদনা করে দিয়েছেন।

হাসান তুরাবির ভাবনায় ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা (http://cscsbd.com/1187)

এ সাক্ষাতকারটি পড়ে দু’একজন হাসান আত তুরাবী সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। তাঁর সম্পর্কে সংক্ষেপে একটু লিখলাম।

“হাসান আত-তুরাবী নামটি সুদানের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে থাকলেও তাঁর খ্যাতি বিশ্বজোড়া। তিনি একাধারে আলেম, মুফাসসির, আইনবিদ, শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তাঁর চিন্তাধারার আলোকেই গড়ে উঠেছে আজকের আধুনিক সুদান। এবং একারণেই তিনি সুদানের সবচেয়ে জনপ্রিয় একজন ব্যক্তিত্ব। ১৯৩২ সালে, সুদানের কাসালা গ্রামে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের শরিয়াহ আদালতের বিচারক। তিনি শিক্ষাজীবন শুরু করেন গ্রামের একটি মাদ্রাসায়। সেখানে তিনি ইসলামী শিক্ষা অর্জনের পর সুদানের রাজধানী খারতুমে আসেন ‘আইন’ পড়ার জন্যে। স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন সুদানের বিখ্যাত খারতুম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

পড়াশুনার পাশাপাশি তিনি সুদানের ইসলামী রাজনৈতিক দল ইখওয়ানুল মুসলিম-এ যোগদান করেন। একারণেই পরবর্তীতে তিনি সুদানের দীর্ঘসময়ে সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। যাই হোক, উচ্চ শিক্ষা অর্জনের জন্যে এরপর তিনি গমন করেন লন্ডনে, এবং সেখানকার কিংস কলেজ থেকে আইনের উচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর গমন করেন ফ্রান্সে; সেখানকার প্যারিসে অবস্থিত বিশ্বের অন্যতম সেরা-প্রাচীন সারবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন। তাঁর পিএইচডি-র বিষয় ছিল –‘উদার নৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জরুরি অবস্থায় ক্ষমতা প্রয়োগ কতটা গ্রহণযোগ্য?’

ইসলামী জ্ঞানের সাথে বৈশ্বিক জ্ঞানের এমন অসাধারণ সমন্বয় সৃষ্টিকারী দ্বিতীয়জন সুদানে খুঁজে পাওয়া দায়। ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তিনি সুদানের এটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রী হয়েছিলেন এবং ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি সুদানের ন্যাশনাল এসেম্বলি’র স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন।

ইসলাম ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা ও সমাজ সংস্কারের উদ্দেশে তিনি প্রচুর কাজ ও লেখালেখি করেন। ‘তাফসীর আত-তাওহীদ’ নামে তিনি একটি তাফসীর লিখেন, যেখানে সমসাময়িক সমস্যাগুলোর কোর‘আন ভিত্তিক তিনি সমাধান দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, ইসলামী জ্ঞানের সাথে আধুনিক জ্ঞানের সমন্বয় করা এখন খুবই প্রয়োজন। তিনি অসংখ্য বই ও প্রবন্ধ লিখেছেন, ইংরেজি ও আরবিতে তাঁর অনেক বক্তৃতা রয়েছে; এগুলোর মাধ্যমে তিনি সুদানের দরিদ্রতা, গোত্রীয় সংকীর্ণতা, মাজহাব নিয়ে ঝগড়া সহ বিভিন্ন নাগরিক সমস্যার সমাধান দিয়েছেন। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর উদার ও আধুনিক সমাধান সুদানের মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করেছে। ফলে সুদানসহ বিশ্ববাসীর কাছে তাঁর সম্মান ও মর্যাদা আকাশচুম্বী।

ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিমরা যেসব অভিযোগ তোলে, হাসান আত তুরাবী চমৎকারভাবে সেসব খণ্ডন করেন। বিশেষত, ইসলামে নারীর মর্যাদা ও অধিকারের প্রশ্নে তিনি কিছু অসাধারণ বিষয় তুলে ধরেছেন, যা অমুসলিমদের সকল অভিযোগকে ধূলিসাৎ করে দেয়। নারী বিষয়ে তিনি একটি বই লিখেন, নাম – ‘Women between the teachings of religion and the customs of society’। এ বইটি বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যতালিকায় রাখা হয়েছে। তিনি কেবল বই লিখেই বসে থাকেননি; ইসলামী ঐতিহ্যের আলোকে সুদানের নারীদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে হাজির করার ক্ষেত্রে অসামান্য ত্যাগও স্বীকার করেছেন। বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ড এবং ইসলামের প্রতি অনড় অবস্থানের কারণে সুদানের সামরিক সরকার তাঁকে কারাগারে প্রেরণ করে। ২০০১ সাল থেকে প্রায় চার বছর কারাভোগ করার পর ২০০৫ সালে তিনি মুক্তি পান। এ মানুষটির বহুবিদ প্রতিভা বিশ্ববাসীকে কেবল অবাক করেই দেয় না, আত্মবিশ্বাসী মানুষকে সামনে চলার পথও খুঁজে দেয়।”

October 19, 2015 at 8:52 PM ·

আরো পোস্ট