কাফের বানানোর সহজ উপায়
এক
পৃথিবীতে সবচেয়ে সহজ কাজ অন্যকে কাফের বানানো। আপনি চাইলে, পৃথিবীর যে কোনো মুসলিমকে এক মিনিটে কাফের বানাতে পারবেন।
যেমন ধরুন, আমি বললাম, “নারীদের মসজিদে যেতে বাধা দেয়া যাবে না, এটা কোর’আন ও হাদিসে নিষেধ করা হয়েছে। অথচ, আধুনিক হুজুররা ফেতনার কথা বলে নারীদের মসজিদে যেতে নিষেধ করে।” এ কথার বিপরীতে, ধরুন, একজন লিখলেন, “আপনি হুজুরদের দোষ দেয়ার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে সাহাবীদেরকে দোষ দিয়েছেন। কারণ, সাহাবীদের কেউ কেউ নারীদের মসজিদে যেতে বারণ করেছিলেন।”
উপরের মন্তব্যটির সমর্থনে তখন আরেকজন এসে লিখলেন, “যারা নারীদেরকে মসজিদে যেতে বলে, তারা সাহাবীদের বিরুদ্ধে কথা বলে। আর, যারা সাহাবীদের বিরুদ্ধে কথা বলে, তারা কাফের।” এভাবে যে কোনো মানুষের যে কোনো কথাকে আপনি নিজ থেকে ব্যাখ্যা করে তাকে কাফের বানিয়ে দিতে পারবেন। এটা খুবই সহজ।
ইবনে সিনার মতে, যারা যুক্তির ব্যবহার জানেন না, তাদের অধিকাংশ সিদ্ধান্ত-ই ভুল হয়।
যেমন, ধরুন, আমি খুব সহজে প্রমাণ করবো – “সুমন সাহেব একটা কুকুর”। কিভাবে?
সুমন সাহেব গরুর হাড় খায়, কুকুরও গরুর হাড় খায়। সুমন সাহেব ও তার কুকুর একই খাবার খায়। তাই, সুমন সাহেব ও তার কুকুরের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। অথবা, আরেকটি যুক্তি হলো, সুমন সাহেব কালো, সুমন সাহেবের বাড়ির কুকুরটাও কালো। তাই, সুমন সাহেব ও তার কুকুর একই ধরণের প্রাণী। এভাবে অসংখ্য ‘যুক্তি’ দিয়ে আপনি প্রমাণ করতে পারবে যে, সুমন সাহেব একটা কুকুর। একইভাবে ‘যুক্তি’ দিয়েই আপনি যে কাউকে প্রমাণ করতে পারবেন যে, সে কাফির। সুতরাং, অন্যকে কাফের বানানোই পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ কাজ।
একটা উদাহরণ দেই। কিছুদিন আগে শবে বরাতের সময়ে এক মুফতি তার ফেইসবুকে লিখেছেন –
//২০শে এপ্রিলের পরিবর্তে যারা আগামী ২১শে এপ্রিল শবে বরাত পালন করবে তারা নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিরোধিতা করার কারণে উম্মত থেকে খারিজ হয়ে যাবে । নাউযুবিল্লাহ !!//
দেখুন, কত সহজে অন্যকে কাফের বানানো যায়। এর চেয়ে সহজ কাজ পৃথিবীতে আর নেই। সামনে আরো অনেক উদাহরণ দিচ্ছি।
দুই
পৃথিবীতে সকল মুসলিমকেই কেউ না কেউ কাফের বলেছে। আবু বকর, উমার, উসমান (রা) এর মতো জান্নাতের সুসংবাদ পাওয়া সাহাবীদেরকেও অনেক শিয়া কাফের বলে। শিয়ারা কেবল মুখে বলে না, কোর’আন-হাদিস থেকে দলীল দিয়েই প্রমাণ করে যে, ঐ সাহাবীগণ কাফের।
খারেজিরা হজরত আলী (রা)-কে কাফের ঘোষণা দিয়ে হত্যা করেছিলো। আলী (রা)-এর বিরুদ্ধে যেসব খারেজি বিদ্রোহ করেছিলেন, তাদের প্রায় সবাই ছিলো কোর’আনে হাফিজ। খারিজিদের মুখে ছিলো লম্বা দাঁড়ি, এবং কপালে ছিলো নামাজের দাগ। খারিজিদের নেতা আবদুল্লাহ ইবনে ওহাব রাসিবী এতো বেশি ইবাদাত ও সিজদা করতো যে, তার সিজদার স্থানসমূহের চামড়া শুকিয়ে গিয়েছিলো।
খারিজিদের মধ্যে যারা আলী (রা)-কে হত্যা করা পরিকল্পনা করেছিলো, তারা আলী (রা)-কে হত্যা করার জন্যে রমাজান মাস আসার অপেক্ষা করেছিলো। তাদের ধারণা ছিলো, রমাজান মাসে একটা কাফির হত্যা করতে পারলে বেশি সাওয়াব পাওয়া যাবে।
কিতাম বিনতে শাজানাহ নামক যে সুন্দরী নারী বলেছেন, “আমাকে বিয়ে করতে হলে আলীকে হত্যা করতে হবে”, সে নারী দিনরাত সারাক্ষণ মসজিদে ইবাদাত-বন্দেগীতে নিমগ্ন থাকতেন।
আলী (রা)-এর হত্যাকারী ইবনে মুলজিম তার সহযোগী শাবীবকে বলেন – “তুমি কি দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ লাভ করতে চাও? যদি চাও, তাহলে আলীকে হত্যা করতে হবে।
