রাজনীতির সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক – শায়খ ড. জাসের আওদা
[‘ইসলাম ও রাজনীতি’ প্রসঙ্গে কেউ মনে করেন, প্রচলিত ব্যবস্থাকে উপড়ে ফেলে ‘আদর্শ ইসলামী ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠা করাই হলো একমাত্র করণীয়। আবার কেউ মনে করেন, রাজনীতির মধ্যে ইসলামকে টেনে আনা মোটেও ঠিক নয়। কিন্তু স্বয়ং ইসলাম ব্যাপারটিকে কীভাবে দেখে, তা নিয়ে সমাজে স্বচ্ছ ধারণার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। গত ২০ মে ২০১৬ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে ADAMS সেন্টারের জুমার খুতবায় শায়খ ড. জাসের আওদা রাজনীতির সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক নিয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। সিএসসিএস-এর পাঠকদের জন্য বক্তব্যটি অনুবাদ করেছেন জোবায়ের আল মাহমুদ।]
গণসম্পৃক্ততা ও রাজনীতিতে অংশগ্রহণ সংক্রান্ত বিষয়ে নেতৃবৃন্দ, ইমাম ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্যে আমরা একটি নির্দেশনা তৈরি করেছি। আজকের বক্তব্যটি সেই প্রশিক্ষণেরই অংশ। বিশেষত, আমাদের নেতৃবৃন্দ, ইমাম ও শিক্ষকদের মধ্যে যারা এই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেছেন এ বক্তব্য তাদের জন্যে। একটি অনুষ্ঠানে আজকের এই বক্তব্যের ঘোষণাটি দেয়ার পর বেশ কয়েকজন ভাইবোনের কাছ থেকে আমি কিছু প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। একজন বলেছেন, ‘ইসলাম ও রাজনীতি’ প্রসঙ্গটি নিয়ে মসজিদে আলোচনা করা উচিত নয়। এই ভাইয়ের যুক্তি হলো, রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনার তুলনায় মসজিদ খুবই পূত-পবিত্র জায়গা। আরেকজন ভাই বলেছেন, রাজনীতি কোনোভাবেই ইসলামী রীতি নয়। মুসলমান হয়ে আমরা কেনো এতে জড়াবো? এসব অনৈসলামী পদ্ধতি থেকে আমাদের দূরে থাকা উচিত। আবার অন্য একজনের প্রতিক্রিয়া ছিল এর বিপরীত। তাঁর মতে, অমুক-অমুক প্রার্থী কিংবা অমুক-অমুক দলকে প্রমোট করার জন্য এই আলোচনা একটা বিশাল সুযোগ।
কিন্তু আসল ব্যাপার হলো, রাজনীতির ব্যাপারে ইসলামের বক্তব্য এগুলোর কোনোটির মতোই নয়। রাজনীতি থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন রাখা ইসলামের উদ্দেশ্য নয়। বিশ্বাসী মুসলমানদের রাজনীতি থেকে দূরে থাকা উচিত – এমনটা ইসলামের প্রস্তাবনা নয়। এমনকি রাজনৈতিক ব্যবস্থা অনৈসলামী হলেও রাজনীতি থেকে দূরে থাকা উচিত নয়। মুসলমানদেরকে অবশ্যই রাজনীতিতে অংশ নেয়া উচিত। তবে বিশেষ কোনো প্রার্থী, দল বা বর্ণের কাউকে গুরুত্ব দেয়াও ইসলামের কাজ নয়। ইসলাম বরং রাজনীতির ক্ষেত্রে নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও চূড়ান্ত উদ্দেশ্যকে বিবেচনা করে।
