মিচিও কাকু ও স্টিফেন হকিং : বিশ্বাস ও অবিশ্বাস
বিজ্ঞানমনস্ক অবিশ্বাসীদের কাউকে যদি আপনি জিজ্ঞেস করেন, ‘ভাই, স্টিফেন হকিং-কে চিনেন?’
প্রশ্ন শুনেই তিনি চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে উঠে বলবেন, ‘আরে, মিঞা, চিনি না মানে…। উনারে না চিনলে তো আপনার জীবনের ষোল আনাই মিছে’।
এরপর, যদি আবার জিজ্ঞেস করেন, ‘ভাই, মিচিও কাকু-কে চিনেন?’
তিনি একটা শুকনা কাশি দিয়ে বলবেন, ‘কোন গ্রামের ‘মিস্ত্রী চাচা’র কথা বলছেন?’
আসলে, বিজ্ঞানমনস্ক বাঙালিরা স্টিফেন হকিং-কে খুব ভালোভাবে চিনলেও মিচিও কাকু-র নামও জানেন না অনেকেই। অথচ, দুই জনই বিশ্ববিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানে অবদানের ক্ষেত্রে মিচিও কাকু-র অবদান স্টিফেন হকিং-এর চেয়ে অনেক বেশি। মিচিও কাকু হলেন ‘স্ট্রিং তত্ত্বের’ কো-ফাউন্ডার, যা অতীতের বিগ ব্যাং তত্ত্বকে পিছনে ফেলে বর্তমান বিজ্ঞানে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে।
অবিশ্বাসী বাঙালিরা ব্যতীত, বিশ্বের অন্য মানুষদের কাছে, স্টিফেন হকিং এর চেয়ে মিচিও কাকু অনেক বেশি জনপ্রিয়। নিউ ইয়র্ক টাইমস বেস্টসেলার বইয়ের তালিকায় সাধারণত কোনো বিজ্ঞানের বই পাওয়া যায় না। কিন্তু সেখানেও মিচিও কাকু-র বিজ্ঞান বিষয়ক তিনটি বই বেস্টসেলার হয়েছে। অথচ, সেই তালিকায় স্টিফেন হকিং-এর নাম-গন্ধও নেই। মিচিও কাকু বয়সে স্টিফেন হকিং-এর চেয়ে ৫ বছরের ছোট হলেও জ্ঞানে স্টিফেন হকিং-এর চেয়ে ৫ ধাপ বেশি এগিয়ে আছেন।
যাই হোক, কাউকে ছোট করা বা বড় করা আমার উদ্দেশ্য না। আমি বরং বুঝতে চেষ্টা করছি – অবিশ্বাসী বাঙালিদের বিজ্ঞানমনস্ক দৌড় আসলে কতদূর? কেন এখানকার বিজ্ঞানমনস্করা কেবল স্টিফেন হকিং-এর গুণগান গায়? বিশ্বে কি কেবল একজন-ই মাত্র বিজ্ঞানী আছেন? স্টিফেন হকিং-এর চেয়েও বড় বড় বিজ্ঞানীদের কথা কেন বাঙালিরা জানেন না? কেন স্টিফেন হকিং অবিশ্বাসী বাঙালি বিজ্ঞানমনস্কদের আদর্শ?
প্রথম কারণ, অবিশ্বাসী বাঙালিরা এখনো সবাই বিজ্ঞানমনস্ক রয়ে গেছেন, কেউ বিজ্ঞানী হয়ে উঠতে পারেননি। দ্বিতীয় কারণ, অবিশ্বাসী বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধির চেয়ে কপটতা ও চাটুকারিতা বেশি। তৃতীয় কারণ, স্টিফেন হকিং একজন নাস্তিক হওয়ায় বিজ্ঞানমনস্ক বাঙালিরা তাকে নিয়ে পূজা করেন; অথচ হাল আমলের বিশ্ববিখ্যাত অন্যান্য আস্তিক বিজ্ঞানীদেরকে যথা সম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন।
উপরে, স্টিফেন হকিং-এর সাথে তুলনা করার জন্যে আমি মিচিও কাকু’র নামটি উল্লেখ করেছি। কারণ, দুই জনের গবেষণা ও কাজের ক্ষেত্র প্রায় এক হলেও তাদের বিশ্বাস ভিন্ন। কাকু আস্তিক, কিন্তু হকিং নাস্তিক।
অবিশ্বাসী বাঙালিরা প্রচার করেন যে, বিজ্ঞানী হতে হলে হকিং-এর মত নাস্তিক হতে হয়। কিন্তু বিজ্ঞানে চোখ মেললেই আমরা দেখি, কুখ্যাত নাস্তিকেরা আস্তিক বিজ্ঞানীদের ছাত্র হবার যোগ্যতাও রাখেন না। অন্য একটি লেখায় বিশ্বকুখ্যাত নাস্তিক রিচার্ড ডকিন্সের অজ্ঞতার বিষয়ে বলেছিলাম।
এ লেখায় বিজ্ঞানী কাকু ও নাস্তিক হকিং-এর চিন্তার পার্থক্যটা বোঝার মাধ্যমে আমরা জানার চেষ্টা করব – বিজ্ঞানে আস্তিক-নাস্তিক দ্বন্দ্বটা আসলে কি?
