ইসলামি আন্দোলন করা কি সবার জন্যে ফরজ?
অনেকে মনে করেন, ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সকল মুসলিমের উপর ফরজে আইন। এর পক্ষে তারা যুক্তি দিয়ে বলেন, কোরআনে নামাজ যেভাবে প্রতিষ্ঠিত করার কথা বলা হয়েছে, তেমনি দ্বীন-ও প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। সুতরাং নামাজ যেমন, সকল মুসলিমের জন্যে ফরজ, তেমনি দ্বীন প্রতিষ্ঠা করাও প্রত্যেক মুসলিমের জন্যে ফরজ।
প্রথমত ধরে নিলাম, নামাজের মতোই দ্বীন কায়েম করা ফরজ। আমরা জানি, নামাজ ফরজে আইন হলেও এটা সব সময় সব মুসলিমের জন্যে সমান পদ্ধতিতে আদায় করা ফরজ হিসাবে থাকে না। তাহলে প্রশ্ন হলো, দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা কীভাবে সবসময় সব-মুসলিমের জন্যে সমান পদ্ধতিতে ফরজ হবে? যেমন ধরুন, সূর্য উদয়ের সময় বা সূর্য অস্ত যাবার সময় নামাজ পড়া যায় না। তাহলে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা যদি ফরজে আইনও হয়, তবুও সব সময় সেটা প্রতিষ্ঠা করা ফরজ হবে না, দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যে একটি নির্দিষ্ট সময়ের প্রয়োজন হবে, যেমন নামাজের জন্যে নির্দিষ্ট ওয়াক্তের প্রয়োজন হয়। এরপর আসুন, নামাজের জন্যে অজু করা ও পবিত্র হওয়ার শর্ত রয়েছে, তেমনি দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যেও সমাজকে আগে দুর্নীতি মুক্ত করা প্রয়োজন হয়। এরপর, কেউ দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে না পারলে বসে পড়ার অনুমতি রয়েছে, বসে না পারলে শুয়ে পড়ার অনুমতি রয়েছে, শুয়ে না পারলে ইশারায় পড়ার সুযোগ রয়েছে, এবং মুসাফিরের জন্যে নামাজ অর্ধেক পড়ার অনুমতি রয়েছে। তেমনি ইকামাতে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার নানা পর্যায় রয়েছে, কেউ ১০০ ভাগ প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে ৭০ ভাগ দ্বীন প্রতিষ্ঠা করবে, সেটা না করতে পারলে ৪০ ভাগ দ্বীন প্রতিষ্ঠা করবে, সেটাও না করতে পারলে প্রয়োজনে ৫ ভাগ ইকামতে দ্বীনের কাজ করার অনুমতি থাকবে নিশ্চয়। তারপর আসি, নারীদের বিশেষ সময়ে যেমন নামাজ পড়তে হয় না, তেমনি সমাজের কিছু জটিলতার কারণেও মাঝে মাঝে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা যায় না। মোদ্দা কথা হলো, নামাজ ফরজে আইন হলেও নামাজের জন্যে যেমন কিছু নির্দিষ্ট শর্ত রয়েছে, কিছু নির্দিষ্ট সময় রয়েছে, কিছু ছাড় দেওয়া হয়েছে, এবং নামাজ পড়ার বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে; তেমনি দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার জন্যে কিছু নির্দিষ্ট শর্ত রয়েছে, কিছু নির্দিষ্ট সময় রয়েছে, কিছু ছাড় দেওয়া হয়েছে, এবং বিভিন্ন পদ্ধতি দেওয়া রয়েছে।
যদিও দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা নামাজ, রোজা, হজ বা যাকাতের মতো ইসলামের রোকন বা মৌলিক কোনো বিষয় নয়, তবু আপাতত ধরে নিলাম, দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা হজ ও যাকাতের মতোই ইসলামের একটি রোকন। আমরা জানি, হজ ও যাকাত ইসলামের রোকন হলেও সেটা সকল মুসলিমের জন্যে ফরজ নয়, কেবল সমর্থবান ধনী মানুষের জন্যেই হজ ও জাকাত ফরজ হয়। প্রশ্ন হলো, যদি দ্বীন প্রতিষ্ঠা যদি হজ ও যাকাতের মত ইসলামের রোকন হয়, তবুও কি সেটা সব মুসলিমের জন্যে ফরজ হবে? নাকি কেবল সমর্থবান মুসলিমদের জন্যে ইকামতে দ্বীন ফরজ হবে? হজ ও যাকাতের সাথে তুলনা করলেও আমরা বুঝতে পারি যে, দ্বীন কায়েম করা সকল মুসলিমের জন্যে নয়, বরং কেবল ক্ষমতাশীল মুসলিমের জন্যেই ফরজ।
এবার আসি, যে আয়াতে দ্বীন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে, সে আয়াতটা আমরা একটু দেখি। আল্লাহ তায়ালা বলেন –
