|

অন্যকে কি মুনাফিক বলা যায়?

মুনাফিকের আলামতগুলো কেন দেয়া হয়েছে? অন্যকে মুনাফিক হিসাবে চিহ্নিত করার জন্যে? নাকি নিজেকে যাচাই করার জন্যে?

রাসূল সা মুনাফিকের চারটি আলামত বলেছেন। কোথাও কোথাও চারটির কম বা বেশিও বলেছেন। যাই হোক, আলামতগুলো হলো:

১. আমানত রাখা হলে খেয়ানত করে
২. কথা বললে মিথ্যা বলে
৩. চুক্তি করলে ভঙ্গ করে এবং
৪. বিবাদে লিপ্ত হলে অশ্লীল গালি দেয়।
(বুখারী, ইফা, ৩৩)

এখন প্রশ্ন হলো, এই আলামতগুলো কি অন্যকে চিহ্নিত করার জন্যে? নাকি নিজেকে যাচাই করার জন্যে?

ধরুন, কেউ ওয়াদা ভঙ্গ করলো। আপনি তাকে বললেন, সে মুনাফিক। কিন্তু আপনি বা আমি, আমরা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবো যে, আমরা প্রতিদিন অন্য মানুষকে যত ওয়াদা ও আশা দিচ্ছি, সব পালন করতে পারছি? আমরা কি আমাদের বাবা-মাকে দেওয়া সব কথা পালন করতে পারছি? আমরা কি আমাদের সন্তানদেরকে দেওয়া সব কথা পালন করতে পারছি? আমরা কি আমাদের অফিসের বস বা কর্মকর্তাকে দেওয়া সব কথা পালন করতে পারছি? আমরা কি কারো থেকে টাকা ধার নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে ফিরিয়ে দিতে পারছি? আমরা কি আমাদের আশে-পাশের মানুষকে দেওয়া সবগুলো কথা পরিপূর্ণভাবে পালন করতে পারছি?

আমরা মানবজাতি দুর্বল প্রাণী। আমরা সব সময়ে কথা দিয়ে কথা রাখতে পারি না নানা সামাজিক বাস্তবতার কারণে। তাই অন্যকে ওয়াদাভঙ্গের জন্যে মুনাফিক বলার আগে নিজেকে যাচাই করা প্রয়োজন, নিজে কতটা মুনাফিক।

একবার হাতিব রা রাসূল স-এর কিছু গোপন সংবাদ কুরাইশ কাফিরদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হে হাতিব! একি ব্যাপার?’ হাতিব বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার ব্যাপারে কোন তড়িত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন না। মূলত আমি কুরাইশ বংশীয় লোক ছিলাম না। তবে তাদের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম। আর যারা আপনার সঙ্গে মুহাজিরগণ রয়েছেন, তাদের সকলেরই মক্কাবাসীদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। যার কারণে তাঁদের পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদ নিরাপদ। তাই আমি চেয়েছি, যেহেতু আমার বংশগতভাবে এ সম্পর্ক নেই, কাজেই আমি তাদের প্রতি এমন কিছু কুফরী কিংবা মুরতাদ হওয়ার উদ্দেশ্যে করি নি এবং ইসলাম গ্রহণের পর পুন কুফরীতে প্রত্যাবর্তন করার প্রতি আকৃষ্ট হবার কারণেও নয়’।

তখন উমর (রা:) বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে অনুমতি দিন, আমি এই মুনাফিকের গর্দান উড়িয়ে দেই’। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘সে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। সম্ভবত তোমার হয়ত জানা নেই, আল্লাহ্ তা‘আলা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের ব্যাপারে অবহিত আছেন। তাই তাদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, তোমরা যা ইচ্ছা আমল কর। আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছি’। (বুখারী, ইফা, ২৭৯৯)

দেখুন, একজন লোক যখন কোনো অন্যায় করে ফেলে, তখন রাসূল সা তাঁর থেকে জানতে চান, কেন তিনি এমন করেছেন। যদি তাঁর কাজের পক্ষে কোনো ভালো যুক্তি থাকে, তাহলে তিনি তাকে ক্ষমা করে দিতেন। কিন্তু আমরা মানুষকে তার আত্মপক্ষে যুক্তি দেখানোর সুযোগ না দিয়ে সবাইকে মুনাফিক বলতে থাকি।

