একজন সত্য সন্ধানী ব্যক্তি কি বস্তুবাদী হতে পারে?
ফেইসবুকে রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছেন একজন ভাই। নাম – ‘সত্য সন্ধানী বাস্তববাদী’।
নামটি দেখে খুব অবাক হলাম। কারণ, তিনি কিভাবে একজন ‘সত্য সন্ধানী’ হয়ে আবার ‘বাস্তববাদী’ও হতে পারলেন?
আসলে, ঐ ভাইয়াটির দোষ নেই। সমস্যা আমাদের বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের – তাঁরা বাংলা ভাষার সঠিক প্রয়োগ করেন না। ফলে, ঐ ভাইয়াটির মত আরো অনেক ভাইয়া আছেন, যারা নিজেদেরকে একদিকে ‘সত্য সন্ধানী’ ভাবেন, আবার অন্যদিকে ‘বাস্তববাদী’ও ভাবেন।
বাংলা ভাষায় ‘বস্তুবাদ’ ও ‘বাস্তববাদী’ ধারণাটি যেমন সমস্যাজনক, এর বিপরীতে ‘ভাববাদ’ ধারণাটিও সমান সমস্যাজনক। এই দু’টি ছোট বৃত্তের বাইরে সত্য অবস্থান করে।
বস্তু, বস্তুবাদ ও বাস্তববাদী সম্পর্কে আজকে একটু বলি। অন্যদিন, ইনশাল্লাহ ‘ভাব’ ও ‘ভাববাদ’ নিয়ে বলা যাবে।
‘বস্তু’ শব্দটি থেকে এসেছে ‘বাস্তব’,‘বাস্তববাদী’ ও ‘বস্তুবাদ’ শব্দগুলো। কোনো কিছু সত্য বলে প্রমাণিত হলে বাংলা ভাষায় বলে ‘বাস্তব’। এবং ‘বাস্তবতা’কে যিনি জীবনের পথ হিসাবে গ্রহণ করেন, তাকে বলা হয় ‘বাস্তববাদী’। এ কারণে হয়তো, ঐ ভাইয়াটি মনে করে ছিলেন যে, বাস্তববাদী মানে সত্যবাদী।
বাংলা ভাষায় ‘বাস্তববাদী’ ও ‘বস্তুবাদী’ শব্দ দুটি প্রায় একই হলেও ছোট্ট একটা পার্থক্য আছে। যারা সব কিছুর কারণ ও ব্যাখ্যা জানতে চায়, তারা নিজেদেরকে বলেন – ‘আমরা বাস্তববাদী’। অন্যদিকে, যারা ধর্মে বিশ্বাস করেন না, অর্থাৎ বস্তুর বাইরে অন্যকিছু বিশ্বাস করেন না, তারা নিজেদেরকে বলেন – ‘আমরা বস্তুবাদী’। সহজভাবে বললে, বস্তুবাদী বুদ্ধিজীবীগণের অনুসারীরা হলেন বাস্তববাদী।
বস্তু শব্দটি বাংলা ভাষায় অনেক পুরানো হলেও, বস্তুবাদ বা বাস্তববাদী শব্দগুলো একেবারেই নতুন; এ শব্দগুলো বাংলা ভাষায় কখনোই ছিল না। গত এক’শ বছর থেকে ইংরেজি ভাষার অনুকরণে বাংলা ভাষার জন্যে এ শব্দগুলো আমদানি করা হয়।
প্রমথ চৌধুরীর মতে, ইংরেজি রিয়ালিজম [Realism] শব্দ থেকেই বাংলা বস্তুবাদ ও বাস্তববাদ শব্দগুলো এসেছে। কিন্তু এটি একটি ভুল অনুবাদ। সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকেই Realism শব্দের বাংলা ‘বস্তুবাদ’ বা ‘বাস্তববাদ’ করা যায় না।
এবার একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখি। ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে একজন ‘সত্য সন্ধানী’ কি একজন ‘বাস্তববাদী’ হতে পারেন?
১। ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে, একজন ‘সত্য সন্ধানী’ ব্যক্তি একটি ‘বাস্তববাদী’ বৃত্তে আবদ্ধ থাকতে পারেন না।
ইসলাম, ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মে আল্লাহ তায়ালা হলেন একমাত্র সত্য, এবং তিনি কোনো বস্তু নন। বস্তুবাদী বা বাস্তববাদী হয়ে আল্লাহকে বিশ্বাস করা যায় না, বরং আল্লাহকে বিশ্বাস করতে হলে অদৃশ্যভাবে বিশ্বাস করতে হয়। আল্লাহ তায়ালা কোর’আনে বলছেন –
إِنَّ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُم بِالْغَيْبِ لَهُم مَّغْفِرَةٌ وَأَجْرٌ كَبِيرٌ
“নিশ্চয় যারা তাদের পালনকর্তাকে অদৃশ্যভাবে ভয় করে, তাদের জন্যে রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।” [সূরা ৬৭/মুলক – ১২]
অর্থাৎ, মহা-সত্যকে বিশ্বাস করতে হলে, বস্তুর বাইরে দৃষ্টি দিতে হবে। মানে, অদৃশ্যভাবে মহা-সত্যের সন্ধানী হতে হবে।
২। দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে, ‘সত্য সন্ধানী’ ও ‘বাস্তববাদী’ ধারণা দুটি এক না।
দর্শনের গুরু সক্রেটিস ও প্লেটোর মতে, ‘যা সত্য তা বস্তু নয়, আবার যা বস্তু তা সত্য নয়। সত্য থাকে বস্তুর বাইরে’। সুতরাং, সত্যবাদীরা বস্তুবাদী হতে পারেন না।
৩। বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকেও, ‘সত্য সন্ধানী’ কেউ ‘বাস্তববাদী’ হতে পারেন না।
পৃথিবীর সকল বিজ্ঞানী একমত যে, বস্তুর বাইরেও সত্য আছে, সেই সত্যের নাম শক্তি। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা আরো স্পষ্ট করে বলেন, অদৃশ্য বস্তুর তুলনায় দৃশ্য বস্তু কিছুই না। অর্থাৎ, বস্তুর মধ্যে যদি ১% সত্য থাকে, তাহলে বস্তুর বাইরে আছে ৯৯% সত্য।
সুতরাং, কেউ সত্য সন্ধানী হতে চাইলে, তাঁকে অবশ্যই ‘বস্তুবাদ’ ও ‘বাস্তববাদী’ জাতীয় ভুল শব্দগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে। এবং একইসাথে, রিয়ালিজমের পুতুলনাচ এবং আইডিয়ালিজমের ছায়াবাজি থেকে বের হয়ে সত্যের সন্ধানী হতে হবে।