বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনের প্রাথমিক কাজ – শহর পরিচ্ছন্ন করা
ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা চায় ইসলামী শরীয়ত বাস্তবায়ন করতে। ইসলামী শরিয়তের আলোচনা করা হয় জ্ঞানের যে শাখায়, তার নাম ফিকহ। ফিকহের সকল গ্রন্থ শুরু হয় পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার আলোচনা দিয়ে। অর্থাৎ, ইসলামী শরিয়ত বাস্তবায়নের জন্যে প্রথম কাজ হলো পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা।
এরদোয়ান ১৯৯৪ সালের ২৭ মার্চ যেদিন ইস্তানবুলের মেয়র হয়েছিলেন, সেদিন রাতের অন্ধকারে তিনি ও তাঁর সমর্থকরা সারা ইস্তানবুল শহরকে আবর্জনামুক্ত করে ফেললেন। ফলে সকালবেলা ইস্তানবুল শহরের লোকজন ঘুম থেকে উঠে অবাক হয়ে গেলেন। এর পর থেকেই সাধারণ মানুষের কাছে এরদোয়ানের জনপ্রিয়তা ও বিশ্বস্ততা বাড়তে শুরু করে।
এক রাতেই ইস্তানবুল শহরকে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন করে ফেলার পরিকল্পনাটি হঠাৎকরে এরদোয়ানের মাথায় আসেনি। এর জন্যে তাকে অনেক প্রস্তুতি নিতে হয়েছিলো। তিনি যখন তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনে অর্থাৎ রেফা পার্টিতে ইস্তানবুল শহরের দায়িত্ব পান, তখন থেকেই তাঁর প্রধান কর্মসূচি ছিলো নিজ নিজ এলাকাকে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন রাখা।
তখন রেফা পার্টির কর্মীদের জন্যে বাধ্যবাধকতা ছিলো যে, কেউ বিস্কুট খেয়ে খালি প্যাকেট রাস্তায় ফেলতে পারবে না, বরং পকেটে রাখবে; এরপর ডাস্টবিনে খুঁজে পেলে সেখানে গিয়ে বিস্কুটের খালি প্যাকেটটা ফেলতে হবে। এভাবে তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের অনেকগুলো নিয়ম ছিলো, যাতে কর্মীরা নিজ নিজ এলাকাকে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন রাখতে পারে। এর ধারাবাহিকতায় ইস্তানবুল শহরকে একরাতে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন করে ফেলা এরদোয়ানের জন্যে সম্ভব হয়ে উঠে।
যাই হোক, বাংলাদেশে যারা ইসলামী রাজনীতি করতে চায়, কিংবা ইসলামী শরিয়ত বাস্তবায়ন করতে চায়, তাঁদের প্রধান কাজ হওয়া উচিত রাজধানী ঢাকা সহ সারা দেশের বড় বড় শহরগুলো পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন করে ফেলা। এটা ইসলামী আন্দোলনের প্রতিটি কর্মীর ঈমানী দায়িত্ব হওয়া উচিত।
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম সহ হাদিসের প্রায় সকল গ্রন্থ শুরু হয়েছে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা নামে একাধিক অধ্যায় দিয়ে। সহীহ বুখারীর প্রথম অধ্যায়ে ওহী, দ্বিতীয় অধ্যায়ে ঈমান, এবং তৃতীয় অধ্যায়ে জ্ঞান, এরপর ৪ টি অধ্যায় পবিত্রতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তারপর, অষ্টম অধ্যায়ে গিয়ে সালাতের কথা বলা হয়েছে।
সহীহ মুসলিমের প্রথম অধ্যায় ঈমান, কিন্তু এরপরেই দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায় পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এবং এরপর সালাতের অধ্যায় এসেছে। সহীহ মুসলিমের একটি হাদিস থেকে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব আরো ভালোকরে বুঝা যায়। রাসূল (স) বলেন –