বিজ্ঞানী কাকুর জন্ম অ্যামেরিকায় হলেও তার বাবা-মায়ের জন্ম জাপানে। কাকুর পরিবার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। কাকু পড়াশুনা করেছেন অ্যামেরিকার খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলে। সুতরাং, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান উভয় ধর্মের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে কাকুর ধর্ম বিশ্বাস। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কাকু অইনস্টাইনের অনুসারী। তিনি এই তিনটি বিশ্বাসের সমন্বয়ে আবিষ্কার করেছেন স্ট্রিং ফিল্ড থিওরি। [অন্য একদিন এই তত্ত্বটি নিয়ে বিস্তারিত কথা বলব, ইনশাল্লাহ]
অন্যদিকে, নাস্তিক হকিং-এর জন্ম যুক্তরাজ্যের লন্ডনে। তার তার পূর্বপুরুষ সবার জন্মই ইউরোপে।
আপনি হয়তো ভাবছেন, ওদের বাপ-দাদার জন্ম জানা আমাদের প্রয়োজন কি? আসলে জানার প্রয়োজন আছে। ব্রিটিশ হকিং-কে কেন নাস্তিক হতে হলো? কেন বিজ্ঞানমনস্ক বাঙালিরা ব্রিটিশ হকিং-কে পূজা করে? কেন ইউরোপের দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের সাথে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের দ্বন্দ্ব হয়েছিল? কেন ইউরোপের সাথে আমাদের দাশ-মনিব সম্পর্ক? –এসব জানলে হকিং-এর সাথে আমাদের দেশীয় অবিশ্বাসী বিজ্ঞানমনস্কদের চিন্তার মিল কি, তা বুঝতে পারবো।
অবিশ্বাসী বাঙালিদের জ্ঞানের দৌড় স্টিফেন হকিং পর্যন্ত। তাই, এখানে আমি স্টিফেন হকিং-এর দু’একটি ভ্রান্ত চিন্তার উদাহরণ দিচ্ছি। এবং হকিং-এর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে বিজ্ঞানী মিচিও কাকু’কে হাজির করছি।
১ – ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক।
হকিং তার ‘The Grand Design’ বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে বলেন, ‘দর্শন মরে গেছে’। অন্যস্থানে বলেন, ‘ধর্ম অকার্যকর, এখন কেবল বিজ্ঞানের যুগ’। তার মতে, সত্য মানেই বিজ্ঞান। ধর্ম ও দর্শনের যাবতীয় সমস্যা বিজ্ঞান দিয়ে সমাধান করা সম্ভব। তাই, ধর্ম ও দর্শন এখন অপ্রয়োজনীয়।
কিন্তু বিজ্ঞানী মিচিও কাকু এই মতের সাথে একমত নন। তিনি বলেন, ‘আমি প্রচুর ধর্ম ও দর্শনের বই পড়েছি’। সত্যকে কোনো ভাবেই কেবল বিজ্ঞানের খাঁচার মধ্যে আবদ্ধ করা যায় না। এবং আইনস্টাইন ধর্ম ও দর্শনের গুরুত্ব নিয়ে প্রচুর লিখেছিলেন।
পাঠ্যবইয়ে বিজ্ঞানের সংজ্ঞা হলো – “বিশ্বের যাবতীয় ভৌত বিষয়াবলী পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ, যাচাই, নিয়মসিদ্ধ, বিধিবদ্ধ ও গবেষণালব্ধ পদ্ধতিতে যে জ্ঞান লাভ করা হয়, তাকে বিজ্ঞান বলে”।