আবদুল্লাহ‌ ইবনু উমর (রা:) থেকে বর্ণিত, আবদুল্লাহ‌ ইবনু উবাই (মুনাফিক সর্দার) এর মৃত্যু হলে তার পুত্র (যিনি সাহাবী ছিলেন) নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে বললেন, আপনার জামাটি আমাকে দান করুন। আমি তা দিয়ে আমার পিতার কাফন পরাতে ইচ্ছা করি। আর আপনি তার জানাযা পড়াবেন এবং তার জন্য মাগফিরাত কামনা করবেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের জামাটি তাঁকে দিয়ে দিলেন এবং বললেন: আমাকে সংবাদ দিও, আমি তার জানাযা আদায় করব। তিনি তাঁকে সংবাদ দিলেন। যখন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জানাযা আদায়ের ইচ্ছা করলেন, তখন উমর (রা:) তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, আল্লাহ কি আপনাকে মুনাফিকদের জানাযা আদায় করতে নিষেধ করেন নি? তিনি বললেন: আমাকে তো দু’টির মধ্যে কোন একটি করার ইখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। (আল্লাহ তা’আলা বলেছেন) আপনি তাদের (মুনাফিকদের) জন্য মাগফিরাত কামনা করুন বা মাগফিরাত কামনা না-ই করুন (একই কথা) আপনি যদি সত্তর বারও তাদের জন্য মাগফিরাত কামনা করেন; কখনো আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন না। কাজেই তিনি তার জানাযা পড়লেন, তারপর নাযিল হল: “তাদের কেউ মারা গেলে কখনও আপনি তাদের জানাযা আদায় করবেন না।” (বুখারী, ইফা, ১১৯৫)

জাবির ইবনু আবদুল্লাহ‌ (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবদুল্লাহ‌ ইবনু উবাই (মুনাফিক সর্দারকে) কবর দেওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার (কবরের) কাছে আসলেন এবং তিনি তাকে বের করার নির্দেশ দিলে তাকে (কবর থেকে) বের করা হল। তখন তিনি তাকে তার (নিজের) দু’ হাঁটুর উপরে রাখলেন, নিজের (মুখের) লালা (তার উপরে ফুঁকে) দিলেন এবং নিজের জামা তাকে পরিয়ে দিলেন। আল্লাহ সমধিক অবগত। সে আব্বাস (রা:) কে একটি জামা পরতে দিয়েছিল। আর সুফিয়ান (রহঃ) বলেন, আবূ হুরায়রা (রা:) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরিধানে তখন দু’টি জামা ছিল। আবদুল্লাহ‌ (ইবনু উবাই) এর পুত্র [আবদুল্লাহ‌ ইবনু আবদুল্লাহ‌ (রহঃ)] বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার (পবিত্র) দেহের সাথে জড়িয়ে থাকা জামাটি আমার পিতাকে পরিয়ে দিন। সুফিয়ান (রহঃ) বলেন, তারা মনে করেন যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জামা আবদুল্লাহ‌ (ইবনু উবাই) কে পরিয়ে দিয়েছিলেন, তার কৃত (ইহসানের) বিনিময় স্বরূপ। (বুখারী, ইফা, ১২৬৮)

দেখুন, একজন মুনাফিকের বিরুদ্ধে কোরআনের আয়াত নাযিল হলো, সে মুনাফিক ইসলামের অনেক ক্ষতি করলো, সকল সাহাবী তাকে মুনাফিক হিসাবে চিনতো, তবু তার জন্যে রাসূলের কত দয়া ছিলো। কিন্তু আমাদের কাছে কোরআন নাযিল হয় না, আমরা নিশ্চিতভাবে কাউকে মুনাফিক হিসাবে জানার কোনো সুযোগ নেই, তবু আমরা মানুষকে মুনাফিক বলে তার বিরুদ্ধে কতটা ঘৃণা চর্চা করি।

আবূ মাস’ঊদ (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন সাদকার আয়াত অবতীর্ণ হল তখন আমরা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে বোঝা বহন করতাম। এক ব্যক্তি এসে প্রচুর মাল সাদকা করলো। তখন কিছু লোক (মুনাফিকরা) বলতে লাগল, এ ব্যক্তি লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে দান করেছে, আর এক ব্যক্তি এসে সা’ পরিমাণ দান করলে তারা বললো, আল্লাহ তো এ ব্যক্তির এক সা’ থেকে অমুখাপেক্ষী। এ প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হয়: মু’মিনগণের মধ্যে যারা নিজ ইচ্ছায় সাদকা দেয় এবং যারা নিজ শ্রম ব্যতিরেকে কিছুই পায় না তাদেরকে যারা দোষারোপ করে …… (৯:৭৯) (বুখারী, ইফা, ১৩৩২)