কোনো ব্যাপারে আমি কী বলেছি, সমসাময়িক বা অতীতের গবেষকরা কী বলেছেন, কিংবা ইসলামী চিন্তার জগতে কোনো ধারণা কীভাবে গড়ে ওঠেছে – এসবের উপর ভিত্তি করে কোনো কিছুকে আমরা ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে বিবেচনা করতে পারি না। বরং কোনো দৃষ্টিভঙ্গি কোরআন ও সুন্নাহর সাথে যতটা সম্পর্কিত, তা ততটা ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি। চলুন, কোরআনকে রাজনৈতিক দৃষ্টিতে পড়ার জন্যে আমরা কোরআনের কাছেই ফিরে যাই এবং খুঁজে দেখি, রাজনৈতিক ব্যাপারে কোরআন আমাদেরকে কী ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষা দেয়।
কোরআন কি সত্যিই রাজনীতি নিয়ে আমাদেরকে কোনো উপদেশ দেয়? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই দেয়। মুহাম্মদসহ (সা) কোরআনে বর্ণিত নবী-রাসূলদের প্রতিটি কাহিনীর রাজনৈতিক দিক রয়েছে। কোরআনের ব্যাখ্যা সুন্নাহর মধ্যেও তা রয়েছে। এই কাহিনীগুলো পড়লে আমরা এমন কিছু ব্যাপার শিখতে পারবো, যার ফলে আমরা বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় ঠিক করতে পারবো। ইসলাম ও রাজনীতি প্রসঙ্গে আমাদের করণীয় কী – এই প্রশ্নের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো কোরআনের আলোকে এর যথাযথ উত্তর আমরা কীভাবে দেবো, তা। এ ব্যাপারে কোরআন-সুন্নাহয় কী বলা আছে, অর্থাৎ কোরআন-সুন্নাহর দৃষ্টিভঙ্গি কী, তা বুঝার চেষ্টা করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
মুসা (আ) ও ফেরাউনের কাহিনীতে আপনি দেখবেন, ফেরাউনের নিকট গিয়ে মুসা (আ) কেবল আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার আহ্বানই জানাননি, বেশ কিছু রাজনৈতিক ব্যাপারেও তাকে উপদেশ দিয়েছিলেন। এরমধ্যে একটি ছিল – সমাজের দুর্বল মানুষদেরকে হত্যা বন্ধ করা। আরেকটি উপদেশ ছিল, বনী ইসরাইলের লোকদেরকে যেন দাস বানানো বন্ধ করা হয়। বনী ইসরাইল তথা ইহুদীরা তখন ছিল সমাজের প্রান্তিক ও দুর্বল জনগোষ্ঠী। আরো একটি পরামর্শ ছিল – ফেরাউন যেন স্বর্ণ, অলঙ্কার এবং এ জাতীয় সম্পদ পুঞ্জীভুত না করে। তখনকার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো পরিবর্তনের উচ্চতর লক্ষ্যকে সামনে রেখে তিনি তাকে এ ধরনের আরো কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন। এসব পরামর্শ গ্রহণ করার মানেই হলো আল্লাহর উপর ঈমান আনার দিকে অগ্রসর হওয়া।
এই ঘটনার দিকে নজর দিলে আমরা দেখবো, তখন যে ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও বাস্তবতা বিদ্যমান ছিল, সে আলোকেই এর সাথে কোরআন বুঝাপড়া করছিল। তখনকার রাজনৈতিক বাস্তবতাকে কোনো নির্দিষ্ট মডেল বা ইউটোপিয়ায় পরিবর্তন করার দরকার মনে করা হয়নি। মুসা (আ) যখন ফিরাউনের নিকট গেলেন, তখন সর্বপ্রথম তাকে আল্লাহ তায়ালার প্রতি ঈমান আনতে পরামর্শ দেন। আল্লাহ তায়ালা মুসা (আ) ও হারুনকে (আ) বলেন –
