সৈয়দ শামসুল হক বনাম হুমায়ুন আজাদ : প্রসঙ্গ ‘দেশরত্ন’
বাংলা ভাষায় কৌতুকপূর্ণ আনন্দ লাভের আশায় যে ক’জনকে পড়ি, হুমায়ুন আজাদ তাদের অন্যতম। চমৎকার শব্দে লিখেন, শব্দের গাঁথুনি অসাধারণ; মূলত তার লেখায় শব্দ-ই প্রধান, ভাব নয়। ভাষা ও বিষয়-জ্ঞান –এ দু’টিকে আলাদা করে বোঝার জন্যে ‘হুমায়ুন আজাদ’ এক অনন্য উপমা। তার লিখার ভাষা চমৎকার, কিন্তু বিষয় জ্ঞানশূন্য।
ভাষা জ্ঞানের বাহন। ভাষা জ্ঞান সঞ্চারণ ও সংরক্ষণের উৎকৃষ্ট মাধ্যম। তবে ভাষা নিজে জ্ঞান নয়। পৃথিবীর বড় বড় লেখকদের লেখায় ভাষা ও বিষয়-জ্ঞান পরস্পর অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে যায়। ‘হুমায়ুন আজাদ’ ব্যতিক্রম। কেবল ব্যতিক্রম-ই নন, তিনি ভাষা ও বিষয়-জ্ঞান বিভাজনের দেশীয় উদ্ভাবক, শব্দ ও জ্ঞানের অবুঝ-অমীমাংসিত ধারক-বাহক। তিনি শব্দের পর শব্দ লিখেন বোধের উদয় ছাড়াই, বাক্যের পর বাক্য লিখেন নগ্ন চিন্তা দিয়েই, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখেন প্রোপাগান্ডা করেই। অশ্রাব্য-কুৎসিত-অশ্লীল-অশিক্ষিত গালাগাল তার বইয়ের পুঁজি।
যাই হোক, হুমায়ুনকে নিয়ে আজ বিস্তারিত বলার ইচ্ছা নেই, সময় হলে অন্যদিন বলা যাবে; আজ তার জাতি-ভাই সৈয়দ শামসুল হককে ক’টি কথা হাদিয়া পাঠাব ভাবলাম। হক ও হুমায়ুন –দু’জন একই পণ্যের ব্যবসায়ী, অশ্লীলতার বিপণে ও বিস্তারে দু’জন-ই দক্ষ-অভিজ্ঞ। এক বাজারে দু’দক্ষ ব্যবসায়ী থাকলে যা হয়, এদেরও তাই হল। পরস্পর হিংসার জন্ম দিল। হক করলেন হুমায়ুনের সমালোচনা, আর হুমায়ুন করলেন হকের সমালোচনা; -এদিকে আমরা পেলাম কিছু সত্য ঘটনা।
সোশ্যাল মিডিয়ায় গত ক’দিন হকের ব্যাপক সমালোচনা করছেন কেউ কেউ। সৈয়দ হক নাকি প্রধানমন্ত্রীকে ‘দেশরত্ন’ উপাধি দিয়েছেন; তাই এ তোলপাড়। কেউ বলছেন, সৈয়দ হকের মত এক ‘অশ্লীল বৃদ্ধ’ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ উপাধি গ্রহণ করা উচিৎ হয়নি। তসলিমা নাসরিন সতর্ক করে দিয়েছেন অনেক আগেই, হকের উদ্দেশ্য ভালো না। আবার অন্য কেউ বলছেন, সাহিত্যিক হিশাবে হকের উচিৎ হয়নি ক্ষমতার দালালি করা। -এ দুই বিতর্ক থেকে একটু দূরে গিয়ে আমি শুধু হুমায়ুনের বিচারে সৈয়দ হককে তুলে ধরলাম।
হুমায়ুনের বই ‘প্রবচনগুচ্ছে’ প্রকাশ হবার পর হক হুমায়ুনের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। হুমায়ুনও থেমে থাকার বস্তু না, তিনিও ঝাঁপিয়ে পড়লেন হকের বিরুদ্ধে। লিখলেন, “প্রবচনগুলো নিয়ে প্রথম মেতে, পাগল হয়ে, ওঠেন বর্তমানের প্রবীনতম কপট লেখক, যার কোনো কোনো লেখার আমি অত্যন্ত অনুরাগী, তিনি গুরুত্বপূর্ণ লেখক হওয়া সত্ত্বেও ব্যক্তিগত কপটতার জন্যে কখনো গুরুত্ব পাননি ও পাবেন না ব’লেই মনে হয়, সেই সৈয়দ হক তিনি সংবাদ সাময়িকীতে তাঁর কলামে প্রবচনগুলোকে উপলক্ষ ক’রে আক্রমণ করেন আমাকে। তাঁর লেখাটি ছিলো ভণ্ডামো, অসততা, মগজহীনতা, ও মৌলবাদের মিশ্রণ, যা শুধু তাঁর পক্ষেই সম্ভব।”