ইবনে মুলজিম যখন আলী (রা)-এর মাথায় তলোয়ার দিয়ে আঘাত করছিলো, তখনো সে জোরে জোরে কোর’আনের আয়াত তেলোয়াত করেছিলো। আলী (রা)-কে হত্যা করার সময়ে সে বলছিলো – “আল্লাহ ছাড়া কারোও হুকুম করার অধিকার নেই। হে আলী! তোমারও নেই এবং তোমার অনুসারীদেরও নেই”। হত্যাকারী তখন সূরা বাকারার ২০৭ নং আয়াত পড়ছিলো – “মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে, যে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভার্থে আত্ম-বিক্রয় করে থাকে। আল্লাহ তাঁর বান্দাগণের প্রতি অত্যন্ত দয়ার্দ্র”।
খারিজিদের মূল কাজ হলো, তারা নিজেদেরকে সবচেয়ে ভালো মুসলিম দাবী করে, এবং অন্য সবাইকে কাফির বা ভ্রান্ত ঘোষণা করে। এমন চরিত্রের মানুষ এখনো আমাদের সমাজে বিদ্যমান। খারিজিদের বিরুদ্ধে নাহরাওয়ান যুদ্ধ শেষ করে ফেরার পথে সৈন্যরা আলী (রা)-এর কাছে এসে বলতে লাগলেন, “হে আমীরুল মুমিনীন! সেই আল্লাহর প্রশংসা যিনি খারিজীদের মূলোৎপাটন করে দিয়েছেন”। আলী (রা) তখন তাদেরকে বললেন, “কখনো না, আল্লাহর কসম! তারা অবশ্যই পুরুষ লোকের পৃষ্ঠদেশে এবং মেয়ে লোকের গর্ভে বিদ্যমান আছে। যখন তারা তাদের বাবা-মা থেকে বেরিয়ে আসবে, তখন তাদের সাথে যার-ই সাক্ষাৎ হবে, তার উপর প্রাধান্য বিস্তারের জন্যে তারা ফিতনা সৃষ্টি করতে থাকবে।” আলী (রা)-এর এই ভবিষ্যৎ বাণী আমরা এখনো দেখতে পাই। অনেক মুসলিম নিজেকে বড় মুসলিম হিসাবে প্রমাণ করার জন্যে অন্যদেরকে কাফির ফতোয়া দিতে থাকেন।
যাই হোক, আধুনিক খারিজিরা সবাইকে কাফির বানিয়ে দিলেও, তাদেরকে কিন্তু কাফির-মুনাফিক বলা যাবে না। কারণ, খারিজিরা আলী (রা)-কে কাফির ঘোষণা দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পরেও আলী (রা) খারিজিদেরকে মুশরিক বা মুনাফিক বলতে নারাজ ছিলেন। নাহরাওয়ান যুদ্ধের শেষে সৈন্যরা আলী (রা)-কে জিজ্ঞেস করলেন, “খারিজিরা কি মুশরিক?” আলী (রা) বললেন, “শিরক থেকে বাঁচার জন্যেই তো তারা আলাদা হয়ে গেছে”। সৈন্যরা বললেন, “তাহলে কি তারা মুনাফেক?” আলী (রা) বললেন, “মুনাফিকরা তো খুবই কম আল্লাহকে স্মরণ করে”। তখন সৈন্যরা বললেন, “হে আমীরুল মুমিনীন! তাহলে খারিজিরা আসলে কি?” আলী (রা) বললেন – “তারা আমাদের ভাই। আমাদের বিরুদ্ধে তারা বিদ্রোহ করেছে। সেই বিদ্রোহের কারণেই আমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি।”
বর্তমানে যারা কথায় কথায় অন্যকে ভ্রান্ত বা কাফির বলেন, এবং নিজেদেরকে অতি-ধার্মিক হিসাবে উপস্থাপন করেন, আমি তাদেরকে অনেক ভয় করি। কারণ, রাসূল (স)-বলেছেন – “আমার উম্মতের এমন একদল লোক বের হবে, তারা এমনভাবে কোর’আন তেলোয়াত করবে যে, তাদের তেলোয়াতের কাছে তোমাদের তেলোয়াতকে তুচ্ছ মনে হবে। তারা এমনভাবে সালাত পড়বে যে, তাদের সালাতের কাছে তোমাদের সালাতকে তুচ্ছ মনে হবে। তারা এমনভাবে সাওম পালন করবে যে, তাদের সাওমের কাছে তোমদের সাওমকে তুচ্ছ মনে হবে। তারা মনে করবে, কোর’আন তাদের কল্যাণ ডেকে আনবে, আসলে কিন্তু কোর’আন তাদের অকল্যাণ ডেকে আনবে। তারা এমনভাবে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে, যেমনভাবে তীর তার শিকার ভেদ করে বের হয়ে যায়।”
তিন।
কেবল ইবনে সিনা বা ইবনে আরাবিকে নয়, স্বয়ং ইমাম আবু হানিফাকেও কাফের, বিদায়াতি, মুরজিয়া ইত্যাদি ট্যাগ দিয়েছিলো তাঁর জামানার মোল্লারা।
ইমাম আবু হানিফার যে পাঁচটি ছোট ছোট লেখা পাওয়া যায়, তন্মধ্যে একটি ইমাম আবু হানিফাকে বিভিন্ন ট্যাগ দেয়া প্রসঙ্গে।
উসমান আল বাত্তী নামে আবু হানিফার একজন ছাত্র ছিলো। উসমান যখন আবু হানিফার থেকে পড়াশুনা শেষ করে, বাগদাদ থেকে বসরা গেলেন, তখন বসরার তৎকালীন মোল্লারা বলছিলেন, “তোমার উস্তাদ আবু হানিফা তো মুরজিয়া হয়ে গেছে।”
শিক্ষকের বদনাম শুনে ছাত্র খুব ব্যথিত হলেন। এবং উস্তাদ আবু হানিফার কাছে একটি চিঠি পাঠিয়ে বললেন যে, লোকে বলাবলি করছে আপনি নাকি মুরজিয়া হয়ে গেছেন।
এর জবাবে আবু হানিফা তাঁর ছাত্রকে একটি চিঠি দেন। সেখানে তিনি বলেন –
كتبتَ تذكرُ أنهُ بلغكَ أني من المُرجِئَةِ،.