কাকু বিজ্ঞানের এই সংজ্ঞাটিকে ভুল প্রমাণ করেন। তিনি বলেন, ‘বিজ্ঞান প্রথমে স্বপ্ন দেখে, তারপর তা বাস্তবায়ন করার জন্যে চেষ্টা করে এবং সূত্র আবিষ্কার করে। আইনস্টাইন স্বপ্ন দেখেছিলেন, তিনি একটি সূত্র তৈরি করবেন, যা দিয়ে স্রষ্টার উদ্দেশ্য বোঝা যায়। কিন্তু তিনি তা বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। অবশেষে আমরা এসে ‘স্ট্রিং তত্ত্ব’টি আবিষ্কার করেছি, যা দিয়ে স্রষ্টার কার্যক্রম সহজে বোঝা যায়’।
নাস্তিক হকিং বিজ্ঞানকে ‘ল্যাবরেটরি’ নামক একটি খাঁচায় বন্ধী করে রাখতে চাইলেও বিজ্ঞানী কাকু তার বিপরীত। আইনস্টাইনের মত কাকু’ও মনে করেন – ‘ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস, রাজনীতি ও অর্থনীতির সাহায্যে বিজ্ঞানকে উন্নত ও সমৃদ্ধ করা উচিত’। ধর্ম ও দর্শনের সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্ক বুঝানো জন্যে কাকু তার ‘Physics of the future’ বইয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন। সেখান থেকে একটি উদাহরণ হুবহু অনুবাদ করে তুলে দিচ্ছি।
“প্রযুক্তির ক্ষেত্রে জাপান বিশ্বের প্রথম সারির একটি দেশ। চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে যে সঙ্কট তৈরি হবে, রোবটের সাহায্যে সেই সঙ্কট মোকাবেলা করার জন্যে জাপান প্রচুর টাকা খরচ করছে। জাপান বিশ্বের প্রধান রোবটের জাতি হওয়াটা আশ্চর্যের কিছু নেই। এর প্রথম কারণ হলো জাপানের শিন্তো ধর্ম। এই ধর্ম মতে, জড়বস্তুর মধ্যেও এক ধরণের আত্মা রয়েছে; এমন কি মেশিনেরও আত্মা আছে। [ইসলাম ধর্ম মতেও, জড়বস্তুর চেতনা আছে, এবং তারা আল্লাহর ইবাদাত করে। এ নিয়ে অন্যদিন লিখব, ইনশাল্লাহ।] পশ্চিমা বিশ্বের শিশুরা সিনেমায় দেখে যে, রোবটেরা মানুষকে হত্যা করার জন্যে দৌড়াচ্ছে। তাই শিশুরা যখন রোবট দেখে তখন তাকে সন্ত্রাসী মনে করে ভয়ে চিৎকার শুরু করে। কিন্তু জাপানি শিশুরা মনে করে, রোবট তাদের মতই একটি আত্মা, রোবটেরাও খেলাধুলা করে এবং তারাও শান্তিপ্রিয়। জাপানের বড় বড় দোকানগুলোতে আপনি যখনি প্রবেশ করবেন, সচরাচর দেখতে পাবেন যে, রোবট আপনাকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। বিশ্বে ব্যবসায়িক যত রোবট আছে, তার ৩০ শতাংশ আছে জাপানে। জাপান রোবটকে ধ্বংসের নয়, বরং সাহায্যের প্রতীক মনে করে।” [সূত্র: মিচিও কাকু, ভবিষ্যতের পদার্থবিজ্ঞান, পৃষ্ঠা – ৪৮]
বিজ্ঞানী মিচিও কাকু তার এ বইটিতে অনেক স্থানেই প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে, ধর্ম ও দর্শন বিজ্ঞানের শত্রু নয়, বরং বন্ধু। ধর্ম ও দর্শনের সাহায্যে বিজ্ঞানের উন্নতি ঘটে, অবনতি নয়।
মিচিও কাকুর এই কথাগুলো আসলে আইনস্টাইনের কথার-ই প্রতিধ্বনি। ১৯৪১ সালে আইনস্টাইন তার “Science, philosophy and religion” নামক সম্মেলনের সর্বশেষ বাক্যে বলেছিলেন – ‘বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম পঙ্গু, এবং ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান অন্ধ”। সুতরাং, নাস্তিক হকিং যে বলেছিলেন, ‘ধর্ম ও দর্শনের আর কোনো প্রয়োজন নেই’; তা আসলে একটি ভ্রান্ত ও অবৈজ্ঞানিক কথা ছাড়া আর কিছুই নয়।
