“মন্ত্রী-এমপি শিক্ষা কেন্দ্র”
চিন্তা করলাম, জীবনে চাকরি করার আশা যেহেতু নাই, একটি কোচিং সেন্টার খুলব। নাম হবে “মন্ত্রী-এমপি শিক্ষা কেন্দ্র”। এখানে বিভিন্ন কোর্স থাকবে। বিশেষত, কিভাবে এমপি, মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী হওয়া যায়; সরকারী দলে থাকলে কিভাবে কথা বলতে হয় আর বিরোধী দলে থাকলে কিভাবে কথা বলতে হয়; দমন-পীড়ন-নির্যাতন-গুম-খুন কাকে বলে এবং তা কত প্রকার ও কি কি; বিরোধী দলকে কিভাবে দক্ষতার সাথে ‘দাবাইয়া’ রাখতে হয় –এ জাতীয় নানা কৌশল এখানে সহজ-সফলভাবে শিখানো হবে।
গত একশ বছরে এ-বাংলার ইতিহাস যদি দেখেন, দেখবেন, এখানকার গবর্নর-রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তন হলেও তাদের ভোকাবুলারি, কথা বলার স্টাইল –সব কিছু একই থাকে; একই ভাষায় তারা কথা বলেন, একই পদ্ধতিতে দেশকে ভালোবাসেন এবং একই উপায়ে বিরোধী দলকে সাইজ করেন।
যদিও অনেক সময় বিরোধীদের দমন-পীড়নে নিত্য-নতুন-আধুনিক কৌশল আবিষ্কার করেন। –এ কাজে যিনি যত সফল তিনি তত বেশি দিন ক্ষমতায় থাকার বৈধতা অর্জন করেন।
বিপরীত চিত্রও আছে। যে-যারা যখন বিরোধী দল বা পক্ষ হয়ে যান, তখন তারা বিরোধী ভোকাবুলারি গ্রহণ করেন।
‘মচৎকার’ আমাদের এ দেশ, এ রাষ্ট্র। এখানে “প্রধানমন্ত্রী শিক্ষা কেন্দ্র” বা “মন্ত্রী-এমপি তৈরি কারখানা” নামে একটি কোচিং সেন্টার খুললে রুটি-রোজগারের আর চিন্তা করতে হবে না। তেমন কষ্টও করতে হবে না। শুধু যখন যে ক্ষমতায় আসবে, তখন তার হাতে সরকার দলীয় স্ক্রিপ্টটা তুলে দিলেই চলবে।
কোচিং সেন্টারের প্রচারণা স্বরূপ একটি সরকার দলীয় স্ক্রিপ্ট তুলে দিলাম। কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে চাইলে সরাসরি মুখস্থ করে নিন।
(১৫ই জানুয়ারি-১৯৬৯-এ পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর জনাব আবদুল মোনায়েম খান যে বেতার ভাষণ দেন, তার কিছু অংশ…)
“…এইবার আমি প্রদেশের কয়েকটি সাম্প্রতিক ঘটনার প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে চাই। আপনারা অবগত আছেন, প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খানের নেতৃত্বে বর্তমান সরকার খাদ্য সমস্যার ন্যায় প্রতিটি সমস্যারই সুষ্ঠু সমাধান করিয়া জনসাধারণের অবস্থার দ্রুত উন্নয়নের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট ও গঠনমূলক পরিকল্পনার ভিত্তিতে অবিশ্রান্তভাবে কাজ করিয়া যাইতেছেন।
সরকারের কাজের গঠনমূলক সমালোচনা করিবার অধিকার প্রতিটি নাগরিকের রহিয়াছে এবং গণতান্ত্রিক দেশে ইহার প্রয়োজনও আছে। সকল প্রকার জনমত যাহাতে স্বাধীনভাবে প্রকাশ পাইতে পারে, বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার সে জন্য সর্বপ্রকার সুযোগ-সুবিধাই প্রদান করিয়াছে। কিন্তু বড়ই আফসোসের বিষয়, এই গণতান্ত্রিক অধিকারের অপব্যবহার করিয়া কতিপয় রাজনৈতিকদল গঠনমূলক সমালোচনার পরিবর্তে সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করিয়া বেড়াইতেছেন।