“তুমি লিখেছো, তুমি নাকি শুনেছো, আমি মুরজিয়া হয়ে গেছি।”
এরপর তিনি লিখেন, “অন্য কেউ তোমাকে পথভ্রষ্ট বললেই যে সে নিজে সৎ পথে আছে, ব্যাপারটা এমন নয়। কোর’আনে বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত সবাইকেই তিনি পথভ্রষ্ট করেন। [সূত্র – ৪/১৭৬]
চার।
ইমাম আবু হানিফা ছাড়াও ইসলামের ইতিহাসে যত ইমাম বা স্কলারের কথা আমরা শুনি, সবাইকেই তাদের যুগের মুফতিরা কাফের ফতোয়া দিয়েছিলেন। যেমন, ইমাম আহমদ বিন হাম্বল বলেছিলেন – “কোর’আন আল্লাহর মতোই আদি ও অনন্ত”। এ কথা বলার কারণে ইমাম আহমদ বিন হাম্বলকে ভ্রান্ত ও কাফির মনে করতো তৎকালীন মুফতিরা। শুধু তাই নয়, ইমাম আহমদ তাঁর এ মত প্রকাশ করার কারণে প্রায় ৩০ মাস তাঁকে কারাগারে আটক রাখা হয়, এবং নির্যাতন করা হয়। এ কাজটি কিন্তু তৎকালীন শাসক খলিফা মামুন তার নিজের ইচ্ছায় করেননি, মুফতিদের ফতোয়ার ভিত্তিতেই ইমাম আহমদকে শাস্তি দেয়া হয়েছিলো।
খলিফা মামুন মারা যারার পর ইমাম আহমদকে খলিফা মুতাসিমের কাছে পাঠানো হয়। খলিফা মুতাসিম ইমাম আহমদের উপর কিছুটা সদয় ছিলেন। কিন্তু, খলিফার দরবারে বসা মুফতি ও মুহাদ্দিসরা ইমাম আহমদের সাথে যুক্তি তর্কে না পেরে খলিফাকে বললেন – “হে আমিরুল মুমিনীন! আল্লাহর কসম! এই ব্যক্তি (ইমাম আহমদ) নিজে ভ্রান্ত, অন্যদেরকে বিভ্রান্ত করে, এবং সে একজন বিদায়াতপন্থী লোক। এখানে আপনার দরবারে অনেক বড় বড় বিচারক, আলেম ও মুফতি রয়েছে। আপনি তাদেরকে জিজ্ঞাস করুন।”
খলিফা মুতাসিম যখন তার দরবারে বসা মুফতি-মাওলানা-শায়েখদের জিজ্ঞাস করলেন, “আহমদ বিন হাম্বলের ব্যাপারে তাদের মতামত কি?” তখন সবাই একসাথে বলেছিলো – “আহমদ বিন হাম্বল আসলেই একজন ভ্রান্ত, বিদায়াতি ও কাফের।”
শুধু তাই নয়, তৎকালীন কিছু মুহাদ্দেছ বা হাদিসের শায়েখ ইমাম আহমদকে এই বলে কটাক্ষ করতেন যে, আহমদ বিন হাম্বল হাদিস জানে না। দুর্বল হাদিস দিয়ে রেফারেন্স দেয়।
ইমাম আহমদকে যেন কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া না হয়, সে জন্যে তৎকালীন মুফতি-মুহাদ্দিস-মাওলানা-শায়েখরা মিলে খলিফা মুতাসিমকে বলেন – “হে আমীরুল মুমিনীন! এই লোকটা কাফির, ভ্রান্ত ও বিভ্রান্তকারী। এটা খেলাফত পরিচালনার নীতি হতে পারে না যে, আপনি তাকে ছেড়ে দিবেন, আর সে দুইজন খলিফার উপর জয়লাভ করবে” -এ কথা শুনার পর খলিফা মুতাসিম ইমাম আহমদের উপর থেকে তার সদয় ভাব উঠিয়ে নেন, এবং ইমাম আহমদকে চাবুক মারার জন্যে আদেশ করেন।
এভাবে প্রতিটি যুগেই ছোট-খাটো মুফতি-মাওলানারা বড় বড় স্কলারদেরকে কাফির, মুরতাদ, বিদায়াতি ও ভ্রান্ত এসব বলতেন। কিন্তু পরবর্তীতে এসব ‘ভ্রান্ত’ স্কলারগণ-ই অমর হয়ে থাকেন।
পাঁচ।
ইসলামের প্রথম চিন্তাবিদদের একজন হাসান আল বসরী। তিনি একজন বিখ্যাত তাবেয়ী ছিলেন। প্রথম যখন তিনি বিভিন্ন বিষয়ে নতুন নতুন চিন্তা উপস্থাপন করতে শুরু করেন, তখন কিছু লোক তাঁর বিরুদ্ধে লেগে গেলেন। লোকেরা তৎকালীন খলিফা আবদুল মালেক মারওয়ানের কাছে অভিযোগ করে বলেন, “হাসান আল বসরী কি সব শুরু করেছে, সে এমন কথা বলছে, যা আমরা কোনো সাহাবীর কাছ থেকে শুনিনি। আপনি হাসান আল বসরিকে ডেকে জিজ্ঞেস করুন, সে কি করছে এসব। সে তো কাফের হয়ে গেছে”
