আগাচৌ’র বাঙালিপনা
‘বাঙালি’ শব্দটি নানান অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন, কেউ কেউ মনে করেন, একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের কর্মী হওয়া মানে ‘বাঙালি’ হওয়া। বাংলা ভাষায় কথা বলা সত্ত্বেও কোনো জনগোষ্ঠীকে যখন কেউ বলে, তোমাদেরকে ‘বাঙালি’ হয়ে যেতে হবে; তার মানে তোমাদেরকে ওই নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের কর্মী হতে হবে।
কোনো মানুষকে রাজনৈতিক কোনো দলের কর্মী হওয়ার জন্যে বাধ্য করা যায় না; এটি অগণতান্ত্রিক, স্বাধীনতার হরণ এবং মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। কিন্তু বাংলাদেশী বুদ্ধিজীবীরা ভিন্ন চিন্তা-চেতনার মানুষগুলোকে একই ব্র্যান্ডের ‘বাঙালি’ হবার বাধ্যবাধকতা আরোপ করেন।
পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও ধর্মের বৈচিত্র্যকে টিকিয়ে রাখার জন্যে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম। এখানে ‘বাঙালি’ পরিচয়ের আবরণে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করা হয়; মানুষের স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়।
বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র রাজনৈতিক কর্মী পর্যন্ত সবাই ‘বাঙালি’ শব্দের আবরণে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে বসবাসকারী অপর জনগোষ্ঠীগুলো স্বাধীনতা হরণ করার একটি অসাংবিধানিক ‘বৈধতা’ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তার একটি উদাহরণ আবদুল গাফফার চৌধুরী। সম্প্রতি তিনি নিউইয়র্কের বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে একটি বক্তৃতা করেন। তার বক্তৃতার প্রতিবাদে বিভিন্ন পত্রিকা, ব্লগ ও ফেইসবুকে ঝড় উঠে। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ মিছিল হয়।
আবদুল গাফফার চৌধুরী এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ লোক না যে তার বিরুদ্ধে মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিংবা তিনি কোথায় কি বলেছেন, তা মানুষকে শুনতে হবে। তাকে নিয়ে কখনো সাধারণ মানুষের কোনো আগ্রহ ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি তিনি আল্লাহ তায়ালা, রাসূল (স) এবং ইসলাম নিয়ে যেসব কটূক্তি করেছেন, তার বিরুদ্ধে মানুষ ব্যাপকহারে প্রতিবাদ করেছে।
মানুষ কেনো এমন প্রতিবাদ করলো, তা বোঝার জন্যে আবদুল গাফফারের বক্তব্যটা আমলে নেয়া যায়। তার বক্তব্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ভয়ংকর পরিণতি সহজে অনুমেয়।
বুদ্ধিজীবীরা যখন বাংলাদেশের মানুষকে ‘বাঙালি’ হবার পরামর্শ দেন, তখন তারা আসলে কি করতে চান; তা চৌধুরী সাহেবের বক্তব্য থেকে পষ্ট হওয়া যায়। একজন বাঙালি যখন পূর্ণরূপে তার আত্মপ্রকাশ করেন, তখন সে কি কি চরিত্র ধারণ করে; তাও এ বক্তব্য থেকে প্রকাশ পায়।
লেখক হিসাবে আবদুল গাফফার চৌধুরী কতটা সফল তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের একজন একনিষ্ঠ প্রচারক হিসাবে তিনি যে শতভাগ সফল, তাতে কেউ আপত্তি করেন না। আওয়ামী রাজনীতির যাবতীয় কর্মসূচীকে লিখিতরূপে প্রচার-প্রচারণা ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দায়িত্ব তার কাঁধেই বেশি। বিভিন্ন সময় যুক্তি-পরামর্শ দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বৈধতা সৃষ্টিতে তার ভূমিকা প্রচুর।
তিনি যখন কোনো কথা বলেন, তা কেবল একজন লেখক হিসাবে বলেন না; বাঙালি জাতীয়তাবাদের একজন একনিষ্ঠ কর্মী হিসাবে বলেন। সে-হিসাবে চৌধুরী সাহেব ব্যক্তি হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ না হলেও তার কথার একটি রাজনৈতিক মূল্য আছে। ‘বাঙালি’ শব্দটির রাজনৈতিক মানে কি; তা আবদুল গাফফার চৌধুরী থেকেই সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট হওয়া সম্ভব।
চৌধুরী সাহেব বর্তমান সময়ের একজন আদর্শ বাঙালি। যে-কোনো বাঙালি যখন পরিপূর্ণরূপে তার আত্মপ্রকাশ করে তখন সে আবদুল গাফফার চৌধুরী হয়ে যায়। তখন সে অ-বাঙালিদের স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার হরণ করতে চায়।