২ – আল্লাহ সম্পর্কে নাস্তিক হকিং-এর ভ্রান্তি এবং বিজ্ঞানী মিচিও কাকু’র জবাব।
বিজ্ঞানী কাকু তার অনেক বক্তব্যে একটি ঘটনাটি তুলে ধরেন। একবার, নাস্তিক হকিং বিজ্ঞানী কাকু’কে বললেন, ‘বিশ্বজগতে স্রষ্টার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ, বিশ্বজগত চলে পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়মে’। বিজ্ঞানী কাকু তখন নাস্তিক হকিং-কে বললেন, ‘আচ্ছা, বিজ্ঞানের সূত্র সৃষ্টি করলো কে? আমরা বিজ্ঞানীরা তো এ সূত্রগুলো তৈরি করি নাই, আমরা কেবল এ সূত্রগুলো আবিষ্কার করেছি। তাহলে, সূত্রগুলো আসলো কোত্থেকে? এই প্রশ্নের উত্তরে হকিং বলেন, ‘আমি তা জানি না’।
‘আম গাছে আম ধরে’ – এটা যেমন একটি সূত্র, আবার ‘পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে’ – এটাও একটি সূত্র। দুটি সূত্র একই মানের। ‘আম গাছে আম ধরে’ – এ সূত্রটি পৃথিবীর সবাই জানে। তাই, এ কথা কেউ বলে না – ‘আম গাছ আল্লাহর কথা শুনে না, বরং বিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী কাজ করে’।
মানুষ যখনি বিশ্বজগত সম্পর্কে নতুন কোনো সূত্র আবিষ্কার করে, তখনি কিছু কিছু বিজ্ঞানমনস্ক নাস্তিক বলতে শুরু করেন, ‘আল্লাহর প্রয়োজন নেই, কারণ, বিশ্বজগত বিজ্ঞানের এ সূত্র অনুযায়ী চলে।’ বিজ্ঞানী কাকু মনে করেন, নাস্তিকদের এই দাবীটা এক ধরণের মূর্খতা।
২০১৪ সালে, Starmus Festival-এ নাস্তিক হকিং বলেন যে, ‘স্রষ্টা যা জানে, আমরাও বিজ্ঞানের মাধ্যমে তা জানতে পারি। কোনো কিছুই বিজ্ঞানের অজানা নয়’। কিন্তু বিজ্ঞানী কাকু বলেন যে, বিজ্ঞান শত চেষ্টা করেও বিশ্বজগতের শতকরা ৫ ভাগও জানতে পারে না। বিশ্বজগতের বাকি ৯৫ ভাগেরও বেশি কিছু বিজ্ঞানের জানার বাইরে, এটা এক অদৃশ্য রহস্যের জগত।
নাসা বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণ ও গণনা অনুযায়ী মহাবিশ্বের মোট পদার্থ ও শক্তির ৭৩% ই হলো অদৃশ্য শক্তি বা ডার্ক এনার্জি। ২৩% হলো অদৃশ্য বস্তু বা ডার্ক ম্যাটার। ৩.৬% হলো মুক্ত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম, যা মহাজাগতিক ধূলিকণা। এবং মাত্র ০.৪% হলো পদার্থ, যা দিয়ে উপগ্রহ,গ্রহ, নক্ষত্র,ধূমকেতু ইত্যাদি গঠিত। সুতরাং বিজ্ঞানীদের মতে, হকিং-এর এই চিন্তা শতভাগ-ই ভুল। আমরা বিশ্বজগত সম্পর্কে তেমন কিছুই জানি না। [এ বিষয়ে আগে একটি বিস্তারিত লেখা লেখেছি।]