الطَّهُورُ شَطْرُ الْإِيمَانِ، وَالْحَمْدُ لِلَّهِ تَمْلَأُ الْمِيزَانَ، وَسُبْحَانَ اللَّهِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ تَمْلَآنِ -أَوْ: تَمْلَأُ- مَا بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ، وَالصَّلَاةُ نُورٌ، وَالصَّدَقَةُ بُرْهَانٌ، وَالصَّبْرُ ضِيَاءٌ، وَالْقُرْآنُ حُجَّةٌ لَك أَوْ عَلَيْك، كُلُّ النَّاسِ يَغْدُو، فَبَائِعٌ نَفْسَهُ فَمُعْتِقُهَا أَوْ مُوبِقُهَا
“পবিত্রতা হলো ঈমানের অর্ধেক। “আলহামদুলিল্লাহ” মীযানের পাল্লাকে পরিপূর্ণ করে দেয়। ‘সুবহানাল্লাহ ওয়াল হামদুলিল্লাহ’ আসমান ও জমিনের মধ্যবর্তী স্থানকে পরিপূর্ণ করে দেয়। সালাত হচ্ছে উজ্জ্বল জ্যোতি। সাদকাহ হচ্ছে দলীল। ধৈর্য হচ্ছে জ্যোতির্ময়। আর, কোর’আন হচ্ছে তোমার পক্ষে বা বিপক্ষের প্রমাণ। বস্তুত প্রত্যেক মানুষ সকালে নিজেকে বিক্রি করে দেয়। পরবর্তীতে তাঁর কাজ দ্বারা হয় সে নিজেকে মুক্ত করে, অথবা, নিজেকে ধ্বংস করে”। [সহীহ মুসলিম – ২২৩, মাকতাবায়ে শামেলা]
দেখুন, এখানে রাসূল (স) জিকির করা ও ইবাদাত করার আগেই পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতাকে ঈমানের অর্ধেক বা ঈমানের পূর্বশর্ত বলেছেন। কেবল, হাদিস বা ফিকাহের গ্রন্থে নয়, বরং স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা রাসূল (স)-কে সর্বপ্রথম যে দায়িত্বগুলো দিয়েছিলেন, তার অন্যতম একটি হলো পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা।
প্রথম ওহীর পরপরেই আল্লাহ তায়ালা রাসূল (স)-কে বলেন –
يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ (1) قُمْ فَأَنْذِرْ (2) وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ (3) وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ (4) وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ
“হে বস্ত্রাচ্ছাদিত। উঠ, সাবধান কর। তোমার প্রতিপালকের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর। তোমার পরিচ্ছেদ পবিত্র রাখ। এবং পৌত্তলিকতা পরিহার করো” [সূরা ৭৪/ মুদ্দাচ্ছির – ১ থেকে ৫ আয়াত]
দেখুন, এ আয়াতগুলোতে স্পষ্ট যে, যদি কেউ আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চায়, এবং তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাহলে আগে নিজেকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
ধরুন, আপনি আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করার জন্যে ঢাকা শহরের রাস্তায় বের হলেন, কিন্তু ঢাকার রাস্তায় যত আবর্জনা, ময়লা ও কাদা-পানি রয়েছে, তা থেকে নিজের জামা-কাপড়কে কি পবিত্র রাখা সম্ভব? সম্ভব না। সুতরাং, ঢাকা শহরে ইসলামী শরিয়াহ বাস্তবায়ন করতে হলে আগে ঢাকা শহরকে আবর্জনা মুক্ত করতে হবে।
বাংলাদেশে যারা ইসলামী আন্দোলন করেন বা ইসলামী রাজনীতি করেন, অথবা, ইসলামী শরিয়াহ বাস্তবায়ন করতে চান, তাঁদের প্রথম কাজ হওয়া উচিত, নিজ নিজ এলাকাকে পরিচ্ছন্ন রাখা। যেমন, ঢাকা শহরে যত ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মী আছেন, তাঁরা যদি চান, তাহলে এক বছরের মধ্যে ঢাকা শহরকে অনেক পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন করে ফেলতে পারবেন। এর ফলে ঢাকা শহরে ইসলামী শরিয়ত বাস্তবায়নের প্রথম কাজটি হয়ে যাবে।