এ হাদীস থেকে আমরা দেখি, অনেকেই নিজের মুনাফিকির খবর না নিয়ে অন্যের দোষ ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এসব লোকের বিরুদ্ধে পরবর্তীতে আল্লাহ আয়াত নাযিল করে তাদের সতর্ক করেন।

রাসূল সা বলেছেন, ” মুসলিমকে গালি দেওয়া ফাসিকী এবং তার সাথে লড়াই করা কুফরী।” (বুখারী, ইফা, ৪৬)

এ হাদীস দ্বারা স্পষ্ট যে কোনো মুসলিমকে মুনাফিক বা অন্য কিছু বলে গালি দেয়া যাবে না। কেউ যদি অন্য মুসলিমকে গালি দেয়, তাহলে নিজেই ফাসিক হয়ে যায়।

হাদীসে এসেছে –

ইতবান রা বলেন, আমার বাড়ীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আগমনের সংবাদ শুনতে পেয়ে মহাল্লার লোকেরা আমার বাড়িতে এসে ভিড় জমালেন। তাঁদের একজন বললেন, মালিক ইবনু দুখায়শিন্‌ করল কি? তাঁকে দেখছি না যে? তখন একজন জবাব দল, সে মুনাফিক! আল্লাহও তাঁর রাসূলকে মুহাব্বাত করে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন: এমন কথা বলবে না। তুমি কি লক্ষ্য করছ না, যে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনায় ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ উচ্চারণ করছে। সে ব্যক্তি বলল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই সমধিক অবগত। তবে আল্লাহর কসম! আমরা মুনাফিকদের সাথেই তার ভালবাসা ও আলাপ-আলোচনা দেখতে পাই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন: আল্লাহ পাক সে ব্যক্তিকে জাহান্নামের জন্য হারাম করে দিয়েছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ উচ্চারণ করে। (বুখারী, ইফা, ১১১৪, এবং ৪১৩)

এ হাদীস থেকে স্পষ্ট যে, কেউ কেবল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বললে, তাকে আর কেউ মুনাফিক বলতে পারবে না। রাসূল স অন্যকে মুনাফিক বলতে নিষেধ করেছেন এ হাদিসটা দ্বারা।

হুজাইফা রা বর্ণনা করেন,
عن حذيفة رضي الله عنه قال: دعي عمر، لجنازة، فخرج فيها أو يريدها فتعلقت به فقلت: اجلس يا أمير المؤمنين، فإنه من أولئك، فقال: «نشدتك الله أنا منهم» ، قال: «لا ولا أبرئ أحدا بعدك»
[مسند البزار = البحر الزخار 7/ 293]
“একবার উমার রা এক লোকের জানাজা পড়তে যাচ্ছিলেন। তখন হুজাইফা রা উমার রা-কে বললেন, বসুন! হে আমিরুল মুমিনিন। সে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত। উমার রা হুজাইফা রা-কে বললেন, আল্লাহর দোহাই লাগে বলো তো, আমি কি তাদের মধ্যে? না, তবে এ কথা আপনি ছাড়া আর কাউকে জানাবেন না।”

আবু বরক রা, উমার রা, উসমান রা, এবং আলী রা -এর মত সাহাবীরা পর্যন্ত মুনাফিকের আলামত দিয়েই কাউকে মুনাফিক হিসাবে চিহ্নিত করতে পারতেন না, বা করতেন না। কেবল হুজাইফা রা জানতেন, কে মুনাফিক, আর কে মুনাফিক নয়। কারণ, রাসূল স মুনাফিকদের যে তথ্য ওহীর মাধ্যমে জেনেছেন, তা তিনি কেবল হুজাইফা রা-কে জানিয়ে গিয়েছিলেন, এবং অন্য সাহাবীদেরকে বলতে নিষেধ করেছেন।