হকিং নিজেকে সবসময় নাস্তিক হিসাবে পরিচয় দেন। কিন্তু কাকু সবসময় বলেন, আমি আইনস্টাইনের আল্লাহ’তে বিশ্বাস করি। আইনস্টাইন ছিলেন ইহুদী। ইহুদীরা যেহেতু তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ পরিবর্তন করে ফেলেছেন, তাই ইহুদী ধর্মে আইনস্টাইনের তেমন বিশ্বাস ছিল না। কিন্তু আইনস্টাইন সবসময় বলতেন আমি বৌদ্ধ ও স্পিনোজার স্রষ্টায় বিশ্বাস করি। শাইখ হোসাইন য়েই সহ অনেক মুসলিম স্কলার বৌদ্ধকে নবী মনে করেন। কারণ, বৌদ্ধ একত্ববাদের প্রচার করেছিলেন। অন্যদিকে, স্পিনোজা ইহুদী ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে মুসলিম দার্শনিকদের দ্বারা প্রভাবিত হন। স্পিনোজার দু’জন শিক্ষক মাইমোনাইড্স এবং এবিসেব্রন ছিলেন মুসলিম দার্শনিকদের ভক্ত। এ কারণে দেখা যায়, বিজ্ঞানী কাকু বৌদ্ধ ধর্মের কঠিন ধর্মীয় রীতিনীতি এবং খ্রিস্টান ধর্মের মানব-ঈশ্বরের ধারণা বাদ দিয়ে অনেকটা একত্ববাদী স্রষ্টায় বিশ্বাসী। তিনি বলেন, যে স্রষ্টা বিশ্বজগতকে সুন্দর নিয়মে সাজিয়েছেন, আমি সেই স্রষ্টায় বিশ্বাসী।
কাকু বলেন, একজন মানুষের ধর্ম বিশ্বাস বিজ্ঞান জানা বা না-জানার উপর নির্ভর করে না। একজন বিজ্ঞানী একজন সাধারণ মানুষের মতই আস্তিক ও নাস্তিক উভয়টি হতে পারে। কেউ বিজ্ঞান বুঝে বলে সে নাস্তিক হয় ব্যাপারটা এমন না।
কাকু তার ‘The Future of the Mind’ বইয়ে এ বিষয়টি নিয়ে অনেক উদাহরণ দেন। একটি উদাহরণ নিচে তুলে ধরলাম।
একবার, বিজ্ঞানী মাইকেল পের্সিঙের তার অফিসে বিশ্বকুখ্যাত নাস্তিক রিচার্ড ডকিন্স-কে ডেকে আনলেন। তারা ডকিন্সকে বললেন, ‘গড হেলমেট’ দিয়ে আমরা আপনার মস্তিষ্কে কিছু ধর্মীয় অনুভূতি ও বিশ্বাসের সিগন্যাল পাঠাব। এবং আমরা দেখার চেষ্টা করব, আপনাকে নাস্তিক থেকে আস্তিক বানানো যায় কিনা।
এরপর, একটা বদ্ধ ঘরে ডকিন্সকে প্রবেশ করিয়ে ‘গড হেলমেটের’ সাহায্যে ৪০ মিনিট তার মস্তিষ্কে বিভিন্ন ধরণের ধর্মীয় অনুভূতির সিগন্যাল পাঠানো হলো। কিন্তু ডকিন্সের মস্তিষ্কে কোনো ধর্মীয় অনুভূতি জাগ্রত হয়নি, এবং তার নাস্তিকতারও পরিবর্তন ঘটেনি।
বিজ্ঞানী মাইকেল পের্সিঙের নাস্তিক ডকিন্সের মাথা পরীক্ষা করার পর বলেছিলেন, ‘ডকিন্সের মাথায় সমস্যা আছে। তাই, বিজ্ঞানের কারণে নয়, বরং তার মাথায় সমস্যা থাকার কারণে সে স্রষ্টায় বিশ্বাস করে না’। আমি মনে করি, ডকিন্সের মাথার চেয়েও তার হার্টে সমস্যা বেশি।
প্রাসঙ্গিক আরেকটি উদাহরণ দিচ্ছি। নিউরো বিজ্ঞানী মারিও বেয়াওরিগার্ড মানুষের ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা করেন। তার গবেষণাটির নাম – “The Spiritual Brain: A Neuroscientist’s Case for the Existence of the Soul”। পরবর্তীতে এই গবেষণাটি বিশ্বের সমস্ত নিউরো বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং জনপ্রিয়তা লাভ করে।
