|

মনের পশু বনাম বনের পশু


বনের পশু নয়, মনের পশু কোরবানি দিতে বলেন অনেকেই। তাঁরা আসলে জানেন না, বনের পশু দিয়ে কোরবানি হয় না। কারণ, বনের অধিকাংশ পশুই হয় হিংস্র। আর হিংস্র পশু দিয়ে কোরবানি হয় না। আমরা গৃহপালিত পশু দিয়ে কোরবানি দেই, আর এসব পশুর সাথে আমাদের মনের ভালোবাসা মিশে থাকে।


পশু কোরবানির রক্ত দেখে অনেকে অস্বস্তিতে ভুগছেন। অনেকে এ কাজকে হিংস্র মনে করছেন। এর কারণ হলো যারা মৃত্যু পরবর্তী জীবনে বিশ্বাস করেন না, তারা মৃত্যুকে ভয় পান। মরণকে তারা ধ্বংস মনে করেন। অথচ অতীতের বিভিন্ন সভ্যতায় জগতের কল্যাণে নিজের মৃত্যুকে বা আত্মত্যাগকে গৌরবের সাথে দেখা হতো, সেটা পশু হোক বা খোদ মানুষ হোক।

বাংলা ভাষার বিখ্যাত গানগুলো সব শহীদের মর্যাদা নিয়ে গাওয়া হয়েছিলো। যেমন, “এক সাগর রক্তের বিনিময়ে. বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা. আমরা তোমাদের ভুলব না।” অথবা “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।” দেখুন এ গানগুলোতে রক্তের বা শহীদের গৌরব গাওয়া হচ্ছিলো। আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধে দেশের জন্যে জীবন দিয়ে শহীদ হবার উৎসাহ দিয়েছিলো আমাদের মায়েরা। ইতিহাসের বই ও নাটক-সিনেমায় আমরা তা অনেক দেখেছি। অর্থাৎ, আত্মত্যাগ, বা মরণকে কেউ কখনো খারাপ ভাবে দেখেনি। কারণ, কিছু মানুষের মৃত্যু অনেক মানুষকে রক্ষা করেছে।

একজন নাইটগার্ড যেমন নিজে ঘুম না গিয়ে অনেক মানুষের শান্তির ঘুমের ব্যবস্থা করেন, তেমনি সমাজের কিছু মানুষ নিজেদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে সমাজের অনেক মানুষকে মৃত্যু থেকে রক্ষা করেন। কোরআনে বলা হয়েছে, “আর যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়, তাদের মৃত বলো না। বরং তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা তা বুঝ না।” – সুরা বাকারাহ ১৫৪।

হজরত আলী রা বলেছিলেন, কেউ যখন মারা যায়, তখন হয় সে খুশী হয়, না হয় দুনিয়াবাসী খুশী হয়। যদি মারা যাওয়া লোকটা ভালো হয়, তাহলে সে আল্লাহর সাক্ষাত পেয়ে নিজে খুশী হয়। আর যদি লোকটা খারাপ হয়, তাহলে সে লোকটা থেকে মুক্তি পেয়ে দুনিয়াবাসী খুশী হয়।

মাওলানা রূমি বলেন, যারা মৃত্যুকে ভয় পায়, তারা আসলে তাদের পাপের কারণে ভয় পায়। মৃত্যু ভয় পাবার কিছু নয়। রূমি বলেন, “আমি যেদিন মারা যাবো, সেদিন তোমরা কান্নাকাটি করে বিদায়-বিদায় বলো না, কারণ সেদিন আমার খুশির দিন, আল্লাহর সাথে মিলনের দিন। “

মাওলানা রূমি বলেন, “যে কোনো মৃত্যু মানে নতুন একটি জীবনে সূচনা। যেমন, একটি শিশু মায়ের গর্ভকে বিদায় জানিয়ে পৃথিবীতে আগমন করে, তেমনি আমরা পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে আখিরাতের জীবন লাভ করি।”