উপরের আরবি বাক্যগুলো যদি পড়েন, তাহলে দেখবেন, যার জানাজা পড়তে উমার রা-কে হুজাইফা রা নিষেধ করেছেন, তাকে কিন্তু তিনি সরাসরি মুনাফিক শব্দটি ব্যবহার না করে, “তাদের অন্তর্ভুক্ত” শব্দটি বলেছেন। রাসূল সা থেকে নিশ্চিত তথ্যের মাধ্যমে হুজাইফা রা জেনেছেন যে, এই লোক মুনাফিক, তবু উমার রা-কে নিষেধ করার সময়ে হুজাইফা রা মুনাফিক শব্দটি উচ্চারণ করেননি। আরো অবাক হবার বিষয় হলো, কে ছিলো ঐ ব্যক্তিটি, তা কিন্তু আমরা আজো জানি না। কারণ, ওই ব্যক্তির নামও বর্ণনাকারী উল্লেখ করেননি। এ থেকে বুঝা যায় মুনাফিক শব্দটি ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সাহাবীরা কতটা সতর্ক ছিলেন।

একবার উমার রা হুজাইফা রা-কে ডেকে আনালেন, এবং জিজ্ঞাসা করলেন, উমার রা-এর গভর্নরদের মধ্যে কেউ মুনাফিক আছে কিনা? হুজাইফা রা বললেন, একজন আছে। তবে হুজাইফা রা তাঁর নাম বলেননি, কেবল একটা ইঙ্গিত দিয়েছেন। দেখুন
https://islamansiklopedisi.org.tr/huzeyfe-b-yeman

উপরের ঘটনা থেকে বুঝা যে, উমার রা নিজেও মুনাফিকের আলামত দিয়ে কাউকে মুনাফিক হিসাবে চিহ্নিত করতেন না, বরং হুজাইফা (রা)-এর সাহায্য নিতেন। হুজাইফা (রা) ইন্তেকাল করার পরে রাসূলের ওহীপ্রাপ্ত যে তথ্য হুজাইফা রা এর কাছে ছিলো, তা শেষ হয়ে গেছে। এর পর কোনো ব্যক্তিকে আর মুনাফিক সাব্যস্ত করা সম্ভব না।

এ কারণে ইমাম আবু হানীফা বলেন,

ولا نكفر مسلما بذنب من الذنوب وإن كانت كبيرة، إذا لم يستحلها، ولا نزيل عنه اسم الإيمان. ونسميه مؤمنا حقيقة

“কোনো মুসলিমকে তার পাপের কারণে আমরা কাফির বলবো না, যদিও সে কবিরা গুনাহ করে; যতক্ষণ না সে তা হালাল মনে করে। এবং তার ইমান নেই, একথাও বলবো না, বরং তাঁকে প্রকৃত মুমিন হিসাবেই নাম দিব।”

দেখুন https://warithon.com/?p=1612&fbclid=IwAR2jB9k6YZatMxRPGb-8UPIP1kM3FYgw1zXiGfEtOK6q1ISB_c1RtGkFuok

অর্থাৎ, মুনাফিক একটা আইডিয়া, এটাকে আইডিয়া হিসাবে জানতে হবে নিজেকে যাচাই করার জন্যে। কিন্তু মুনাফিকের আইডিয়াটা কোনো ব্যক্তির উপর প্রয়োগ করা যাবে না। কোনো ব্যক্তিকে সুনির্দিষ্টভাবে বা ইংগিতেও মুনাফিক বলা যাবে না।

এখন প্রশ্ন হলো, যদি মুসলিমকে মুনাফিক বলা না যায়, তাহলে রাসূল সা কেন মুনাফিকের আলামতগুলো বর্ণনা করেছেন?

এর উত্তর হচ্ছে, অন্যকে মুনাফিক বলার জন্যে নয়, বরং নিজেকে যাচাই করার জন্যেই রাসূল স মুনাফিকের আলামতগুলো বর্ণনা করেছেন।

ইবরাহিম তায়মী (রহ) বলেন: আমার আমলের সাথে যখন আমার কথা তুলনা করি, তখন আশঙ্কা হয়, আমি না মিথ্যাবাদী হই। ইবনু আবূ মুলায়কা (রহ) বলেন, আমি নাবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এমন ত্রিশজন সাহাবীকে পেয়েছি, যারা সবাই নিজেদের সম্পর্কে নিফাকের ভয় করতেন। তাঁরা কেউ এ কথা বলতেন না যে, তিনি জিবরীল (আ) ও মীকাঈল (আ) এর তুল্য ঈমানের অধিকারী। ” (বুখারী, ইফা, ৪৬ এর অনুচ্ছেদ)