اذْهَبَا إِلَىٰ فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَىٰ- فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَّيِّنًا لَّعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَىٰ
অর্থ: তোমরা উভয়ে ফেরাউনের কাছে যাও; সে খুব উদ্ধত হয়ে গেছে। তোমরা তার সাথে নম্রভাবে কথা বল, হয়তবা সে চিন্তাভাবনা করবে অথবা ভীত হবে। (সূরা ত্বহা: ৪৩-৪৪)
এ কারণে মুসা (আ) এবং হারুন (আ) তখনকার বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে থেকেই আলাপ-আলোচনা করছিলেন। তবে তারা তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের আচরণের মান ঠিক করে দেয়ার চেষ্টা করছিলেন। মুসা (আ) ফেরাউনের নিকট গিয়ে বলেননি, আমি রাষ্ট্র কাঠামো পাল্টে দিতে চাই। এই ফেরাউনী রাষ্ট্রকে আমি ইসলামী রাষ্ট্র বা ইহুদী রাষ্ট্র কিংবা অন্য কোনো রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পরিবর্তন করতে চাই। বরং আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করার জন্য তিনি ফেরাউন, তার পরিবার এবং তৎকালীন উচ্চবিত্তদেরকে উপদেশ দিয়েছিলেন। তারা যেন সুশাসন, ন্যায়বিচার, অধিকার ও মানবতা প্রতিষ্ঠার সুন্দর পথ গ্রহণ করে, সে উপদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু জবাবে ফেরাউন সহিংস প্রতিক্রিয়া দেখায়। ফলে আল্লাহ তায়ালা মুসা (আ) ও ইহুদীদেরকে দেশত্যাগের মাধ্যমে এই নির্যাতন থেকে নিজেদের রক্ষা করার নির্দেশ দিলেন। তারপর আল্লাহ তায়ালা মুসার (আ) মাধ্যমে ইহুদীদেরকে একটি বার্তা দিলেন –
قَالَ عَسَى رَبُّكُمْ أَن يُهْلِكَ عَدُوَّكُمْ وَيَسْتَخْلِفَكُمْ فِي الْأَرْضِ فَيَنظُرَ كَيْفَ تَعْمَلُونَ
অর্থ: আল্লাহ বললেন, সম্ভবত তোমাদের প্রতিপালক শীঘ্রই তোমাদের শক্রদের ধ্বংস করে দেবেন এবং তোমাদেরকে এই দেশের প্রতিনিধিত্ব দান করবেন। তারপর দেখবেন, তোমরা কেমন কাজ কর। (সূরা আরাফ: ১২৯)
ইহুদিরা যখন অত্যাচারিত হলো এবং মিশর ছেড়ে অন্য দেশে চলে যেতে বাধ্য হলো, তখন আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে বললেন, একদিন ইতিহাসের এই চাকা ঘুরে যাবে এবং তোমরা ক্ষমতাসীন হবে। তখন তোমরা ভালো কাজ করবে, নাকি খারাপ কাজ করবে, আমি সেই পরীক্ষা নেবো।
মোহাম্মদের (সা) ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। মুহাম্মদ (সা) তাঁর বাণী প্রচার শুরু করার পর মক্কার ‘দারুন নদওয়া’য় গিয়ে তাদেরকে বলেননি, আমি আবু সুফিয়ানের পদে হামজা (রা) এবং ওয়ালিদ ইবনুল মুগিরার স্থানে বিলালকে (রা) বসাতে চাই। তিনি বরং তৎকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতা যেমন আছে তেমন রেখেই একে আরো উন্নত অবস্থায় নিয়ে যাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি তখন ‘হিলফুল ফুজুলের’ সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন, যা ছিল সেই সময়ের একটি কল্যাণমূলক সংগঠন। এর মাধ্যমে তিনি মক্কায় নিপীড়িত যে কারো পক্ষে দাঁড়ানোর জন্যে কয়েকজন নেতার সাথে সম্মতি পোষণ করেন। তারা মোহাম্মদের (সা) উপর ঈমান আনলো কি আনলো না, তা বিবেচনার বিষয় ছিল না। যদিও এই সংগঠনের জন্ম ইসলাম আসার আগে, কিন্তু ইসলাম আসার পরেও এর কার্যক্রম ছিল।