বেয়াওরিগার্ড বিভিন্নভাবে প্রমাণ করে দেখান যে, মানুষের মন তার ব্রেইনের উপর নির্ভরশীল নয়। বরং, মানুষের মন-ই তার ব্রেইন কাঠামোকে পরিবর্তন করে। মানুষের বিশ্বাস গড়ে উঠে তার চতুঃপার্শ্বের পরিবেশের উপর নির্ভর করে। বৈজ্ঞানিক যুক্তি-অযুক্তির কারণে তার বিশ্বাস পরিবর্তন হয় না। বিজ্ঞানের কারণে আস্তিক আরো বড় আস্তিক হয়, এবং নাস্তিক আরো বড় নাস্তিক হয়। বিজ্ঞান এখানে একটি প্রভাবক হিসাবে কাজ করে। পদার্থ বিজ্ঞানী মিচিও কাকু তার ‘The Future of the Mind’ বইতে নিউরো বিজ্ঞানী বেয়াওরিগার্ড-এর এই মতটি সমর্থন করেন।
অর্থাৎ, বিজ্ঞানের কারণে নয়, বরং পারিবারিক ও সামাজিক কারণে মানুষ আস্তিক ও নাস্তিক হয়ে থাকে। পারিবারিক ও সামাজিক কারণেই হকিং নাস্তিক হয়েছিল। অন্যদিকে, বিজ্ঞানী কাকু’র মত শত শত বিজ্ঞানী আস্তিক হবারও কারণও হলো তার পরিবার ও সমাজ।
সুতরাং, বিজ্ঞানমনস্ক বাঙালিদের নাস্তিক হবার কারণ বিজ্ঞান নয়, বরং পরিবার ও সমাজ।
নাস্তিক হকিং ও তার বিজ্ঞানমনস্ক বাঙালি দোসরগণ পরকালকে অস্বীকার করেন। অথচ, বিজ্ঞানী কাকু বিশ্বাস করেন জীন, ফেরেশতা, বেহেশত, দোজখ ও আখেরাত সহ সবকিছুর অস্তিত্বকে। তিনি তার বিপ্লবী ‘স্ট্রিং থিওরির’ আলোকে এসবের চমৎকার ব্যাখ্যা হাজির করেন। তিনি বলেন, জীন-ফেরেশতারা আমাদের চেয়ে হাজার-বিলিয়ন বছর এগিয়ে আছে। তারা আমাদের চেয়ে অনেক স্মার্ট। [এই স্ট্যাটাসটা একটু বড় হয়ে যাওয়ায় আজ আর সেসব লিখছি না। অন্যদিন, ইনশাল্লাহ।]
একটু বলে শেষ করছি,
বিজ্ঞানী মিচিও কাকু’র কোনো ভুল নেই, এমনটা বলবো না। তবে নাস্তিকদের চেয়ে তিনি অনেক বেশি সৎ, দক্ষ, জ্ঞানী ও বিজ্ঞানী। বাঙালি-মূর্খ-বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তিরা মিচিও কাকুর বই অনুবাদ করে নিজের নামে চালিয়ে দিলেও কাকুর নাম উল্লেখ করতে লজ্জা বোধ করেন। কারণ, বিজ্ঞানী কাকু’র নাম বললে তো মানুষ জেনে যাবে যে, নাস্তিকদের চেয়ে আস্তিক বিজ্ঞানীরা অনেক বেশি জ্ঞানী।
আমাদের বিজ্ঞানমনস্কদের দৌড় সর্বোচ্চ নাস্তিক হকিং পর্যন্ত। এর বেশি তারা যেতে পারেন না। তাই তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন –
مَثَلُهُمْ كَمَثَلِ ٱلَّذِى ٱسْتَوْقَدَ نَارًۭا فَلَمَّآ أَضَآءَتْ مَا حَوْلَهُۥ ذَهَبَ ٱللَّهُ بِنُورِهِمْ وَتَرَكَهُمْ فِى ظُلُمَـٰتٍۢ لَّا يُبْصِرُونَ
“তাদের উদাহরণ সে ব্যক্তির মত, যে একটু আগুন জ্বালালো, ফলে তার চতুর্দিক সামান্য আলোকিত হলো। ঠিক এমন সময় আল্লাহ তাদের সেই আলোটি নিয়ে নিলেন, এবং তাদেরকে অন্ধকারে ফেলে দিলেন। এখন তারা কিছুই দেখতে পাচ্ছে না”। [সূরা ২/বাকারা – ১৭]
অসাধারণ আল্লাহ তায়ালার এই উপমা।
অবিশ্বাসী বাঙালি বিজ্ঞানমনস্কদের কথা একটু ভাবুন। তারা ‘জ্বালো… জ্বালো… আগুন জ্বালো…’ বলে সামান্য কিছু আলোকিত হয় ঠিক, কিন্তু তখনি আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে অন্ধকারে ফেলে দেন। তারা ঘোর অন্ধকারে দিক-বিদিক ছুটাছুটি করে। এবং তাদের দৌড় ততটুকুই সীমাবব্ধ থাকে।
তথ্যগুলো যাচাই করার জন্যে এখানে সবগুলো লিঙ্ক দেয়া আছে।