হাসান আল বসরির জ্ঞানকে খুব ভালোবাসতেন খলিফা আবদুল মালেক মারওয়ান। তাই তিনি হাসান আল বসরিকে নিজের বাসভবনে না ডেকে একটি চিঠি লিখলেন।
“আবদুল মালেক বিন মারওয়ান এর পক্ষ থেকে হাসান বসরিকে চিঠি –
সালামুন আলাইকুম। আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি, যিনি ব্যতীত অন্য কোনো উপাস্য নেই।
আমিরুল মুমিনিনের কাছে সংবাদ এসেছে, মানুষের ভাগ্য সম্পর্কে আপনি এমন কিছু কথা বলছেন, যা অতীতের কোনো আলেমের কাছ থেকে কেউ কখনো শুনেনি। আমিরুল মুমিন যত সাহাবীকে জীবিত পেয়েছেন, কোনো সাহাবী থেকেও এমন কোনো কথা শুনেননি, যা আপনি এখন নতুন করে বলছেন। যদিও আপনার ধার্মিকতা ও জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ, এসব বিষয় আমি জানি। তবুও আপনার নতুন নতুন কথাগুলো আমিরুল মুমিনিন পছন্দ করেনি। আপনার চিন্তাগুলো আমাকে লিখে পাঠান। কিসের ভিত্তিতে আপনি এমন কথা বলছেন? এসব কথা রাসূল (স)-এর কোনো সাহাবী থেকে কি আপনি শুনেছেন? নাকি নিজের চিন্তা-ভাবনা থেকে বলছেন? নাকি কোর’আনের কোনো আয়াত থেকে এসব চিন্তা বের করেছেন?
আপনাকে এ বিষয়ে জানানোর আগে আমরা এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা করেছি। কিন্তু, কেউ আপনার চিন্তাগুলো অন্য কারো কাছে আগে শুনেনি। আপনি আমাদের জন্যে বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করে লিখে পাঠান। মাআসসালাম।”
অর্থাৎ, কেউ ইসলাম সম্পর্কে নতুন কোনো চিন্তা হাজির করলেই তাঁকে কাফের বলে দেয়া হতো। এটা নতুন কিছু না, দীর্ঘদিন থেকে এ কালচার চলে আসছে।
ছয়।
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াকে অনেকেই কাফের বলেছেন। এ নিয়ে দুই খণ্ডের একটি বইও রয়েছে। নাম – বারায়াতুল আশয়ারি মিন আকাইদুল মুখালিফিন।
উপরোক্ত বইয়ের লেখক বলেন, বিখ্যাত হাদিস গ্রন্থ বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাকারী ইবনে হাজার আসকালানী তাঁর (الدرر الكامنة) আদ-দুরারুল কামিনা গ্রন্থে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া সম্পর্কে বলেন –
“উমর (রা)-এর তিন তালাকের মাসয়ালাকে এবং আলী (রা)-এর ১৭টি মাসয়ালাকে কোর’আনের বিরুদ্ধে বলেছেন ইবনে তাইমিয়া। ইবনে তাইমিয়ার মতে, আবু বকর (রা) এমন বয়সে ঈমান আনলেন যে তিনি কি বলতেন, নিজেও বুঝতেন না। আলী (রা) এমন ছোট বয়সে ঈমান এনেছেন, তাঁর বয়সী বাচ্চাদের ঈমান আনাকে ঈমান ধরা হয় না। ইবনে তাইমিয়ার মতে, আলী (রা) মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আবু জাহেলের মেয়েকে বিয়ে করার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। এ কারণে আলিমগণ ইবনে তাইমিয়াকে মুনাফিক বলেছিলেন। ইবনে তাইমিয়া হজরত উসমান (রা)-কে সম্পদের আগ্রহী ব্যক্তিও বলেছিলেন।”
সূত্র – বারায়াতুল আশয়ারি মিন আকাইদুল মুখালিফিন, পৃষ্ঠা ৪১০
উপরোক্ত গ্রন্থে দেখানো হয়েছে, অসংখ্য আলেম ইবনে তাইমিয়াকে কাফের ফতোয়া দিয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত থেকে বের করে দিয়েছেন।
সাত।
এতক্ষণ পড়তে পড়তে যারা বিরক্ত হয়ে গেছেন, তাদের জন্যে একটা কৌতুক বলি –
এক লোক ব্রিজ থেকে পড়ে মারা যাবে, এমন সময় A এসে বলল, আরে… আরে… কর কি? এমন করো না।
B – না, আমি আত্মহত্যা করব। কেউ আমাকে ভালোবাসে না।
A – আচ্ছা, তুমি কি মুসলিম?