মৃত্যু মানে ধ্বংস বা শেষ হয়ে যাওয়া নয়, মৃত্যু মানে নতুন জীবনে প্রবেশ করা, মৃত্যু মানে নিজের জীবনের বিনিময়ে অন্যের জীবনকে রক্ষা করা। এটা মানুষের জন্যে যেমন সত্য, পশুপাখির জন্যেও তেমন সত্য। একটি পশু কোরবানি হবার মধ্য দিয়ে অসংখ্য গরিব মানুষের জীবনে প্রাণ ফিরে পায়। একের জীবনের বিনিময়ে অনেকের জীবনে প্রাণ ফিরে পাওয়ার এ চর্চাটা আদি যুগ থেকে এখনো চলে আসছে।

যারা কোরবানির সময়ে পশু কোরবানির ঘটনায় দুঃখ পান, তারা আসলে নিজের মৃত্যুকেও ভয় পান। আর তারাই মৃত্যুকে ভয় পায়, যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করেন না, যারা আল্লাহর সাথে সাক্ষাতকে সুখ মনে করেন না।


আমাদের দেশে গরু কোরবানি করাটা মত প্রকাশের ও স্বাধীনতার একটি অংশ, জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের একটি অংশ, মুসলিম রাজনীতির একটি অংশ, এবং আমাদের দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার একটি অংশ।

গরু কোরবানি করার স্বাধীনতা যারা হরণ করেছিলো, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেই এ দেশে ইসলাম এসেছে। ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে সিলেটের বুরহানউদ্দীন শিশুপুত্রের আকিকা উপলক্ষে গরু কোরবানি করার কারণে সিলেটের রাজা গৌর গোবিন্দ বুরহানউদ্দীনের শিশুটিকে হত্যা করে। তখন বুরহান উদ্দিন তৎকালীন বাংলার সুলতান শামসুদ্দীন ফিরুজ শাহ এর নিকট এ অন্যায়ের প্রতিকার প্রার্থনা করেন। তখন সিপাহসালার সায়্যিদ নাসিরুদ্দিন ও সিকান্দার খান দুই সেনাপতির নেতৃত্বে সিলেট স্বাধীন করা হয়। সাথে ছিলেন আমাদের শাহজালাল রহ। ধর্মীয় মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়।

সুতরাং, গরু কোরবানির সাথে এ দেশের স্বাধীনতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কেউ যদি গরু কোরবানির বিরোধীতা করে তাহলে বুঝতে হবে সে অত্যাচারী শাসক গৌর গোবিন্দের সৈন্য। কেউ যদি গরু কোরবানির বিরোধীতা করে তাহলে বুঝতে হবে সে আমাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণ করতে চায়। কেউ যদি গরু কোরবানির বিরোধীতা করে তাহলে বুঝতে হবে সে আমাদের শিশুদের হত্যা করতে চায়।

এ দেশে অত্যাচারী গৌর গোবিন্দদের নব্য সৈন্যদের দ্বারা ভরে যাচ্ছে। এসব অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে সবাই নিজ হাতে গরু কোরবানি করুন। আমাদের মনে রাখতে হবে, গরু কোরবানিটা কেবল ধর্মীয় আদেশ নয়, এটা আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক।

‘কোরবানির ঈদ’ শব্দের অর্থ হলো ত্যাগের আনন্দ। ইসলামের কোনো আনন্দ-ই ভোগ নির্ভর নয়, ত্যাগ নির্ভর। কারণ, ভোগ মানুষে মানুষে দূরত্ব সৃষ্টি করে, আর ত্যাগ মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক সৃষ্টি করে।

ভোগের অপর নাম বিচ্ছেদ, আর ত্যাগের অপর নাম ভালোবাসা।

কোরআনে আল্লাহর ভালোবাসা পাবার জন্যে তিনটি কাজের কথা বলা হয়েছে।

১) নিজের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো বা মন্দ যাই হোক না কেনো, সমর্থ অনুযায়ী অন্যের জন্যে সময় ও অর্থ ব্যয় করা।

২) নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করা।

৩) অন্যকে দোষারোপ না করে ক্ষমা করে দেয়া।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

الَّذِينَ يُنفِقُونَ فِي السَّرَّاء وَالضَّرَّاء وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ

“যারা সচ্ছলতায় ও অভাবের সময় ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে, বস্তুত: আল্লাহ সৎকর্মশীলদিগকেই ভালবাসেন। “[ সুরা ইমরান ৩:১৩৪ ]

আল্লাহর ভালোবাসা পেতে যে তিনটা কাজ করতে হয়, মানুষের ভালোবাসা পেতেও ঠিক এ তিনটি কাজ করতে হয়। নিজের অর্থ ও সময় অন্যের জন্যে ব্যয় করার নাম ভালোবাসা। নিজের অধিকার ছেড়ে দিয়ে রাগ না করার নাম ভালোবাসা। অন্যের দোষ হওয়া সত্ত্বেও তাকে ছেড়ে দেয়া বা ক্ষমা করার নাম ভালোবাসা। লক্ষ্য করলে দেখবেন, এ তিনটি কাজ-ই হলো ত্যাগ করা। অর্থাৎ, ত্যাগের নাম-ই ভালোবাসা।

যেমন ধরুন, স্বামী-স্ত্রী দুই জনেই যদি ভোগবাদী হয়, এবং সারাক্ষণ নিজ নিজ স্বার্থ নিয়ে চিন্তা করে, তাহলে তাদের সম্পর্ক বেশিদিন টিকে থাকে না। অন্যদিকে জামাই-বউ যদি একে অপরের জন্যে সেক্রিফাইস করে বা ত্যাগের মানসিকতা লালন করে, তাহলে সে সম্পর্ক টিকে থাকে বহুদিন।

একই কথা পরিবার ও সমাজের জন্যেও প্রযোজ্য। যে পরিবার বা সমাজে ভোগের বা স্বার্থের চর্চা বেশি হয়, সে পরিবার বা সমাজের সদস্যরা একে অপরের চেয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, এবং এর ফলে পরিবার ও সমাজের শক্তি হারিয়ে যায়। অন্যদিকে, যে পরিবার ও সমাজে ত্যাগ ও ভালোবাসার চর্চা হয়, সে পরিবার ও সমাজে একতা সৃষ্টি হয়, এবং তারা ক্ষমতাশীল হয়ে ওঠে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন –

لَن تَنَالُواْ الْبِرَّ حَتَّى تُنفِقُواْ مِمَّا تُحِبُّونَ

“কস্মিনকালেও কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, যদি তোমাদের প্রিয় বস্তু থেকে তোমরা ব্যয় না কর। “[ সুরা ইমরান ৩:৯২ ]

কোরবানি মানে হলো, নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ, অর্থনৈতিক স্বার্থ ও রাজনৈতিক স্বার্থ ত্যাগ করে পারস্পরিক ভালোবাসা ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী হওয়া।

আমরা প্রায়-ই শুনি ‘ঈদের ছুটি’। এ ছুটিটা ভালো কাজের জন্যে নয়, খারাপ কাজের জন্যে ছুটি। ঈদ মানে ছুটি নয়, ঈদ মানুষকে ছুটি দেয় না, ঈদ মানুষকে অনেকবেশি কর্মব্যস্ত করে ভালো কাজের জন্যে। ঈদ মানুষকে আগের চেয়ে বেশি দান করতে উৎসাহ যোগায়, ঈদ মানুষকে আগের চেয়ে
বেশি ভালো কাজ করতে প্রেরণা দেয়।

‘ঈদের ছুটি’ বলে যে কথা আমরা শুনি, সেটা হলো খারাপ কাজ থেকে ছুটি, ঈদের ছুটি মানে ভোগবাদ থেকে ছুটি, ঈদের ছুটি মানে হিংসা-অহংকার থেকে ছুটি, ঈদের ছুটি মানে অন্যায়-জুলুম থেকে ছুটি, ঈদের ছুটি মানে ধর্মীয় কাজ করার স্বাধীনতা পাওয়া, ঈদের ছুটি মানে মনটাকে সকল বন্ধন থেকে মুক্তি দেয়া।

আরো পোস্ট

একটি মন্তব্য লিখুন

আপনার ইমেইল অ্যাড্রেস প্রকাশ করা হবে না। তারকা (*) চিহ্নিত ঘরগুলো পূরণ করা আবশ্যক