| |

এরদোয়ান ও জিয়াউর রহমানের সাথে ইসলামপন্থীদের পার্থক্য

তুরস্কে এরদোয়ান এখন যে রাজনীতি করছেন, সে একই রাজনীতি বাংলাদেশে করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। বলা যায়, এরদোয়ানের চেয়ে বেশি ইসলাম কায়েম করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ।

এরদোয়ান তুরস্কের সংবিধানে এখনো “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” সংযোজন করতে পারেননি, কিন্তু আমাদের জিয়াউর রহমান সংবিধানে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” সংযোজন করেছিলেন।

এরদোয়ান ইসলামি রাজনীতি ছেড়ে সেকুলার রাজনীতি গ্রহণ করেছেন, কিন্তু জিয়াউর রহমান সেকুলার রাজনীতির পাশাপাশি ইসলামি রাজনীতি করার সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। এ ছড়াও জিয়াউর রহমান ধর্ম মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করে সকল মানুষের স্ব স্ব ধর্ম পালনের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করেছেন।

বহুদলীয় রাজনীতি ও গণতন্ত্রের জন্যে এরদোয়ানের চেয়ে জিয়াউর রহমানের অবদান বেশি ছিলো। জিয়াউর রহমান একদলীয় শাসন বা বাকশাল এর পরিবর্তে গণতন্ত্র চালু করেছেন।

এরদোয়ান যেমন তুরস্কে ইসলামি সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে চান, তেমনি জিয়াউর রহমানও বাংলাদেশে ইসলামি সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। তিনি আমাদের জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। তার সময়ে প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান এক গোপন চিঠিতে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি গান ভারতীয় জাতীয় সংগীত। তিনি বাংলাদেশের নাগরিকও নন। হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন কবির লেখা গান জাতীয় সংগীত হওয়ায় মুসলিম উম্মাহ উদ্বিগ্ন। এই গান আমাদের সংস্কৃতির চেতনার পরিপন্থী বিধায় জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন আবশ্যক।’ প্রধানমন্ত্রীর ওই চিঠিতে ‘আমার সোনার বাংলা’র পরিবর্তে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’কে জাতীয় সঙ্গীত করার প্রস্তাব করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর এই চিঠি পেয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ রেডিও, টেলিভিশন এবং সব সরকারি অনুষ্ঠানে প্রথম বাংলাদেশ গানটি প্রচারের নির্দেশনা জারি করে। এ সময় রাষ্ট্রপতির অনুষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি প্রথম বাংলাদেশ গাওয়া শুরু হয়। কিন্তু ১৯৮১ সালে জিয়ার মৃত্যুর পর সেই উদ্যোগ থমকে যায়।[

জিয়াউর রহমান ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার সুযোগ সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু নিজে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার পক্ষে ছিলেন না। ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে এরকম একটি কর্মশালা উদ্বোধনকালে তিনি দলের কর্মীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন, “কোন রাজনৈতিক আদর্শ ধর্মকে ভিত্তি করে হতে পারে না। একটা অবদান থাকতে পারে। কিন্তু ধর্মকে কেন্দ্র করে কখনোই রাজনীতি করা যেতে পারে না। অতীতে আমাদের অভিজ্ঞতা হয়েছে যে ধর্মকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান সময়ে যখনই রাজনীতি করা হয়েছিল সেটা বিফল হয়েছে। কারণ ধর্ম ধর্মই। আমাদের অনেকে আছে যারা আমাদের দেশে যে বিভিন্ন ধর্ম রয়েছে, সেগুলোকে কেন্দ্র করে রাজনীতির পরিবেশ সৃষ্টি করতে চেষ্টা করেন। রাজনীতির রূপরেখা বানাতে চেষ্টা করেন, আমরা বারবার দেখেছি তারা বিফল হয়েছে। ধর্মের অবদান থাকতে পারে রাজনীতিতে, কিন্তু রাজনৈতিক দল ধর্মকে কেন্দ্র করে হতে পারে না। এটা মনে রাখবেন, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।”