আবদুল গাফফার প্রথম না; তার আগে অনেকে এভাবে ‘পূর্ণ-বাঙালি’ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। সম্প্রতি লতিফ সিদ্দিকীও একজন ‘পূর্ণ-বাঙালি’ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। যার সম্পর্কে চৌধুরী সাহেব বলেছেন, “লতিফ সিদ্দিকী কী এমন বলেছিল? তাকে বিপদে পড়তে হয়েছে। তার জন্য আজকে দেশে আন্দোলন হচ্ছে”।
চৌধুরী সাহেব বোধ হয় জানেন না, পৃথিবীর যেখানে যখন সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়, সেখানেই মানুষ আন্দোলনে জেগে উঠে। একাত্তরের আগে পাঞ্জাবীরা যেমন ‘মুসলিম’ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে পূর্ব পাকিস্তানীদের অধিকার হরণ করেছিল, এখন তেমনি ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক দল ও তার বুদ্ধিজীবীরা ‘বাঙালি’ ব্যানারের আবরণে বাংলাদেশি মানুষের স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার হরণ করছে। তখন যেমন সাধারণ মানুষ স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্যে আন্দোলন করেছিল; এখনো সাধারণ মানুষ সেভাবেই আন্দোলন-প্রতিবাদ করছে।
লতিফ সিদ্দিকী কিংবা আবদুল গাফফার চৌধুরীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশে এখন যে আন্দোলন-প্রতিবাদ হচ্ছে, তা মানুষের স্বাধীনতা রক্ষা করার আন্দোলন। মানুষ নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী ধর্ম পালন করতে ও কথা বলার স্বাধীনতা লাভ করতে চায়।
একাত্তরের পূর্বে পাঞ্জাবীরা যেমন পূর্ব পাকিস্তানীদের সাথে সীমাহীন বৈষম্যপূর্ণ আচরণ করেছে; একাত্তরের পর আজ ‘বাঙালিরা’ বাংলাদেশের অন্য ভাষা-ভাষী ও সংস্কৃতির মানুষের সাথে একই আচরণ করছে।
“বাংলাদেশে বাঙালিরা ব্যতীত অন্য কারো রাজনীতি করার অধিকার নাই”—একথা বাঙালি নেতা-নেত্রীরা প্রায় বলেন। তারা চায়, এ দেশের সবাই বাঙালিদের মত কথা বলতে হবে, বাঙালিদের মত খেতে হবে, বাঙালিদের মত পোশাক পরতে হবে – সবকিছুই বাঙালিদের মত হতে হবে। এখানে অন্যদের কোনো স্বাধীনতা নেই। বাংলাদেশে থাকতে হলে কেমন পোশাক পরতে হবে, কিভাবে চলতে হবে – সবই বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা ঠিক করে দিবেন।
–এ কারণে চৌধুরী সাহেব মুসলিম পুরুষদের পোশাকের ব্যাপারে বলেন, “পুরো দেশ এখন দাড়ি-টুপিতে ছেঁয়ে গেছে। সরকারি অফিসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে টুপি আর দাড়ির সমাহার।” এবং নারীদের ব্যাপারে বলেন, “ক্লাস টু’য়ের মেয়েরা হিজাব, বোরকা পড়বে! এটা আমাদের ধর্ম শিক্ষা হতে পারে? এসব ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।”
চৌধুরী সাহেব ভুলে গেছেন, পৃথিবীতে মানুষেরা কারো নিয়ম মেনে থাকতে চায় না। সে জন্মগতভাবে স্বাধীন। মানুষকে অধীন করে রাখার বিপদ এ জাতি বহুবার দেখেছে। মানুষের ইচ্ছা হলে সে টুপি-পাঞ্জাবি বা হিজাব পরবে, ইচ্ছা না হলে পরবে না। কিন্তু কেউ টুপি-পাঞ্জাবি বা হিজাব পরার স্বাধীনতা পাবে না;—এ কথার অর্থ কি?
সরকারের নানা দমন-পীড়ন সত্ত্বেও বাংলাদেশের মানুষ আবদুল গাফফার চৌধুরীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। এর মানে এই না যে, তারা কেবল কোনো নাস্তিকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। বাংলাদেশে অনেকেই নাস্তিকতার চর্চা করে, কিন্তু মানুষ তাদের বিরুদ্ধে সাধারণত আন্দোলন-সংগ্রামকরে না।
যখনি কেবল ‘বাঙালি’ জাতীয়তার নামে কোনো ধর্মকে আঘাত করে কথা বলা হয়, ধর্মীয় আচার-আচরণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়, তখনি মানুষ আন্দোলনে-ক্ষোভে ফেটে পড়ে। আবদুল গাফফার চৌধুরীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের গণমানুষ এখন যে-ক্ষোভ দেখাচ্ছে, তা থেকে বিষয়টি আরও পষ্ট হওয়া যায়।
ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে একই ব্রান্ডের ‘বাঙালি’ বানিয়ে ফেলার সমস্যা এটি।
চৌধুরী সাহেব যখন বলেন, “আমরা আগে বাঙালি তারপরে মুসলমান। আমরা ধর্ম পরিবর্তন করতে পারি, কিন্তু বাঙালিত্ব নয়”; তখন তিনি আসলে সবাইকে ‘বাঙালি’ হতে বাধ্য করেন।
আবদুল গাফফারের এই ফ্যাসিস্ট ইচ্ছাটি সকল ‘বাঙালি’ বুদ্ধিজীবীর মধ্যেই কমবেশি বিরাজ করে। কিন্তু ইতিহাস আমাদেরকে বারবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে, এ ধরণের ফ্যাসিস্ট ইচ্ছা যে কোনো জাতি ধ্বংসের একমাত্র কারণ।
July 8, 2015 at 8:00 PM ·