ইমাম রব্বানী আহমদ সিরহিন্দি-র গুরুত্ব
আমাদের ভারতবর্ষের ‘আহমদ সিরহিন্দি’কে তুরস্কে বলা হয় ‘ইমাম রব্বানী’। তুরস্কে ইমাম রাব্বানীকে এতোটাই গুরুত্ব দেয়া হয় যে, প্রায় সকল ইসলামী সভা-সেমিনার অথবা টিভি অনুষ্ঠানে তাঁর নাম গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করা হয়।
টার্কি ভাষায় ইমাম রব্বনীকে নিয়ে অনেক ডকুমেন্টারি হয়েছে। আন্তর্জাতিক স্কলারদের নিয়ে ৩/৪ দিন ব্যাপী বেশ কিছু সেমিনার হয়েছে, যা ইউটিউবে পাওয়া যায়। তাঁকে নিয়ে অসংখ্য টেলিভিশন টক-শো হয়েছে। এছাড়া, তুরস্কের বিভিন্ন স্কলারগণ তাঁর জীবন ও চিন্তা-ভাবনা নিয়ে নিয়মিত-ই আলোচনা করেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমাদের ভারতবর্ষের এই স্কলারদেরকে আমরা মূল্যায়ন করতে জানি না। বাংলা ভাষার অনলাইনে খুঁজে দেখলাম, শেখ আহমদ সিরহিন্দির তেমন কোনো উল্লেখ-ই নেই। গুগলে সার্চ করে কিছু আর্টিকেল পেলাম, বিদআতি দরবারী মানুষদের লিখা। আবার কিছু আছে সেক্যুলারদের লিখা, সেখানে সিরহিন্দিকে একজন ঐতিহাসিক ‘ভিলেন’ হিসাবে পরিচয় দেয়া হয়েছে। অথচ, ভারতবর্ষের ইসলামী আন্দোলনের জন্যে তিনি একজন সফল নায়কের ভূমিকা পালন করেছিলেন।
তিনি ভারতবর্ষের ইসলামী রাজনৈতিক চিন্তার এক মহান আদর্শ। তাঁর সময়ে সম্রাট আকবর হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-মুসলিম সবাইকে নিয়ে একটি নতুন ধর্ম প্রবর্তন করেছিলেন। তিনি আকবরের সেই নতুন ধর্মের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। তাই, তাঁকে ছাড়া এ অঞ্চলের ইসলামী রাজনৈতিক চিন্তা অপূর্ণাঙ্গ থেকে যায়।
বাংলাদেশের সেক্যুলার মহলে আজো অনেকেই আছেন আকবরি ধর্মের অনুসারী। তাঁদের সাথে উপযুক্ত আচরণের জন্যে ইমাম রব্বানীর চিন্তা-ভাবনা আমাদের খুবই প্রয়োজন।
এ ছাড়া, ইসলামী বিভিন্ন গ্রুপের অন্তর-দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্যেও তাঁকে আমাদের খুব প্রয়োজন।
যেমন, আমাদের দেশের সালাফীগণ সূফীদের অনেক বিরোধিতা করেন, আবার সূফীগণও সালাফীদের বিরোধিতা করেন। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা সালাফী ও সূফী উভয়ের বিরোধিতা করেন, আবার সালাফী ও সূফী উভয় ধারার মানুষেরা এক হয়ে ইসলামী আন্দোলনের বিরোধিতা করেন। এ সমস্যা থেকে মুক্তির জন্যে আহমদ সিরহিন্দি’র চিন্তা-ভাবনাগুলোকে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। কারণ, তিনি একদিকে যেমন শিরক ও বিদআতের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন, অন্যদিকে তিনি অনেক বড় মাফের একজন সূফী ও দরবেশ ছিলেন। একইসাথে সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াইও করেছিলেন।
এ কারণেই, এসব ঐতিহাসিক নায়কদেরকে নতুন করে তুলে আনা দরকার এবং নতুন প্রজন্মের সাথে তাঁদের পরিচয় করিয়ে দেয়া প্রয়োজন। কেবল বইতে থাকলেই হচ্ছে না, অনলাইনেও প্রচুর আর্টিকেল আসা উচিত। প্রয়োজনে বিভিন্ন বই থেকে উনাদের চিন্তা-ভাবনাগুলোকে অনলাইনে তুলে দিলে ভালো হতো।
আহমদ সিরহিন্দির উপর বাংলা ভাষায় কি কি কাজ হয়েছে, কারো জানা থাকলে প্লিজ জানাবেন। অনেক উপকৃত হবো।
কয়েকটি মন্তব্য –
১।
শায়খ আহমদ সিরহিন্দি সর্বকালের সুফিদের জন্য আদর্শ। তাঁর জীবনী নিয়ে আরবি বিভাগের ড. আফম আবু বকর সিদ্দিকি লিখেছেন বিপ্লবী মুজাদ্দিদ। এটাই আমার দেখা বাংলায় উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এছাড়া তাঁর সুফিজীবন নিয়ে পিএইচডি হয়েছে। তাঁর মাকতুবাত শরীফ অনেকেই বের করেছে। বাংলা হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দিয়ার তৃতীয় খণ্ডে (খুব সম্ভব) তাঁর আধ্যাত্মিক মাকাম নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এই চমৎকার তথ্যটি জানানোর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
২।
শায়খের কার্যাবলী শুধু এতটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় যে, ভারতের রাষ্ট্র কর্তৃত্বের পূর্ণতঃ কুফরীর দিকে চলে যাবার পথে তিনি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন এবং আজ থেকে তিন -চারশো বছন আগে এখানে ইসলামের নাম নিশানা মিটিয়ে দেবার জন্যে যে বিরাট ফিতনার সয়লাব প্রবাহিত হয় তার গতিধারাও পরিবর্তিত করে দেন। বরং এছাড়া আরো দুটো বিরাট কার্যও তিনি সম্পাদন করেন। এক, দার্শনিক ও বৈরাগ্যবাদী ভ্রষ্টতার কারণে তাসাউফের নির্মল ঝরণাধারায় যেসব ময়লা-আবর্জনা মিশ্রিত হয়ে যায়, তা থেকে তাকে পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র করে ইসলামের নির্ভেজাল ও আসল তাসাউফ পেশ করেন। দুই, তৎকালে জনসাধারণের মধ্যে যে সব জাহেলি রসম -রোওয়াজ বিস্তার লাভ করে তিনি তার কঠোর বিরোধিতা করেন এবং আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব ও সংস্কার সাধনের মাধ্যমে শরিয়ত অনুসারিতার এক শক্তিশালী আন্দোলন পরিচলনা করেন। এই আন্দোলনের হাজার হাজার সুদক্ষ কর্মী কেবল ভারতের বিভিন্ন এলাকায়ই নয় বরং মধ্য এশিয়ায়ও পৌঁছে যায় এবং সেখানকার জনগণের চরিত্র ও আকিদার সংস্কার সাধনের প্রচেষ্টা চালায়।” ———- আবুল আ’লা, ইসলামী রেনেসা আন্দোলন (অনুবাদ : আব্দুল মান্নান তালিব)
মাকতুবাতে ইমাম রব্বানী