ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বনাম চিড়িয়াখানা
যেখানে পড়াশুনা করা একসময় স্বপ্ন মনে হত, আজ তা চিড়িয়াখানার চেয়েও নগণ্য ও জঘন্য মনে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলছি। আজ তার ৯৫ বৎসর পূর্ণ হলো।
নিজেকে যদি প্রশ্ন করি, গত সাড়ে চার বছর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কি শিখেছি? দেখি, দু’টি জিনিস। পশুর মত চলাফেরা ও দাসের মত চিন্তা করতে শিখেছি।
পশুর মত চলাফেরা শিখেছি, কেনো বলেছি, তার স্বল্প ব্যাখ্যা করছি আজ। দাসত্ব কিভাবে শিখেছি, সে কথা অন্য দিন।
দু’বছর আবাসিক হলের যে কক্ষটিতে আমি ছিলাম, সেখানে থাকতো-ঘুমাতো ৩৫জন ছেলে। সবাই ফ্লোরে দুইটি সারি হয়ে ঘুমাতাম; মাথাগুলো মাঝখানে, পা-গুলো দু’সারির দু’দিকে। প্রতি জনের জন্যে একটি করে বালিশ রাখার জায়গা ছিল না; তাই এক বালিশে দু’জন ভাগাভাগি করে ঘুমাতাম।
অনেক রাত আড্ডা দেয়ার অভ্যাস ছিল। ঘুমানোর জন্যে যখন হলে ফিরতাম, দেখতাম, সবাই শুয়ে যাবার ফলে রুমের ভিতর আর পা রাখার জায়গা নেই। দরজার সামনে ছেলেরা যেখানে জুতা রাখে, কেউ কেউ গড়িয়ে এসে সেখানে ঘুমিয়ে আছে। জুতার উপর।
কিছু কিছু আবাসিক হলে মসজিদে ঘুমানোর ব্যবস্থা থাকে, আমাদের তা ছিল না; রাতে মসজিদ বন্ধ করে রাখা হত। নিরুপায় হয়ে ছাদে গিয়ে শুয়ে থাকতাম। মশা-মাছিদের সাথে। বৃষ্টি-ঠাণ্ডা-গরমের রাতে।
এ তো বললাম কেবল ঘুমানোর আয়োজন। গোসলখানা ও টয়লেটের দুরবস্থা, বই-খাতা ও জুতা-কাপড়ের অ-নিরাপত্তা, নেতাদের মনোরঞ্জন ইত্যাদির কথা আজ নাই বা বললাম। অনেক অনেক কথা আছে। দেশ স্বাধীন হলে সব বলা যাবে, ইনশা-আল্লাহ।
খাবারের দু’টি উদাহরণ দিয়ে হলের পর্ব শেষ করছি। একবার ভাতের সাথে পেলাম আস্ত সিগারেট। আরেকবার ডালের সাথে পেলাম তেলাপোকা। আমি মেসে খেতাম। মেসের খাবারের চেয়ে ক্যান্টিনের খাবার আরও খারাপ। চিড়িয়াখানার পশুদের জন্যে যতটা যত্ন নিয়ে খাবার প্রস্তুত করা হয়, ক্যান্টিনের পরিচালকরা তার চেয়েও ভয়ানক রান্না করে। স্বাদে ও গন্ধে জঘন্য।
এ অভিজ্ঞতাগুলো আমার একার নয়; বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকা প্রায় সব ছাত্র-ছাত্রীর-ই এমন কিছু না কিছু তিক্ত-অভিজ্ঞতা রয়েছে।
এবার চিড়িয়াখানাটার একাডেমিক চরিত্রের কথা কিছু বলি।
একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা ছিল মানুষ। তারা চিন্তা করতে পারত, তাদের স্বাধীনতা ছিল। কিন্তু এখন তাদের উভদের মানবিক স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। একটি উদাহরণ দিচ্ছি।
এখন রাজনৈতিক যোগ্যতায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয়। ফলে যা হবার তাই হয়। ক্লাসে এসে তারা পড়াতে পারেন না। ছেলে-মেয়েরা একটু হাসাহাসি করলে তো হয়েছে। একেবারে ছাত্রজীবন বাতিলের ব্যবস্থা করা হয়। খুব কম শাস্তি হলে ফেল নিশ্চিত।
শিক্ষকরা তো দেবতা। তাদের ভুল ধরা যাবে না। বিপরীত যুক্তি দেয়া যাবে না। এমনকি ক্লাসে কাশিও দেয়া যাবে না। নিয়ম ভঙ্গ করলে তো “হুম”। ‘বের হয়ে যাও ক্লাস থেকে’, ‘বলছি না বের হয়ে যেতে’, ‘এখনও যাচ্ছ না কেনো’-শিক্ষকদের এসব মাতলামি শুরু হয়। মনে হয় যেনো, দেবতার রাজ্যে ছাত্ররা সব শয়তান।
ধরুন, একজন ছাত্র কিছু শিক্ষকের চেয়ে আসলেই অনেক ভালো জানে। শিক্ষকের সামনে ৫০ মিনিট মুখ বন্ধ করে বসে থাকাতে সে যন্ত্রণা অনুভব করে। তাই সে কিছু শিক্ষকের ক্লাস করতে চায় না।–এটা কি সম্ভব? ১০ বছর আগে সম্ভব ছিল; এখন সম্ভব না।
আগে একজন ছাত্রের কাছে কোনো ক্লাস ভালো লাগলে সে করত, ভালো না লাগলে করত না। কিন্তু এখন তা আর সম্ভব না। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা কিছু পড়াতে পারেন বা না-পারেন; ছাত্রদের কিছু জানা হোক বা না-হোক; কেউ ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতে পারবে না।
অন্যদিকে, একটা ছেলে ক্লাসে বসে গান শুনুক কিংবা সিনেমা দেখুক, সে অটো ১০ নম্বর পেয়ে যাবে। অর্থাৎ যারাই ক্লাসে নিজেদের শরীরের উপস্থিতি জানান দিবে, তারাই প্রত্যেক শিক্ষকের ক্লাসে স্বয়ংক্রিয় ১০ নম্বর করে পেয়ে যাবে। কি অদ্ভুত পদ্ধতি!!!
১০ নম্বরের মায়া ছেড়ে কেউ যদি ক্লাস না করে, তবুও তার রেহাই নেই। পরীক্ষা দিতে পারবে না। একই সেমিস্টার আবার পড়তে হবে। এবং নিয়ম হল, ছয় বছরের মধ্যে অনার্স শেষ করতে হবে। হাজার হাজার নিয়ম।
এ তো একটি উদাহরণ দিলাম মাত্র। মাদ্রাসার ছাত্রদের পড়ালেখার ক্ষেত্র সঙ্কোচন। ব্যাংক-বিসিএস-মুখী শিক্ষা ব্যবস্থাসহ হাজারটা উদাহরণ দেয়া যাবে।–যা প্রমাণ করে আমরা মানুষ না; আমরা চিড়িয়াখানার জন্তু-জানোয়ার।
July 1, 2015 at 7:45 PM