যারা কথায় কথায় অন্যকে মুনাফিক বলে, তারা এমনভাবে কথা বলে যেন, নিজে সাচ্চা মুমিন। অথচ হাসান বসরী (রহ) বলেন, “নিফাকের ভয় মু’মিনই করে থাকে। আর কেবল মুনাফিকই তা থেকে নিশ্চিত থাকে। “(বুখারী, ইফা, ৪৬ এর অনুচ্ছেদ) যে মানুষ নিজে মুনাফিক হবার ভয় না করে অন্যকে মুনাফিক বানাতে ব্যস্ত থাকেন, তার ব্যাপারেই ইমাম হাসান বসরী এ কথাটা বলেছেন।

ইমাম আহমেদকে (রহ) জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “তার সম্পর্কে আপনি কী বলেন যে নিফাক থেকে নিজেকে নিরাপদ ভাবে?” ইমাম আহমেদ ইবনে হাম্বল (রহ) জবাব দিলেন, “নিফাক থেকে কে নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারে?”

ইমাম ইবনুল কায়্যিম (রহ) বলতেন, “একজন মানুষের ইলম আর ঈমান যত বাড়বে, সে তত নিফাককে ভয় করবে।”

এ বিষয়টা আমরা আরও ভালোভাবে বুঝতে পারি উমার রা এর কয়েকটি ঘটনা থেকে। উমর রা ছিলেন জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত একজন সাহাবী। অর্থাৎ, নিশ্চিত জান্নাতি। তবু তিনি সব সময় নিজে মুনাফিক কিনা তা নিয়ে ভয়ে থাকতেন। উমার রা প্রায়ই হুজাইফা রা-এর কাছে জানতে চাইতেন, তাঁর নাম মুনাফিকের লিস্টে আছে কিনা?

দেখুন, উমার রা-এর মত জান্নাতের সুসংবাপ্রাপ্ত সাহাবী, এবং আমাদের ইমামদের মত মহান ব্যক্তিরা সর্বদা ভয়ে থাকতেন নিজেদের মুনাফিকি নিয়ে। আর আমরা এমনভাবে অন্যকে মুনাফিক বলি, মনে হয় আমরা পাক্কা মুমিন।আমাদের নিজেদের মুনাফিকি নিয়ে আমাদের কোনো ভয়-ডর নেই।

এক মুসলিম অন্য মুসলিমকে কাফের ও মুনাফিক বলার কারণ যতটা না ধর্মীয় তার চেয়ে বেশী রাজনৈতিক। অর্থাৎ, রাজনৈতিক কারণেই অধিকাংশ সময়ে এক মুসলমান অন্য মুসলমানকে কাফের ও মুনাফেক ঘোষণা দেয়।

এ জন্যে রাসূলের জামানায় কেউ মৃত্যু বরণ করার আগে জানা যেতো না, লোকটা কি মুমিন না মুনাফেক। রাসূল যদি কারো জানাজায় অংশ নিতেন, সবাই বুঝতেন লোকটা মুমিন। আর রাসূল যদি কারো জানাজায় অংশ না নিতেন, তাহলে সবাই বুঝতেন লোকটা মুনাফিক।

রাসূল (স) মৃত্যুর আগে কেন কোনো মুসলিমকে কাফির বা মুনাফিক বলতেন না? এর অনেক কারণ আছে। (১) হতে পারে মৃত্যুর এক দিন আগেও লোকটা প্রকৃত মুমিন হয়ে যেতে পারে। (২) মৃত্যুর আগেই কাউকে মুনাফেক বানিয়ে দিয়ে তাকে যেনো কেউ হত্যা না করে। (৩) রাজনৈতিক ক্ষমতা ও সম্পদের হিংসায় কেউ যেনো কাউকে মুনাফেক বলতে না পারে।