B – হুম।
A – ওয়াও, আমিও মুসলিম। কিন্তু, তুমি শিয়া না সুন্নি?
B – সুন্নি।
A – আমিও সুন্নি। কিন্তু তুমি আহলে হাদিস না মাজহাবী?
B – মাজহাবী।
A – ভালো, আমিও। কিন্তু, তুমি হানাফি, শাফেয়ী, মালিকি না হাম্বলী?
B – হানাফি।
A – আমিও হানাফি। কিন্তু, দেওবন্দী না বেরলভী?
B – বেরলভী।
A – বেশ ভালো, আমিও বেরলভী। কিন্তু, তুমি তানজীহি না তাফকীরি?
B – তানজিহী।
A – ওয়াও, আমিও তাই। কিন্তু, তুমি ‘তানজীহি আজমাতি’ না ‘তানজীহি ফারহাতি’?
B – তানজীহি ফারহাতি।
A – আমিও। কিন্তু, তুমি ‘তানজীহি ফারহাতি জামিউল উলুম আজমীর’ না ‘তানজীহি ফারহাতি জামিউন নুর মেয়াত’?
B – তানজীহি ফারহাতি জামিউন নুর মেয়াত।
A – হায় হায়। তুই তো কাফির। যা মর গিয়ে, তোকে আমি বাঁচাতে পারব না।
আট।
ইবনে সিনাকে ইমাম গাজালি পথভ্রষ্ট বলেছেন। ইমাম গাজালিকে ইবনে তাইমিয়া পথভ্রষ্ট বলেছেন। ইবনে তাইমিয়াকে ইবনে হাজার আসকালানী পথভ্রষ্ট বলেছেন। এভাবে ইমাম আবু হানিফা, শাফেঈ, আহমদ বিন হাম্বল সহ সকল ইমামকেই অন্য ইমাম কোনো না কোনো কারণে পথভ্রষ্ট বলেছেন।
কেউ কাউকে পথভ্রষ্ট বললেই কেউ পথভ্রষ্ট হয়ে যায় না। কে পথভ্রষ্ট, আর কে হেদায়াত প্রাপ্ত, তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। পৃথিবীতে এমন কোনো মানুষ নেই, যিনি বিতর্কিত নন। পৃথিবীতে এমন কোনো দল নেই, যাকে অন্য একটি দল বাতিল ফেরকা বলে না। সুতরাং, কে কাকে কাফির বললো, আর কে কাকে বাতিল ফতুয়া দিলো, তা দেখে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।
নবী-রাসূলগণ হলেন সত্যের একমাত্র মাপকাঠি। বাকি অন্য কোনো মানুষ কিংবা অন্য কোনো দলের মধ্যে পূর্ণ সত্য পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু সবার মধ্যেই আংশিক সত্য রয়েছে। আমাদের কাজ হলো সবার থেকে সত্য অনুসন্ধান করে নিজের সত্যকে পূর্ণ করার চেষ্টা করা, যদিও পরিপূর্ণ সত্য কখনোই কেউ অর্জন করতে পারে না।
নয়।
বাংলাদেশে দেখলাম এক সালাফী আলেম ইবনে সিনাকে কাফের ঘোষণা করেছেন। এটা নতুন কিছু নয়। যেখানে সাহাবীদেরকে কাফের ঘোষণা করে হত্যা করা হয়েছে, সেখানে ইবনে সিনা এমন কি আর?