একটা ঘটনা আমরা সবাই জানি। বাইরের এক ব্যবসায়ী মক্কার এক ব্যক্তির সাথে ব্যবসা করত। মক্কার লোকটি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অর্থ নিয়ে বিনিময়ে প্রতিশ্রুত পণ্য দেয়নি। রাসূল (সা) তখন বিপদে পড়া নির্যাতিত এই মানুষটির পক্ষে দাঁড়ালেন। অর্থ আত্মসাৎকারী লোকটিকে তিনি মক্কার একজন অভিজাত নেতার সামনে নিয়ে গিয়ে বললেন, এ লোকের অর্থ ফিরিয়ে দাও। তখন আত্মসাৎকারী লোকটি ব্যবসায়ীটির অর্থ ফিরিয়ে দিয়েছিল।
সুতরাং, সেই সময়ের রাজনৈতিক কাঠামো যেমন ছিল, রাসূলের (সা) রাজনৈতিক আচরণও তেমন ছিল। তবে তিনি তখনকার রাজনীতিকে আরো বেশি স্বচ্ছ, ন্যায় ও মানবিক করে তোলার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু উমাইয়া ইবনে খালফ ও আবু সুফিয়ানের মতো উদ্ধত লোকেরা ফেরাউনের মতোই মুসলমানদের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণকে মেনে নিতে পারেনি। তারা মুসলমানদেরকে নির্যাতন করা শুরু করল। তাদেরকে নিজ দেশ থেকে বিতাড়ন করতে শুরু করল। ফলে রাসূল (সা) কিছু সংখ্যক মুসলমানকে আবিসিনিয়ায় একটি নিরাপদ ভূখণ্ড খুঁজে নিতে বললেন–
اذهبوا إلى الحبشة فإن فيها ملكاً لا يُظلم عنده أحد
অর্থ: তোমরা আবিসিনিয়ায় যাও; সেখানে একজন রাজা আছেন, যিনি কাউকে নির্যাতন করেন না।
মদীনার খোঁজ পাওয়ার আগ পর্যন্ত রাসূল (সা) এমন একটি দেশ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিলেন, যেখানে মুসলমানদেরকে তুলনামূলকভাবে কম নিপীড়ন, নির্যাতন ও যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে। ফলে আবিসিনিয়ায় গিয়ে সাহাবীগণ আগের চেয়ে বেশি ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা লাভ করলেন। তারপর কিছুদিন তারা সেখানে অবস্থান করলেন। অবশেষে রাসূল (সা) মদীনায় হিজরত করেন। যেসব লোক রাসূলকে (সা) মেনে নেয়নি মদীনায় যাওয়ার পরও তারা মুসলমানদের উপর নির্যাতন করছিল। আহযাবের যুদ্ধ পর্যন্ত মুসলমানদেরকে সেই নির্যাতনের মোকাবেলা করতে হয়েছিল। আহযাবের যুদ্ধে তারা মদীনা ঘিরে ফেলল। তারা মদীনার প্রত্যেককে হত্যা করতে চেয়েছিল।
কিন্তু মদীনায় যাওয়ার পর মুসলমানরা নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শুরু করেন। তবে মদীনায় হিজরতের আগে কোনো ধরনের যুদ্ধ ছিল না। কারণ তখন পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের যুদ্ধ করার অনুমতি দেননি। এমনকি নিজেদের আত্মরক্ষার অনুমতিও ছিল না। ওই সময়টা ছিল শান্তিপূর্ণ ও উপদেশমূলক দাওয়াতের পন্থা। পরবর্তীতে মদীনায় আল্লাহ তায়ালা আয়াত নাযিল করে বললেন –
أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا ۚ وَإِنَّ اللَّهَ عَلَىٰ نَصْرِهِمْ لَقَدِيرٌ
অর্থ: তাদেরকে যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হলো যাদের সাথে কাফেররা যুদ্ধ করে; কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আল্লাহ অবশ্যই তাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম। (সূরা হজ্জ: ৩৯)
এবারও ইতিহাসের পুরানো ঘটনার পুনরাবৃত্তিই ঘটলো। ইহুদীদের মতো মুসলমানদেরকেও আল্লাহ তায়ালা বিজয় দান করলেন। এরপর মুসলমানদের মাঝে কে ভালো এবং কে ভালো নয়, অতীতের মতো সেই পরীক্ষাও আল্লাহ নিলেন। আরবের কর্তৃত্ব হাতে পাওয়ার পর মুসলমানরা কি ন্যায়, নৈতিকতা ও আল্লাহর নির্দেশিত পথ অনুসরণ করেছে, নাকি ভিন্ন পথে চলেছে –সেই পরীক্ষা আল্লাহ করেছেন। খোলাফায়ে রাশিদা নিশ্চয় আমাদের জন্য দৃষ্টান্ত। কিন্তু ইতিহাস থেকে আমরা জানি, তাঁদের পরে আরবের ক্ষমতাবানদের কেউ ইসলামের বিধান ও ন্যায়ের পথ অনুসরণ করেছেন, কেউ করেননি।
ইউসুফের (আ) ঘটনা হলো আমাদের জন্য আরেকটি দৃষ্টান্ত। তৎকালীন রাজার রাজনৈতিক কাঠামোর অধীনে গণসম্পদ বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে তিনি মনোনীত হয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি নিজেই মন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। রাজা যখন ইউসুফকে (আ) বললেন, আমি তোমাকে আমার ঘনিষ্ট ব্যক্তিতে পরিণত করতে চাই; তখন তিনি বললেন, আপনি আমাকে আপনার দেশের মন্ত্রী বানান। তিনি ফেরাউনের সময়কালের আগে তৎকালীন মিশরের রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। সে সময় তারা চন্দ্র-সূর্যের উপাসনা করতো। কিন্তু সকলের স্বার্থে, অর্থাৎ যারা তাঁর উপর ঈমান এনেছে বা আনেনি – তাদের সবার ভালোর জন্যই তিনি সেই সরকারে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেই বিশেষ রাজনৈতিক সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবে তিনি তার মেয়াদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছেন এবং সময়কে কাজে লাগিয়েছেন।
অতএব, প্রচলিত ব্যবস্থাকে পাল্টে দিয়ে এক ধরনের ‘ইউটোপীয় ইসলামী ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠিত করার বাধ্যবাধকতা ইসলামে নেই। অথচ আমরা সাধারণত মনে করি, এটাই হলো ইসলামী ধারণা। যদিও আদর্শ একটা মানদণ্ড প্রতিষ্ঠিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এটি করতে গিয়ে প্রচলিত রাজনৈতিক কাঠামো থেকে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা মুসলমানদের জন্য অনুচিত। কোরআন আমাদেরকে সেই গুহাবাসী আহলে কাহাফ সম্পর্কে শিক্ষা দিচ্ছে, যারা নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল। আমরা প্রতি শুক্রবার এই সূরাটি পড়ি। আসহাবে কাহাফের লোকেরা প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে না পেরে গুহায় চলে গিয়েছিল; তারপর তারা বলেছিল –