নারীর প্রতি লোলুপ লুম্পেনের হাহাকার করা শামসুল হককে হুমায়ুন বলেন- “মগজ পুরোপুরি প’চে গেলে ও ভণ্ডামোতে ভ’রে গেলেই কেউ এমন ভাবালুতা দেখাতে পারে। বলতে ইচ্ছে হয় খেলারাম খেলে যা। সৈয়দ হক, বাঙলাদেশের সবচেয়ে লিঙ্গবাদী লেখক; যার প্রধান প্রেরণা কাম, যিনি নারীকে ভোগ্য পণ্যরূপে ব্যবহারে অক্লান্ত, ….(হুমায়ুন নিজেও যে শব্দগুলো হকের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন, তা এখানে লিখা সম্ভব না)….. যিনি উঠে এসেছেন বাদামতলি থেকে, লিখেছেন, ‘আমার অসুখ নাই, নির্ভয়ে করেন’, যিনি নারীকে যৌনপীড়ন না ক’রে উপন্যাস বা অপন্যাস লিখতে পারেন না।”
“সৈয়দ হকের উপন্যাস মূলত পর্নোগ্রাফি। মুক্তিযুদ্ধের যে-উপন্যাসগুলো তিনি লিখেছেন, সেগুলোকে তিনি ধর্ষণের উপাখ্যানে পরিণত করেছেন। তাঁর লেখা ‘খেলারাম খেলে যা’ উপন্যাসটিতে…..বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি মেয়েকে বারবার ভোগ করা হয়েছে, তিনি একজন ভালো পর্ণোঅপন্যাসিক। তাঁর ‘দূরত্ব’ উপন্যাসে কলা ভবনের ছাদে ‘রাজা’ পাওয়া যায় ব’লে উল্লেখ আছে।
“তাঁর নিষিদ্ধ লোবান-এ পাকিস্তানি মেজর বিলকিসকে ধর্ষণ করার আগে মানসিক বলাৎকার করে,……..(হকের লেখা বিলকিসের সাথে পাকিস্তানী মেজরের আলাপ এখানে দেয়া সম্ভব না)…….পাকিস্তানী মেজর নয়, আসলে লেখকই মানসিক ধর্ষণ করেছেন বিলকিসকে আর সে-লেখকই অভিনেত্রীর প্রতি আমার অশ্রদ্ধায় বিলাপ করেছেন! মগজ প’চে যাওয়ার গন্ধে ভ’রে আছে তাঁর সমস্ত মন্তব্য।”
“তাঁর মতো যৌনগ্রাফারের প্রথাগত সুনীতির পুরোহিত হওয়া সাজে না। সৈয়দ হক আসলে ওই রচনায় আত্মহত্যা করেছেন, তবে সততা ও নৈতিকতার অভাবে তিনি তা বুঝতে পারেন নি। তাঁর প্রায় প্রতিটি অপন্যাসে তিনি নারীদের অপমান করেছেন, তাদের যৌনসামগ্রী হিশেবে ব্যবহার করেছেন; তাই ওই লেখাটিতে তাঁর ভণ্ডামো দেখে তাঁর জন্যে আমার করুণা হয়। …এজন্যে মৌলবাদীরা আমাকে অনেক আক্রমণ করেছে। এখন আক্রমণ করেছেন একজন রুগ্ন বুর্জোয়া ও লোলুপ লুম্পেন।”
সৈয়দ হক কোনো নারীকে সম্মান দিতে পারেন না, ‘দেশরত্ন’ উপাধি দেয়া তো দূরে থাক। হুমায়ুনের ভাষায়, “সৈয়দ হকি শাস্ত্রমতে মানুষকে শ্রদ্ধা করতে হ’লে প্রথমে শ্রদ্ধা করতে হবে অভিনেত্রীকে! হকের লেখাটিতে শ্রদ্ধার কথা বার বার এসেছে; এটা হয়তো ঘটেছে ব্যক্তিগত কারণে, কারো কাছে শ্রদ্ধা না পাওয়ার ফলে। সৈয়দ হক মানুষকে শ্রদ্ধা করেন কিনা জানি না, তবে অভিনেত্রীদের শ্রদ্ধা করেন, ওটা তাঁর ব্যবসা। নারীদের মূলকথাও জানা নেই তাঁর; অভিনেত্রী পুরুষতন্ত্রের প্রমোদপণ্য, তাঁরা নারীর প্রতিনিধি নয়; তারা হকের মতো লিঙ্গবাদীদেরই প্রমোদের পুতুল।”
সৈয়দ হকেরা কেনো প্রধানমন্ত্রীকে ‘দেশরত্ন’ উপাধি দিয়ে শ্রদ্ধা করলেন? –এ প্রশ্নটি অমীমাংসিত রেখে বা পাঠকের মাথায় তুলে দিয়ে আমি শেষ করলাম।
May 31, 2015 at 9:01 PM ·