একইভাবে, ২০১৮ সালের ২৮ এপ্রিল, এরদোয়ান বলেন, “আমাদের একে পার্টির সংবিধানে স্পষ্ট লিখা রয়েছে, “ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের জন্যে অপরিহার্য। ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হলো আমানত স্বরূপ।” একইসাথে, আমাদের দেশে যারা ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি ইচ্ছেকৃতভাবে বারবার ব্যবহার করে ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ করে, আমরা তাদেরও বিরোধী। মুসলিমদের কথা বাদ দিন, খ্রিস্টান ও ইহুদি থেকে শুরু করে সকল ধর্মের ইবাদাত করার স্বাধীনতা এবং ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালনা করার সুযোগ তুরস্কে কেবল আমরাই প্রথম দিয়েছি। অর্থোডক্স থেকে ক্যাথলিক সকল খ্রিস্টান গ্রুপগুলোকে জিজ্ঞেস করুন, অথবা ইহুদিদের যে কোনো গ্রুপকে জিজ্ঞেস করুন, সবাই আপনাকে বললে, “একে পার্টির সময়ে আমরা সবচেয়ে শান্তিতে ও আরামে আছি”। কারণ, আমাদের সাথে কারো ধর্মীয় বিশ্বাস, ইবাদাত বা চিন্তার বিরোধিতা নেই। আমাদের কাছে শিয়া-সুন্নী বলেও কোনো বিভেদ নেই। যে কোনো মানুষ তাদের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা পাবার জন্যেই আমরা আন্দোলন ও সংগ্রাম করেছি, এবং এখনো করছি। প্রিয় ভাইয়েরা, একটিমাত্র বিষয়ে আমরা আপোষ করি না। তা হলো, আমাদের দেশ ও জাতির বিরুদ্ধাচরণ। বিশেষ করে আমাদের দেশে যে কোনো সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে আমরা। সকল ধর্ম যেন তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী চলতে পারে, এবং তাদের উপাসনা করতে পারে, আমরা সে সুযোগ করে দিয়েছি। এবং একইসাথে এও বলেছি, আপনারাও মুসলিমদের ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরোধিতা করতে পারবেন না। মুসলিমরাও যেনো তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী চলতে পারে। আমরা ধর্মের ভিত্তিতে রাজনীতি করার বিপক্ষে। একইসাথে, যারা অন্যের ধর্ম ও বিশ্বাসের বিরুদ্ধাচরণ করে, আমরা তাদেরও বিরুদ্ধে।”

একই অনুষ্ঠানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরোধিতা করে এরদোয়ান বলেন, “Milletimizin dini hassasiyetlerini örgüt çıkarları için kullananlara karşı en güçlü tavrı biz koyduk. ” অর্থাৎ, যারা আমাদের ধর্মীয় আবেগকে ব্যবহার করে সংগঠন গড়ে তুলেছে, আমরা তাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।” দেখুন https://www.tccb.gov.tr/haberler/410/92592/-ozgurluklerin-herkes-icin-alabildigine-genis-bir-sekilde-yasatilabilmesi-amaciyla-mucadele-ediyoruz-

অন্য একটি আলোচনায় এরদোয়ান বলেন, “”আমরা দল গঠন করা সময়ে একটি কথা বলেছিলাম যে, “একে পার্টি ধর্মভিত্তিক কোনো দল নয়, বরং মানুষ বা জনগণ নির্ভর একটি দল”। দেখুন, একটি বিষয় নতুন করে এখানে আমি আবারো বলছি, যার বিরোধিতা করা লোকও আমাদের দেশে রয়েছে। আমি খুবই স্পট ভাষায় বলছি, ধর্মনিরপেক্ষ হলো সকল ধর্মের লোককে তাদের অধিকার দেয়া, সকল ধর্মের মানুষকে নিরাপত্তা দেয়া। কোনো মানুষ ব্যক্তি হিসাবে ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে না। কিন্তু রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে। কোনো ব্যক্তি একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বললে, সেটাও চলে। কিন্তু, ধর্মনিরপেক্ষকে ইসলামের বিপরীত যখন দাঁড় করানো হয়, তখনি ভুল শুরু হয়। আমার ধর্মনিরপেক্ষ ধারণার বুঝ হলো এটাই।” দেখুন https://www.youtube.com/watch?v=uXycRzYEnWw

অথবা এ বক্তব্যটি দেখুন, বাংলা সাবটাইটেল দেয়া আছে। https://www.youtube.com/watch?v=sy23s6YBBrk&t

দেখুন, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির পক্ষে এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিপক্ষে এরদোয়ান ও জিয়াউর রহমানের কথাকে যদি আমরা মূল্যায়ন করি, তাহলে এরদোয়ানের চেয়ে জিয়াউর রহমানকেই বেশি ইসলামপ্রিয় মনে হয়। এবং সংবিধান পরিবর্তন করার মতো কাজেও এরদোয়ানের চেয়ে জিয়াউর রহমান ও এরশাদ বেশি ইসলামপ্রিয় ছিলেন। এমনকি, দেশের মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিকে ইসলামি ভাবধারায় পরিবর্তনের চেষ্টাও জিয়াউর রহমানের বেশি ছিলো। এরদোয়ানের বর্তমান কাজের জন্যে যদি তাকে তুরস্কের সুলতান বা খলিফা মনে করা হয়, তাহলে আমাদের জিয়াউর রহমান ও এরশাদ আরও বড় সুলতান ও খলিফা ছিলেন।

এবার মূল কথায় আসি। জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও এরদোয়ান – উনারা সবাই ইসলামকে ভালোবাসেন, রাজনীতিতে ইসলামের প্রভাবকে স্বীকার করেন, রাজনীতির মাঝে ইসলামকে প্রবেশ করান, কিন্তু একই সাথে উনারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরোধিতা করেন এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনকে সঠিক মনে করে না।এ সূক্ষ্ম পার্থক্যটা যতদিন আমরা বুঝবো না, ততদিন আমরা ‘পলিটিকাল ইসলাম’-এর ধারনাটাকেও বুঝবো না।

আরো পোস্ট

একটি মন্তব্য লিখুন

আপনার ইমেইল অ্যাড্রেস প্রকাশ করা হবে না। তারকা (*) চিহ্নিত ঘরগুলো পূরণ করা আবশ্যক