إِنَّهُمْ إِن يَظْهَرُوا۟ عَلَيْكُمْ يَرْجُمُوكُمْ أَوْ يُعِيدُوكُمْ فِى مِلَّتِهِمْ وَلَن تُفْلِحُوٓا۟ إِذًا أَبَدًۭا
অর্থ: তারা যদি তোমাদের খবর জানতে পারে, তবে পাথর মেরে তোমাদেরকে হত্যা করবে, অথবা তোমাদেরকে তাদের ধর্মে ফিরিয়ে নেবে। তাহলে তোমরা কখনই সাফল্য লাভ করবে না। (সূরা কাহাফ: ২০)
তারা গুহার চলে যাওয়ার কারণ ছিল সমাজে তাদের কোনো জনপ্রিয়তা এবং জনসমর্থন ছিল না। এ কারণে তাদের বক্তব্য ছিল – শাসকগোষ্ঠী সন্ধান পেয়ে গেলে তোমাদেরকে নির্যাতন করবে, পাথর ছুড়ে মারবে।
রাজনৈতিক কাঠামো থেকে কোনো জনগোষ্ঠীর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া আত্মহত্যারই নামান্তর। এর ফলে তাদের কোনো নিরাপত্তা থাকে না। এটাই হলো কোরআনের শিক্ষা। তবে যুক্তির খাতিরে কেউ বলতে পারে, এটা তো দুনিয়াবী ব্যাপার। তাই মুসলমান হিসেবে আমরা আমাদের জীবন ও আমাদের মসজিদে রাজনীতির নোংরামি টেনে আনতে বাধ্য নই। এটা সত্য যে, বেশিরভাগ সময় দুনিয়াবী উদ্দেশ্যেই রাজনীতি করা হয়। কিন্তু রাজনীতি সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো – দুনিয়াবী উদ্দেশ্যে রাজনীতি করা যাবে না; বরং দ্বীন এবং সর্বসাধারণের মঙ্গলের উদ্দেশ্যেই রাজনীতি করতে হবে। এটাই মুসলমানদের আদর্শ দৃষ্টিভঙ্গি। মুসলমানরা কখনো ব্যক্তিস্বার্থ কিংবা বিশেষ কোনো প্রার্থী বা দলের জন্যে রাজনীতি করে না। তারা ন্যায়, মানবিকতা, উচ্চতর মূল্যবোধ এবং সর্বসাধারণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট যেসব কথা কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, সেসবের আলোকে প্রতিটি ইস্যুকে বিবেচনা করে। আল্লাহ তায়ালা কোরআনে অন্যায়কে নিষিদ্ধ করেছেন এবং আমাদেরকে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকল নিপীড়িত মানুষের পক্ষে দাঁড়াতে বলেছেন।
অতএব, মুসলমানদের রাজনৈতিক পন্থা হলো নিপীড়িত, প্রান্তিক, নিরাহার, নিরাশ্রয় ও দরিদ্র মানুষের পক্ষে দাঁড়ানো। এগুলো ইসলামেরই বিষয়। ইসলাম শুধু মসজিদ, হালাল খাবার এবং এ জাতীয় মুসলিম ইস্যুগুলো নিয়েই সংশ্লিষ্ট নয়। হ্যাঁ, এসবও ইসলামী ইস্যু বটে, কিন্তু নিছক এগুলোই ইসলামী ইস্যু নয়। সমাজের কোনো মানুষ নির্যাতিত হলে, সেটাও ইসলামী ইস্যু। জনপরিমণ্ডলে গণমানুষের সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো মহৎ কাজও ইসলামী ইস্যু।
মুসলমান হিসাবে আমাদের উচিত জনপরিমণ্ডলে নৈতিক আওয়াজ তোলা। নিপীড়িত-নির্যাতিত ও প্রান্তিক মানুষের পক্ষে কথা বলা। কেবল গায়ের রঙ অথবা পরিচয়ের কারণে যারা সুবিধাবঞ্চিত হয়, তাদের জন্যে কথা বলা। ইসলামে আল্লাহ তায়ালা আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, সকল মানুষ সমান। তাই কিছু মানুষ যখন কেবল গায়ের রঙের কারণে নির্যাতিত হয়, তখন মুসলমান হিসাবে আমাদেরকে তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত; হোক তারা মুসলিম কিংবা অমুসলিম।