شَرَعَ لَكُم مِّنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ كَبُرَ عَلَى الْمُشْرِكِينَ مَا تَدْعُوهُمْ إِلَيْهِ اللَّهُ يَجْتَبِي إِلَيْهِ مَن يَشَاء وَيَهْدِي إِلَيْهِ مَن يُنِيبُ
“তিনি তোমাদের জন্যে দ্বীনের ক্ষেত্রে সে পথই নির্ধারিত করেছেন, যার আদেশ দিয়েছিলেন নূহকে, যা আমি প্রত্যাদেশ করেছি আপনার প্রতি এবং যার আদেশ দিয়েছিলাম ইব্রাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই মর্মে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং তাতে অনৈক্য সৃষ্টি করো না। আপনি মূশরেকদেরকে যে বিষয়ের প্রতি আমন্ত্রণ জানান, তা তাদের কাছে দুঃসাধ্য বলে মনে হয়। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন এবং যে তাঁর অভিমুখী হয়, তাকে পথ প্রদর্শন করেন। “[ সুরা শূরা ৪২:১৩ ]
দেখুন, এ আয়াতে দ্বীন প্রতিষ্ঠার কথা আমাদের নবীকে যেমন বলা হয়েছে, তেমনি আমাদের পূর্ববর্তী নূহ, ইব্রাহীম, মূসা ও ঈসা (আ)-কেও বলা হয়েছে। আমরা জানি যে, আমাদের রাসূল যেমন মদিনায় একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন, কিন্তু নূহ, ইব্রাহীম ও ঈসা (আ) কোনো রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেননি, কিংবা কোনো রাষ্ট্রের শাসকও হননি। দ্বীন প্রতিষ্ঠার আদেশ নূহ-ইব্রাহীম-ঈসা (আ)-কে দেওয়া হয়েছে, অথচ কেউ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেননি, তার মানে কি এসব নবী-রাসূলগন দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে অবহেলা করেছিলেন? আসল কথা হলো, আমরা দ্বীন প্রতিষ্ঠাকে যেমন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পাওয়া মনে করি, দ্বীন প্রতিষ্ঠা মানে তেমন কিছু নয়।
কোরআনে দ্বীন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হওয়ায় অনেকেই মনে করেন, সেটা নামাজের মত সকল মুসলিমের জন্যে ফরজ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোরআনে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার মতো মাপের সময়ে সঠিক ওজন কায়েমের বা প্রতিষ্ঠার কথাও বলা হয়েছে, তাহলে কি সব মুসলিমকে ব্যবসায়ী হতে হবে?
আল্লাহ বলেন –
وَأَقِيمُوا الْوَزْنَ بِالْقِسْطِ وَلَا تُخْسِرُوا الْمِيزَانَ
“তোমরা ন্যায্য ওজন কায়েম কর এবং ওজনে কম দিয়ো না। “(আর রহমান, আয়াত:৯)
এ আয়াতে ওজন কায়েমের কথা বলা হয়েছে। যদি কেউ ব্যবসায়ী হয়, অথবা মাপামাপি সম্পর্কিত কোনো কাজে যুক্ত হয়, তখনি কেবল এ আয়াত তার মানতে হবে। কিন্তু কোরআনে ওজন কায়েম করার কথা বলা হয়েছে বলে সবাইকে মাপামাপি করতে হবে, তা ফরজ করা হয়নি। তেমনি দ্বীন কায়েম করার অর্থ যদি ধরেও নেই যে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, তাহলেও এটা সবার জন্যে ফরজ নয়। কেউ মাপামাপির কাজে জড়িত হলে যেমন, তার উপর ন্যায় ওজন করার আয়াত প্রযোজ্য হয়, তেমনি কেউ রাষ্ট্র ক্ষমতায় গেলেই কেবল তার উপর ন্যায়বিচার বা ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা ফরজ হয়, গণহারে সবার জন্যে তা ফরজ নয়।
একটা আয়াতে এ বিষয়টা ভালোভাবে বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন –
الَّذِينَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنكَرِ ۗ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ [٢٢:٤١]
“তারা এমন লোক যাদেরকে আমি পৃথিবীতে শক্তি-সামর্থ্য দান করলে তারা নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে এবং সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করবে। প্রত্যেক কর্মের পরিণাম আল্লাহর এখতিয়ারভূক্ত। “[ সুরা হাজ্জ্ব ২২:৪১]