আধুনিক সালাফীদের কাছে ইবনে সিনার গুরুত্ব না থাকতে পারে, কিন্তু পশ্চিমা দার্শনিকদের সাথে মোকাবেলা করতে হলে ইবনে সিনাকে আমাদের খুবই প্রয়োজন।
যেমন, ফরাসি দার্শনিক রনে দেকার্ত বলতেন – “I think therefore I am” অর্থাৎ, আমি চিন্তা করতে পারি, কারণ “আমি” বলে একটি জিনিসের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না।
রনে দেকার্তের আগে মুসলিম দার্শনিক ইবনে সিনাও একই কথা বলেছেন, তবে আরো সুন্দর করে। ইবনে সিনা বলেছিলেন – “”I think therefore Allah is” অর্থাৎ, আল্লাহর অস্তিত্ব আছে বলেই আমি চিন্তা করতে পারি।
এভাবে পশ্চিমা দর্শনের মোকাবেলা করার জন্যে ইবনে সিনাকে আমাদের খুব প্রয়োজন। অনেকে মনে করেন, ইবনে সিনার ‘কিতাবুত তিব’ বইটা ছাড়া আর কোনো বই নেই। আসলে ইবনে সিনার দর্শনের উপর অনেক প্রয়োজনীয় বই আছে, যা আমরা জানি না। ইবনে সিনার “আল ইশারাত”, II) “উয়ুনুল হিকমাহ”, III) “কিতাবুন নফস”, iv) ‘আশ শিফা’ বইগুলো চিন্তা চর্চার জন্যে এখনো আমাদের প্রয়োজন।
ইবনে খালদুন নিজের চিন্তা চর্চার জন্যে তার বইয়ের অনেক স্থানে ইবনে সিনার উদ্দৃতি দিয়েছেন, যদিও কিছু কিছু স্থানে আবার ইবনে সিনার বিরোধিতাও করেছেন।
যেমন, দর্শন যে মানুষের সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না, সেটাও ইবনে সিনা বলেছেন। ইবনে সিনা তাঁর আল মাবদা ওয়াল মাআদ’ (المبدأ و المعاد) বইতে দর্শনের সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা বর্নণা করেছেন। সে কথাগুলো ইবনে খালদুন নিজের ভাষায় তাঁর মুকাদ্দিমায় তুলে ধরেছেন –
إن المعاد الروحاني و أحواله هو مما يتوصل إليه بالبراهين العقلية و المقاييس لأنه على نسبة طبيعية محفوظة و وتيرة واحدة فلنا في البراهين عليه سعة. و أما المعاد الجسماني و أحواله فلا يمكن إدراكه بالبرهان لأنه ليس على نسبة واحدة و قد بسطته لنا الشريعة الحقة المحمدية فلنظر فيها و ليرجع في أحواله إليها
(রুহের পুনরুত্থান ও তার অবস্থাসমূহ যুক্তি-বুদ্ধি ও অনুমানের দ্বারা বোঝা যায়। কিন্তু দেহের পুনরুত্থান ও তার অবস্থানসমূহ যুক্তি-বুদ্ধি ও অনুমানের দ্বারা বোঝা যায় না। সুতরাং, এসব বিষয়ে জানার জন্যে মুহাম্মদ (স)-এর সত্যধর্ম আমাদের নিকট যে বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরেছে, আমাদের উচিত সেদিকে নজর দেয়া।)
ইবনে সিনার উপরোক্ত কথার ভিত্তিতে ইবনে খালদুন বলেছেন যে, দর্শন সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। দর্শনের উপকারী এবং অপকারী উভয় দিক রয়েছে।
যাই হোক, পশ্চিমা দার্শনিকদের যেমন কান্ট বা হেগেলের কোনো কথা আমরা যদি বুঝি না, তখন আমরা ভাবি, লোকটা খুব জ্ঞানী কথা বলতেছেন, কিন্তু আমি বুঝতেছিনা।
অন্যদিকে মুসলিম দার্শনিকদের যেমন ইবনে সিনা বা ইবনে আরাবির কোনো কথা যদি আমরা না বুঝি, তখন আমরা বলি, উনারা তো কাফের ছিলেন। আমরা আমাদের নিজের অযোগ্যতা ঢাকার জন্যে অন্যকে কাফের ঘোষণা দিয়ে থাকি।
পৃথিবীতে তিন ধরণের মানুষ নিজেদের অযোগ্যতা ঢাকার জন্যে অন্য মানুষকে ট্যাগ লাগিয়ে দেয়।
১। মূর্খ ধার্মিক – নিজের অযোগ্যতা ঢাকার জন্যে অন্যকে বলবে কাফির।
২। সরকার – নিজের অযোগ্যতা ঢাকার জন্যে অন্যকে বলবে রাষ্ট্রদ্রোহী।
৩। আধুনিক মানুষ – নিজের অযোগ্যতা ঢাকার জন্যে অন্যকে বলবে পশ্চাৎপদ।
দশ
ইসলামের মধ্যে যখন বিভিন্ন মতবাদ সৃষ্টি হতে শুরু করলো – কেউ খারেজি, কেউ মুতাজিলা, কেউ শিয়া মতবাদ নিয়ে বিভক্ত হতে লাগলো, তখন নতুন আরেকটি চিন্তার প্রসার ঘটলো। এর নাম – ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত’।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আলেমরা তখন বলতে লাগলেন –
“যে কোনো মুসলিম যদি কাবার দিকে ফিরে নামাজ পড়ে, তাহলে সে আমাদের দলভুক্ত হিসাবে বিবেচিত হবে। এবং আমরা তাকে কাফের, ভ্রান্ত বা ফেরকা বলে ফতোয়া দিব না।”
অনেকেই নিজেকে হানাফি বলেন, কিন্তু, আবু হানিফার মূলনীতি মানেন না। ইমাম আবু হানিফার মূলনীতি হলো কোনো মুসলিমকেই কাফের বলা যাবে না। তিনি বলেন –
“কোনো পাপের কারণে আমরা কোনো মুসলিমকে কাফির বলবো না, যদিও তিনি কবিরা গুনাহ করেন, এবং যতক্ষণ না তিনি কবিরা গুনাহকে হালাল মনে করেন। কবিরা গুনাহ করা ব্যক্তির ঈমান নেই, এ কথাও আমরা বলবো না। বরং, আমরা তাকে প্রকৃত মুমিন হিসাবেই নাম দিবো। কোনো মুমিন ব্যক্তি (সর্বোচ্চ) ফাসেক হতে পারে, কিন্তু কাফের হতে পারে না।” [ফিকহুল আকবর]
একবার ইমাম আবূ হানীফা (র) তাঁর পুত্র হাম্মাদকে তর্কে লিপ্ত দেখে বারণ করেন। তখন হাম্মাদ তাঁকে বললেন, “আপনিও তো তর্ক করেন, অথচ আমায় কেন বারণ করেন!”