এরপর সম্পদের একচেটিয়াত্বের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বলেছেন –
كَىْ لَا يَكُونَ دُولَةًۢ بَيْنَ ٱلْأَغْنِيَآءِ مِنكُمْ
অর্থ: তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যে যাতে ধন-ঐশ্বর্য পুঞ্জীভূত না হয়। (সূরা হাশর: ৭)
সুতরাং যে পদ্ধতিতে কেবল ধনীদের মাঝেই সম্পদ চক্রাকারে ঘুরতে থাকে, সংজ্ঞাগতভাবেই তা অনৈসলামী পদ্ধতি। মুসলমান হিসাবে আমাদেরকে এই পদ্ধতির পরিবর্তন করতে হবে অথবা পরিবর্তনের জন্যে কাজ করতে হবে। এ কারণেই আমরা জাকাত প্রদান করি। এ কারণেই আমাদের অনেক ইবাদত আমরা সম্পদের মাধ্যমে আদায় করে থাকি, যেন সম্পদ কেবল ধনীদের মাঝেই চক্রাকারে ঘুরতে না পারে। কোরআনে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এই পদ্ধতি পরিবর্তন করার জন্যে বলেছেন। মুসলমান হিসেবে আমরা তা করতে বাধ্য।
মুসলমান হিসেবে রাজনীতির ব্যাপারে আমাদেরকে নৈতিক মান সমুন্নত রাখতে হবে এবং যে কোনো ইস্যুতে আমাদেরকে একটা নৈতিক অবস্থান নিতে হবে। কোনো প্রার্থী বা দলের সাথে আমাদের শতভাগ একমত হবার প্রয়োজন নেই। কারণ, ইস্যুভেদে লোকজনের দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা থাকতেই পারে। কিন্তু আমাদেরকে অবশ্যই নৈতিকতা ও ন্যায়ের পক্ষে শতভাগ অবস্থান নিতে হবে। আমরা সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগরিষ্ঠ যাই হই না কেন, মুসলমান হিসাবে এই নৈতিক অবস্থান সর্বদা জারি রাখতে হবে।
প্রিয় ভাই ও বোনেরা, সংখ্যালঘু বিষয়টা মনের ব্যাপার। এটি বাস্তবতা নয়। আপনি যদি উচ্চতর নীতি-নৈতিকতা মেনে চলেন এবং মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবার ক্ষেত্রে যদি একই নীতি-নৈতিকতা বজায় রাখেন, তাহলে আপনি হয়ে ওঠবেন শক্তিশালী সংখ্যালঘু।
ইসলামকে আমরা কোনো বিশেষ জাতি, বর্ণ, ভাষা কিংবা কোনো বিশেষ ব্যাকগ্রাউন্ডের লোকদের এজেন্ডায় ব্যবহৃত হতে দিতে চাই না। ইসলামের এজেন্ডা সবার জন্য। এভাবে ইসলামকে আমরা সবার কাছে তুলে ধরতে পারি। এভাবে যে কোনো সমাজের জন্য ইসলাম ন্যায়, নীতি ও নৈতিকতার পতাকাবাহী হিসেবে পরিচিত হতে পারে। জনজীবনে বাস্তবায়ন করার মতো নৈতিক আদর্শ কোরআনে রয়েছে। ইসলাম আমাদেরকে জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে বলে না। বরং আমাদেরকে স্বার্থপরতা মুক্ত হয়ে জনজীবনে সম্পৃক্ত হতে বলে। স্বার্থপরতা হলো প্রচলিত রাজনৈতিকদের কাজ। তাই আমাদেরকে প্রথমত আল্লাহ্র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে জনজীবনে সম্পৃক্ত হতে হবে এবং নির্যাতিত মানবতার জন্যে কাজ করতে হবে।
মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন। আমাদের ভুলত্রুটিগুলো তিনি ক্ষমা করুন।