দেখুন, এখানে সব মুসলিমকে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যে বলা হচ্ছে না, বরং বলা হচ্ছে, আল্লাহ যদি কখনো তাদেরকে ক্ষমতা দেন, তখন তাদের কাজ হবে সৎ কাজের আদেশ দেয়া ও অসৎ কাজের নিষেধ করা। অর্থাৎ, সৎ কাজের আদেশ করার জন্যে ক্ষমতায় যেতে বলা হচ্ছে না, কিন্তু কাউকে আল্লাহ ক্ষমতায় নিলে তখন তার কাজ হবে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা।
আরেকটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা আরও স্পষ্ট হবে আশা করি। কোরআনে বলা হয়েছে,
فَانكِحُوا مَا طَابَ لَكُم مِّنَ النِّسَاءِ مَثْنَىٰ وَثُلَاثَ وَرُبَاعَ
“মেয়েদের মধ্যে থেকে যাদের ভাল লাগে তাদের বিয়ে করে নাও দুই, তিন, কিংবা চারটি পর্যন্ত।” [ সুরা নিসা ৪:৩ ]
এ আয়াতে দুই, তিন বা চারজন নারীকে বিয়ে করার কথা বলা হয়েছে। তার মানে এই জন যে, সব পুরুষের জন্যে দুই বা তিন বিয়ে করা ফরজ। এই আয়াতের দুই বা তিন বিয়ে করার আদেশ নয়, বরং অনুমতি দেয়া হয়েছে। কেউ যখন এ আয়তের শর্তগুলো পূরণ করবে, তখনি কেবল সে দুই বা তিন বিয়ে করতে পারবে। কিন্তু এ আয়াত দেখিয়ে কেউ যদি বলে, সব মুসলিমের জন্যে আল্লাহ দুই বা তিন বিয়ে ফরজ করেছেন, তাহলে সেটা ভুল হবে। একইভাবে দ্বীন কায়েমের আয়াত দেখিয়ে কেউ যদি বলেন, সব মুসলিমের জন্যে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করাকে আল্লাহ নামাজের মতোই ফরজ করেছেন, তাহলে সেটাও ভুল হবে। কারণ, বিভিন্ন নবী বিভিন্ন স্টাইলে দ্বীন কায়েম করেছেন, কেউ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে দ্বীন কায়েম করেছেন, কেউ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না করেই দ্বীন কায়েম করেছেন।
এ কারণে, ইমাম গাজালির মতে, নামাজ-রোজা ইত্যাদী কাজগুলো হলো ফরজে আইন, যা সকল মুসলিমের বাধ্যতামূলকভাবে করতে হয়। কিন্তু রাজনীতি হলো ডাক্তারি করা বা কৃষিকাজ করার মতো একটি ফরজে কিফায়া। সকল মুসলিমের জন্যে রাজনীতি করার প্রয়োজন নেই, কিছু মুসলিম রাজনীতি করলেই হবে।
ইমাম গাজালি বলেন –
فرض الكفاية فهو علم لا يستغني عنه في قوام أمور الدنيا كالطب إذ هو ضروري في حاجة بقاء الأبدان وكالحساب فإنه ضروري في المعاملات وقسمة الوصايا والمواريث وغيرهما وهذه هي العلوم التي لو خلا البلد عمن يقوم بها حرج أهل البلد وإذا قام بها واحد كفى وسقط الفرض عن الآخرين
فلا يتعجب من قولنا إن الطب والحساب من فروض الكفايات فإن أصول الصناعات أيضاً من فروض الكفايات كالفلاحة والحياكة والسياسة
[إحياء علوم الدين 1/ 16]
“ফরজে কিফায়া হলো এমন জ্ঞান, যা দুনিয়াবি কাজের সাথে সম্পর্কিত, যেমন চিকিৎসাবিজ্ঞান। শরীরের সুস্থতার জন্যে চিকিৎসাবিজ্ঞান প্রয়োজন। একইভাবে অর্থনীতি শেখাও ফরজে কিফায়া। কারণ, টাকাপয়সার লেনদেন, কাউকে সম্পদ দান করা, এবং মৃত-ব্যক্তির সম্পদ বণ্টন করার জন্যে গণিত লেখা প্রয়োজন। কোনো দেশে এসব জ্ঞানে অভিজ্ঞ কোনো মানুষ না থাকলে দেশের অধিবাসীদের বিপদের অন্ত থাকে না। কিন্তু, কেউ একজন যদি এ জ্ঞান অর্জন করে, তাহলে অন্য মানুষদের আর এ ফরজটি পালন করতে হবে না। আমরা চিকিৎসাবিজ্ঞান ও অর্থনীতিকে ফরজে কিফায়া বলেছি, তাতে অবাক হবেন না। বিভিন্ন শিপ্লকর্মও ফরজে কিফায়া। যেমন, কৃষিকর্ম, গার্মেন্টস শিল্প, এবং রাজনীতি এগুলোও ফরজে কিফায়া।” [১ম খণ্ড, পৃ – ৩৮]
ইমাম গাজালির মতে, রাজনীতি হলো একটি দুনিয়াবি কাজ। আর দুনিয়ার প্রয়োজনে যেসব কাজ করতে হয়, তা ফরজে কিফায়া। অর্থাৎ, ডাক্তারদের মতো কিছু মুসলিম রাজনীতি করলেই সকলের উপর ফরজ আদায় হয়ে যাবে। সকল মুসলিমকে রাজনীতি করার বা ইসলামি আন্দোলন করার প্রয়োজন নেই।
মুহতারাম মনগড়া ব্যখ্যা দিয়ে মুসলিম উম্মাহকে বিভ্রান্ত করবেন না।।
ইকামাতে দ্বীন সম্পর্কে ভালোভাবে জানার চেষ্টা করুন।।