তখন ইমাম আবূ হানিফা পুত্রকে বললেন, “আমি তর্কের সময় গভীরভাবে এ বিষয়ের উপর দৃষ্টি রাখি যে, বিরোধী পক্ষ যেন এ সব থেকে বিরত থাকে। আর তোমরা তর্ক করার সময় তোমাদের উদ্দেশ্য থাকে কিভাবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল ও লজ্জিত করা যায়।
যারা নিজের প্রতিপক্ষকে ঘায়েল কিম্বা লজ্জিত করার ইচ্ছা রাখে, তারা মূলত তাদের প্রতিপক্ষকে কাফির বানানোর ইচ্ছা পোষণ করে। আর যে ব্যক্তি অন্যকে কাফির বানাতে চায়, সে-ই আগে কাফির হয়ে যায়।”
এগারো।
এরদোয়ান একবার মসজিদের ইমাম সাহেবদের উদ্দেশ্যে বলেন –
প্রিয় ভাইয়েরা, মানুষকে ভয় প্রদান করবেন না, সুসংবাদ প্রদান করুন। আমাদের এই প্রোগ্রামে কোনো ইমাম সাহেব থাকলে কিছু মনে করবেন না।
জুমার নামাজ বা ঈদের নামাজ পড়ার জন্যে মানুষ যখন মসজিদে আসেন, তখনি ইমাম সাহেবরা শুরু করেন –“কেন মসজিদে আসলেন? গতকাল মসজিদ খালি ছিলো, আর আজকে মসজিদে জায়গা হচ্ছে না। গতকাল আপনারা কোথায় ছিলেন? আপনারা এক ঈদ থেকে আরেক ঈদ পর্যন্ত, এক জুমা থেকে আরেক জুমা পর্যন্ত যদি মসজিদে না আসেন, তাহলে আপনাদের আসার দরকার নেই”।
আবার কিছু কিছু ইমাম সাহেব খুতবা দিতেই বসেই শুরু করেন – “এই যে বেপর্দা নারীরা! তারা তো সবাই জাহান্নামী। কোনো নারীর যদি একটা চুলও দেখা যায়, তাহলে সে ৪০ বছর জাহান্নামে থাকতে হবে। আর, আপনারা যারা নিয়মিত নামাজ পড়েন না, আপনারাও জাহান্নামে যাবেন। যারা রোজা রাখেন না, তারাও জাহান্নামে যাবেন”।
মনে রাখা প্রয়োজন, আমরা মুসলিম। আমাদের কথাগুলোও সবচেয়ে সুন্দর হওয়া উচিত। একজন ইমাম সাহেব যদি এভাবে বলতেন যে, “পর্দা করা নারীরা জান্নাতে যাবে। নামাজ-রোজা করা মানুষেরা জান্নাতে যাবে”। তাহলে কথাগুলো কতই না সুন্দর হতো!
ইমাম সাহেবরা কেন আল্লাহর জান্নাতকে নিজেদের সম্পত্তি বানিয়ে ফেলেন?