শুধু তাহাই নহে, সম্প্রতি ধর্মঘট, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ প্রভৃতির নামে তাহারা যে সকল বিশৃঙ্খলাপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করিতেছেন, তাহার ফলে সরকার সর্বদা আইন শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে ব্যস্ত থাকায় দেশের গঠনমূলক কাজগুলির অগ্রগতিও ব্যাহত হইতেছে। সমাজ ও নাগরিক জীবনে ক্রমাগতভাবে সংকট সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এই সকল রাজনৈতিকরা যে ধ্বংসাত্মক পথ গ্রহণ করিয়াছেন, উহার ফলে আমাদের গরীব শ্রমিক-মজুর, রিক্সাওয়ালা, দোকানদার, ব্যবসায়ী প্রভৃতি সাধারণ মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছেন বেশী।
সাম্প্রতিক কালে বিভিন্ন দিবস উদযাপনের নামে তাহারা যে অরাজকতাপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন, উহার ফলে কয়েকটি অমূল্য জীবন নষ্ট হয়। কিন্তু ইহাতেও তাহাদের মধ্যে কোনরূপ অনুশোচনার সৃষ্টি হইয়াছে বলিয়া মনে হয় না। বরঞ্চ দেখা যাইতেছে, তাহারা আবার আগামী ১৭ই জানুয়ারী অনুরূপভাবে আরও একটি দিবস উদযাপনের নামে জনসাধারণের জীবন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পরিকল্পনা আঁটিতেছেন এবং ভবিষ্যতের জন্যেও তাহারা বিভিন্ন প্রকারের ধ্বংসাত্মক প্রোগ্রামের হুমকি প্রদান করিতেছেন।
আপনারা নিশ্চয় আমার সহিত একমত হইবেন যে, এই সকল ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের ফলে আমাদের জাতীয় সম্পদ বিনষ্ট হইতেছে, যে সকল স্বার্থবাদী ব্যক্তি এই ব্যাপারে উস্কানি দিতেছেন, তাহাদের কোন ক্ষতি হইতেছে না। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের ভূমিকা কি? দেশের জনসাধারণ, বিশেষ করিয়া শিক্ষিত দায়িত্বশীল প্রতিটি নাগরিককে আমি এই ব্যাপারে ভাবিয়া দেখিবার জন্য অনুরোধ জানাইতেছি। স্বার্থান্বেষী মহলের অরাজকতা সৃষ্টির প্রয়াসকে সরকার কি সক্রিয়ভাবে দমন করিবে, না নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করিবে?
কেননা, সরকার যখন জনসাধারণের জানমাল রক্ষার জন্যে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন, তখন বলা হয়, সরকার নির্যাতন চালাইতেছে। আবার যদি সরকার নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেন, তবে বলা হইবে যে, সরকার আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করিতে অক্ষম। এখন আপনারাই ভাবিয়া দেখুন, সরকার কোন পথে যাইবে? আমার মনে হয় যে, কোন গণতান্ত্রিক সরকারের পবিত্রতম দায়িত্ব হইল জনসাধারণের জানমাল রক্ষা করা ও নাগরিকের জীবনের শান্তি শৃঙ্খলা অক্ষুণ্ণ রাখা।
কাজেই আমি আপনাদিগকে পুনরায় আশ্বাস দিতে চাই যে, প্রেসিডেন্ট আইয়ুব সরকার যে কোন মূল্যে সর্বপ্রকার বেআইনী প্রচেষ্টাকে রুখিয়া জাতীয় জীবনের অগ্রগতির ধারাকে অব্যাহত রাখিবে।”
[গভর্নরের মাসমধ্য বেতার বক্তৃতার বিবরণ
দৈনিক আজাদ: ১৭ জানুয়ারি ১৯৬৯; পৃষ্ঠা -৪]
May 20, 2015 at 7:46 PM ·