মাওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক চিন্তা ও বর্তমানে তার প্রস্তাবিত মডেলের প্রয়োজনীয়তা
মাওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক চিন্তার ভিত্তি হলো সূরা বাকারার দুটি আয়াত। আল্লাহ তায়ালা বলেন –
“এবং স্মরণ কর, যখন ইব্রাহীমকে তার প্রতিপালক কয়েকটি কথা দ্বারা পরীক্ষা করেছিলেন, এবং সেগুলো সে পূর্ণ করেছিলো। আল্লাহ বললেন, ‘আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা বানাচ্ছি। সে বললো, ‘আমার বংশধরগণের মধ্য হতেও?’ আল্লাহ বললেন, ‘আমার প্রতিশ্রুতি যালিমদের প্রতি প্রযোজ্য নয়’।” [বাকারা – ১২৪]
“স্মরণ কর, যখন ইব্রাহীম বলেছিলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! একে নিরাপদ শহর বানিয়ে দাও। আর এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতে ঈমান এনেছে, তাদেরকে ফলমূল হতে জীবিকা প্রদান করিও’। তিনি বললেন, যে কেউ কুফরি করলে, তাকেও কিছু কালের জন্যে জীবনোপভোগ করতে দিব, অতঃপর তাকে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে বাধ্য করব, এবং কত নিকৃষ্ট তাদের প্রত্যাবর্তনস্থল।” [বাকারা – ১২৬]
উপরোক্ত প্রথম আয়াতে ইব্রাহীম (আ) তার বংশধরের সবাইকে নেতা বানানোর ইচ্ছে পোষণ করেছিলেন। কিন্তু আল্লাহ বললেন, যালিমদেরকে তিনি নেতা বানাবেন না। দ্বিতীয় আয়াতে ইব্রাহীম (আ) কেবল ইমানদার লোকজনকে রিজিক দেয়ার জন্যে দোয়া করলেন। কিন্তু আল্লাহ বললেন, কাফেরদেরকেও তিনি রিজিক দিবেন।
উপরোক্ত দুটি আয়াতের আলোকে মাওলানা ভাসানী যে রাজনৈতিক তত্ত্ব দিলেন, সেটাকে বলা হয় ‘হুকুমতে রব্বানি’। হুকুমতে রব্বানির কথা হলো, কোনো জালিম শাসককে বা নেতাকে দেশ পরিচালনা করার সুযোগ দেয়া যাবে না। কিন্তু, দেশের নাগরিকরা অমুসলিম হলেও মুসলিমদের সমান খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান প্রাপ্ত হবে।
মাওলানা ভাসানী তার খেলাফতে রব্বানির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন –
“শিক্ষা-দীক্ষা, খাওয়া-পরা, ইত্যাদির প্রশ্নে স্রষ্টার নিকট যেমন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান ইত্যাদি পরিচয়ের কোনো বালাই নাই, মানুষের দৈহিক ও আত্মিক চাহিদার ক্ষেত্রে তেমনি ভেদাভেদ নাই। ঠিক তেমনি হুকুমতে রাব্বানিয়ার সাম্য মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে সকল নাগরিককে সমান সুযোগ ও অধিকার দেওয়া হইবে। আজ আর কোনো সন্দেহ নাই, একমাত্র রুবুবিয়াতের আদর্শই মানুষে মানুষে শাসন শোষণ ও হানাহানি বন্ধ করিয়া মানব জাতীকে সুখী করিতে পারে। আমি যখন হুকুমতে রাব্বানিয়ার কথা বলি, তখন শুধু কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরাই বিরোধিতা করেন না, সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণপন্থী এক শ্রেণীর আলেম-ওলামা ও ধর্মান্ধ রাজনীতিবিদও প্রচণ্ড আপত্তি উত্থাপন করেন। আমি বলিয়া থাকি, সকল সম্পত্তির মালিকানা একমাত্র আল্লাহর, মানুষ উহার আমানতদার মাত্র। তা আল্লাহর নামে সকল সম্পদ প্রয়োজনের ভিত্তিতে সমানুপাতিক হারে বণ্টন করিয়া ব্যক্তিগত মালিকানা উচ্ছেদ করিতে হইবে। কমিউনিস্টরা ব্যক্তিগত মালিকানা উচ্ছেদ কামনা করেন বটে, কিন্তু তাহাদের মতে, ইহা সম্পদ আল্লাহর নামে না হইয়া রাষ্ট্রের নামে হইতে হইবে। আলেম ওলামারা সবকিছুতে আল্লাহর মালিকানা মানিয়া লইয়া থাকেন বটে, কিন্তু ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ কামনা করেন না। এইভাবে হুকুমতে রাব্বানিয়ার বিরুদ্ধে শক্তিশালী দুটি মতবাদ রহিয়াছে। ইহা আমার অনুসারীদিগকে বুঝিয়া লইতে হইবে। তন্মধ্যে কমিউনিস্টদের বস্তু-সর্বস্ব চিন্তাধারা সম্পর্কে মানবজাতি বিশেষ করে মুসলিম জাহান হতাশ হইয়া পড়িয়াছে।”
“যে কেউ প্রশ্ন করিতে পারেন যে, হুকুমতে রব্বানিয়া কিভাবে অমুসলমানদের আপন করিয়া লইবে? যাহারা রুবুবিয়াতের মর্ম বুঝেন না, তাহাদের এই প্রশ্ন করা খুবই স্বাভাবিক। রুবুবিয়াত কোনো ধর্মের কথা নহে, উহা বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের একটি স্বতঃসিদ্ধ বিধান। তাই হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান সকল মানুষের জন্য হুকুমতে রব্বানিয়া, অর্থাৎ যে দেশে রুবুবিয়াতের আদর্শ রাষ্ট্রীয় ভিত্তিতে কায়েম হইয়াছে, তা কল্যাণকর বৈ কিছু নয়। মুসলমানদের জন্য যিনি রব বা পালনকর্তা, হিন্দুর জন্যও তিনিই একই বিধানে আলো হাওয়া ফল পানি বস্ত্র খাদ্য সবি যোগাইতেছেন। একমাত্র রুবুবিয়াতের আদর্শই মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্বের প্রতিষ্ঠা করিতে পারে। রুবুবিয়াতের আদর্শ নফসানিয়াত অর্থাৎ আমার নিমিত্ত, আমার উদ্দেশ্য, আমার লক্ষ্য, ইত্যাদি দৃষ্টিভঙ্গি মূল্যবোধ, চিন্তাধারা লুপ্ত করিয়া ফেলে। আলেম ওলামারা ও কমিউনিস্টরা দুই দিক হইতে জীবনের একই ব্যাখ্যা করিয়া বসেন, সূক্ষ্ম বা সঠিক দৃষ্টিতে যা নফসানিয়াতের-ই নামান্তর। নফসানিয়াত কখনো জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের সব ভাবে কল্যাণ সাধন করতে পারে না। পারিবে শুরু রুবুবিয়াত বা পালনবাদের ভিত্তিতে তৈরি রাষ্ট্র।”
সেক্যুলার রাষ্ট্র ও ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের মধ্যবর্তী একটি রাষ্ট্র তৈরির প্রস্তাবনা দিয়েছেন মাওলানা ভাসানী। তার এই মডেল বর্তমানে খুবই প্রয়োজন।
7 November 2019 at 11:41am