মসজিদের ইমাম সাহেব কেবল ‘জাহান্নাম-জাহান্নাম’ বলে। এ কারণে সাধারণ মানুষেরা বলেন – “আচ্ছা, ঠিক আছে, আমরা মসজিদে না গিয়ে কোনো পীরের দরবারে যাবো। কারণ, পীর সাহেব তো জাহান্নামের ভয় দেখান না, বরং জান্নাতের কথা বলেন, এবং জান্নাতে যেতে সাহায্য করবেন বলে আশা দেন।”
প্রিয় ভাইয়েরা, মানুষকে ভয় প্রদান করবেন না, বরং সুসংবাদ প্রদান করুন। নিজেকে বিচারকের স্থানে রাখবেন না এবং মানুষকে শুধু শুধু বিচার করবেন না; বরং মানুষকে ক্ষমা করে দিন। আমরা বিচারক নই, আমরা সত্যের পথে আহবান কারী। কাউকে বলবেন না যে, ‘সে কাফির’, ‘সে মুশরিক’, ‘সে মুনাফিক’, এসব বলার অধিকার আমাদের নেই। এসব বলার অধিকার একমাত্র সব বিচারকের বড় বিচারক আল্লাহ তায়ালার। আমরা কেবল ভালোর দিকে মানুষকে ডাকবো, কেবল সৌন্দর্যের দিকে মানুষকে ডাকবো।”
বারো।
সিলেটের মাওলানা হাবিবুর রহমান (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন –
“আপনারা মৌলভীরা যাদেরকে বাতিল-কাফির ফতোয়া দেন, কেয়ামতের দিন আপনারদের ফতোয়া দেখে দেখে আল্লাহ কাউকে বেহেস্তে দেবেন না। অনেককেই আল্লাহ তায়ালা বেহেস্তে দিয়ে দিবেন, যাদেরকে আপনারা বেইমান বলতেছেন। আল্লাহ জানেন কার ঈমান কতটুকু আছে। এইজন্যে আমরা আল্লাহকে ভয় করি, এবং কাউকে খোঁচাখুঁচি না করি। কাউকে নগণ্য মনে না করি। সকলকেই ভালো মনে করতে হবে”।
তেরো।
কোরআন-হাদীস দিয়ে অন্যকে ভ্রান্ত প্রমাণের চেষ্টা আমাদের যুগে যেমন আছে, তেমনি রাসূলের যুগেও ছিলো। কেউ কেউ কথায় কথায় অন্যকে মুনাফিক বলে গালি দিতো। কিন্তু রাসূল (স) কঠোরভাবে তা নিষেধ করতেন।
রাসূলের যুগের একটি ঘটনা। একবার রাসূল (স) বললেন, ‘মালিক ইবন দুখাইশিন কোথায়? অথবা বললেন ‘ইবন দুখশুন’ কোথায়? তখন একজন জওয়াব দিলেন, সে মুনাফিক। সে মহান আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলকে ভালবাসে না। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: এরূপ বলো না। তুমি কি দেখছ না যে, সে আল্লাহর সন্তোষ লাভের আশায় ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলেছে? তখন সে ব্যক্তি বললেন: আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। আমরা তো তাঁর সম্পর্ক ও হিত কামনা মুনাফিকদের সাথেই দেখি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: আল্লাহ তা’আলা তো এমন ব্যক্তির প্রতি জাহান্নাম হারাম করে দিয়েছেন, যে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে।(বুখারী, ইফা, ৪১৩)
দেখুন, রাসূলের ভালোবাসার দোহাই দিয়ে যদিও কেউ কেউ এক ব্যক্তিকে মুনাফিক বানানোর চেষ্টা করেছেন, কিন্তু রাসূল তাতে বাধা দিলেন।
চৌদ্দ
কোর’আনে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের সৃষ্টি ও পুনরুজ্জীবন একটি মাত্র প্রাণের সৃষ্টি ও পুনরুজ্জীবনের মতই” [সূরা লোকমানে : ২৮]
কোর‘আনের এই আয়াতটির আলোকে সহজেই কল্পনা করা যায় যে, সমগ্র মানবসত্তা একটিমাত্র সত্তার মতই। আমাদের শরীরের কোনো অংশই আমাদের শত্রু নয়। কিন্তু যখন এর কোনো অংশ পচে যায়, তখন তাকে আর শরীরের সাথে রাখা যায় না, কেটে ফেলতে হয়। এই কেটে ফেলা আনন্দের নয়; বেদনার। যে কাউকে কাফের ঘোষণা করাও এমন বেদনার। শরীরের পচা অংশকে ভালো করার মতো কোনো কাফেরকে যত্ন করে মুসলিম হিসাবে গড়ে তোলাও সম আনন্দের।
একটা উদাহরণ দিয়ে শেষ করছি –
ইসলাম গ্রহণ করার পূর্বে মোহাম্মদ আসাদ ছিলেন মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক একজন সাংবাদিক। তাই তাকে সিরিয়া, ইরাক, ও আফগানিস্তান সহ বহু দেশে ভ্রমণ করতে হতো। এ কারণে তাকে আরবি ও ফার্সি ভাষাও শিখতে হয়েছে। তিনি সাধারণত রাস্তার মানুষদের কাছ থেকেই ভাষা শিখতেন।
একবার আফগানিস্তানের এক লোকের সাথে তিনি কথা বলছিলেন। আফগান লোকটি মুহাম্মদ আসাদকে বললেন – “তুমি কি মুসলিম?”
আসাদ বললেন – “না”।
তখন আফগান লোকটি বললেন – “You are Muslim, only you don’t know it. One day you will came to know it” অর্থাৎ, “তুমি মুসলিম, কিন্তু তুমি তা জানো না। একদিন তুমি তা জানবে।” এ কথাটি মোহাম্মদ আসাদের হৃদয়কে এমনভাবে নাড়া দিয়েছিলো যে, তিনি এর কয়েক মাস পরেই মুসলিম হয়ে গিয়েছিলেন। আসাদের কাছে এ কথাটি নবীদের কথার মতো মনে হয়েছিলো।
আমরা মুসলিমদেরকে কাফির ও মুনাফিক বলে তাকে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে দেই, কিন্তু ঐ আফগান লোকটি একজন ইহুদি লেউপল্ডকেও মুহাম্মদ আসাদ বানিয়ে দিয়েছিলেন।
রাসূল (স) কাফিরদেরকে এক এক করে মুসলিম বানিয়েছেন। আর আমরা মুসলিমদেরকে এক এক করে কাফের বানাই।
7 September 2019 at 13:10 · Public