কেউ যখন কাউকে মুনাফেক বা কাফের বলে, তখন দেখবেন এর পিছনে আসল কারণ হলো তিনটি। ১) ক্ষমতা ২) সম্পদ ৩) সম্মান। ক্ষমতা-সম্পদ-সম্মানে যারা উপরে চলে যায়, তাদেরকে তাদের নীচের মানুষেরা হিংসাবসত মুনাফেক ও কাফের ডাকে। আবার ক্ষমতাশীল-ধনী-সম্মানিত মানুষরা তাদের নীচের মানুষদেরকে অশিক্ষিত-জাহেল-জঙ্গি-সন্ত্রাসী ইত্যাদি নামে ডাকে। আসলে দ্বন্দ্বটা এখানে ধর্মের নয়, দ্বন্দ্বটা ক্ষমতা, সম্পদ ও সম্মানের।

যাই হোক এ সমস্যার সমাধানে আল্লাহ বলেন –

يَٓا اَيُّهَا الَّذ۪ينَ اٰمَنُٓوا اِذَا ضَرَبْتُمْ ف۪ي سَب۪يلِ اللّٰهِ فَتَبَيَّنُوا وَلَا تَقُولُوا لِمَنْ اَلْقٰٓى اِلَيْكُمُ السَّلَامَ لَسْتَ مُؤْمِنًاۚ تَبْتَغُونَ عَرَضَ الْحَيٰوةِ الدُّنْيَاۘ فَعِنْدَ اللّٰهِ مَغَانِمُ كَث۪يرَةٌۜ

“হে ইমানদারগণ! তোমরা যখন আল্লাহর পথে সফর করো, তখন যাচাই-বাচাই করে নিবে। কেউ তোমাকে সালাম দিলেও পার্থিব সম্পদের আশায় আকাঙ্ক্ষায় তাকে বলবে না – “তুমি বেইমান”। আল্লাহর নিকট অনেক সম্পদ রয়েছে।” [সূরা ৪/নিসা – ৯৪]

এ আয়াত থেকে কয়েকটা বিষয় স্পষ্ট।

১) আমরা সম্পদের লোভেই অন্য মুসলমানকে বেইমান, মুনাফিক ও কাফের বলি।
২) যে ব্যক্তি কেবল সালাম দেয়, বা কেবল নিজেকে মুসলিম দাবী করে, তাকে মুনাফিক বা বেইমান বলার কোনো সুযোগ নেই।
৩) কারো সম্পদ বা সম্মানের প্রতি হিংস করে তাকে বেইমান-মুনাফেক বানানোর কোনো দরকার নেই। আল্লাহ হলেন সব সম্পদের মালিক। তাই হিংসা না করে আল্লাহর কাছে সম্পদ ও সম্মানের জন্যে দোয়া করা দরকার।

খারিজিদের কাজ ছিলো অন্যকে কাফির-মুনাফিক বলে হত্যা করা। তাঁরা আলী রা-কে কাফির বলে হত্যা করেছিলো। কিন্তু তাদেরকে আলী রা মুনাফিক বা কাফির বলতে নারাজ ছিলেন।

নাহরাওয়ান যুদ্ধের শেষে সৈন্যরা আলী (রা)-কে জিজ্ঞেস করলেন, “খারিজিরা কি মুশরিক?” আলী (রা) বললেন, “শিরক থেকে বাঁচার জন্যেই তো তারা আলাদা হয়ে গেছে”। সৈন্যরা বললেন, “তাহলে কি তারা মুনাফেক?” আলী (রা) বললেন, “মুনাফিকরা তো খুবই কম আল্লাহকে স্মরণ করে”। তখন সৈন্যরা বললেন, “হে আমীরুল মুমিনীন! তাহলে খারিজিরা আসলে কি?” আলী (রা) বললেন – “তারা আমাদের ভাই। আমাদের বিরুদ্ধে তারা বিদ্রোহ করেছে। সেই বিদ্রোহের কারণেই আমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি।”

আলী রা-এর ঘটনা থেকে শিক্ষা হলো আমাদের এই যে, কোরআন হাদীস না জানার কারণে কেউ আমাদেরকে মুনাফিক বা কাফির বললেও, বিপরীতে তাকে আবার কাফির বা মুনাফিক বলা যাবে না।

১০

শেষ কথা এই যে, হাদীসে মুনাফিকের আলামত দেয়া হয়েছে নিজেকে যাচাই করার জন্যে, অন্যকে মুনাফিক বলার জন্যে নয়।

আরো পোস্ট

একটি মন্তব্য লিখুন

আপনার ইমেইল অ্যাড্রেস প্রকাশ করা হবে না। তারকা (*) চিহ্নিত ঘরগুলো পূরণ করা আবশ্যক