ধর্মের পোষাকে রাজনীতি করার ক্ষতি – ইবনে খালদুন
ধর্মের পোষাকে রাজনীতি করার ক্ষতিকর দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন ইবনে খালদুন। তাঁর মুকাদ্দিমা বইয়ের ১ম খণ্ডে একটি অধ্যায়ের নাম “গোত্রপ্রীতির সাহায্য ছাড়া ধর্ম প্রচার সম্পূর্ণ হয় না” (أن الدعوة الدينية من غير عصبية لا تتم)।
আমার লেখাটা পড়ার আগে ইবনে খালদুনের উপরোক্ত অধ্যায়টি পড়ে নেয়ার অনুরোধ রইলো। যারা বাংলায় পড়তে চান, তাদের জন্যে কমেন্টে বইটির পিডিএফ দেয়া আছে। ৩০০ নং পৃষ্ঠা থেকে পড়তে পারেন।
ধর্মের পোষাকে রাজনীতি করার ক্ষতি কি, তা ইবনে খালদুনের দৃষ্টিতে সংক্ষেপে এখানে বলছি।
১)
কাউকে কোর’আন-হাদিস মেনে চলতে বলা, নামাজ- রোজা করতে বলা, ইত্যাদি হলো ধর্মীয় কাজ। আর, একটি সমাজে অন্যায় দূর করা, ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা, সৎ কাজের আদেশ দেয়া, এবং অসৎ কাজের নিষেধ করা, এসব হলো রাজনৈতিক কাজ।
যারা সাধারণ মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকেন, এবং বিভিন্ন ধর্মীয় কাজ করেন, তাঁদের আশেপাশে অনেক মানুষ জড়ো হতে থাকে। কেবল ধর্মের ভিত্তিতে জড়ো হওয়া অনেক মানুষকে নিয়ে কেউ যখন সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে, তখন সে ব্যর্থ হয়। কারণ, সমাজের চলমান শক্তিশালী অন্যায়কে রোধ করার জন্যে কেবল ধর্মীয় দল গঠন করাই যথেষ্ট নয়, বরং এর জন্যে অবশ্যই গোত্রপ্রীতি বা দেশপ্রেমের প্রয়োজন। ইবনে খালদুনের মতে, দেশপ্রেমে সংঘবদ্ধ জনগোষ্ঠীর সাহায্য ছাড়া সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা যায় না।
এ কারণে, প্রত্যেক নবীকে আল্লাহ তায়ালা তাঁর দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী পরিবার বা গোত্রে পাঠিয়েছেন, যাতে নবীর দাওয়াতের বিরুদ্ধে যারা কথা বলবেন, তাঁদেরকে প্রতিরোধ করা যায়। নবী-রাসূলগণ তাঁদের পরিবার ও গোত্রের সাহায্য নিয়েই আল্লাহর পথে মানুষকে দাওয়াত দিতেন। যদিও আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছে করলে কোনো প্রকার সাহায্য ছাড়াই নবীরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে পারতেন, তবুও মানুষকে শিক্ষা দেয়ার জন্যে নবীরা তাঁদের পরিবার ও গোত্রের সাহায্য নিয়েই দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছিলেন।
২)
যারা কোনো সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবে, তারা যতই সৎ হোক না কেন, তাদের গোত্রপ্রীতি বা দেশপ্রেম থাকতে হবে। নতুবা ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তারা নিজেরাই ধ্বংস হয়ে যাবে। এমনকি যারা ধর্মের ছদ্মবেশে ক্ষমতায় যাবার ইচ্ছে করে, তারাও অসংখ্য বাধাবিপত্তির কারণে অনিবার্যভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে।
এ বিষয়ে ইবনে খালদুন বলেন –
فإذا ذهب أحد من الناس هذا المذهب وكان فيه محقاً قصر به الانفراد عن العصبية، فطاح في هوة الهلاك. وأما إن كان من الملبسين بذلك في طلب الرئاسة، فأجدر أن تعوقه العوائق وتنقطع به المهالك
[مقدمة ابن خلدون ص: 79، بترقيم الشاملة آليا]
“কোনো সাধারণ মানুষ যদি সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করার জন্যে অগ্রসর হয়ে যায়, এবং সে সত্যবাদী হলেও গোত্রপ্রীতি বা দেশপ্রেমের অভাব তার এ প্রচেষ্টাকে খর্ব করে তুলবে। এবং পরিণামে সে ধ্বংসের আবর্তে পতিত হবে। আর যদি (ধর্মের) ছদ্মবেশে সে নেতৃত্ব লাভের ইচ্ছা পোষণ করে, তা হলেও তার পথে বাধার সীমা নেই। এবং এর পরিণামে তার ধ্বংস অনিবার্য।“ [মুকাদ্দিমা, ১ম খণ্ড, পৃ – ৩০১]
৩)
উপরোক্ত তত্ত্বকে প্রমাণ করার জন্যে ইবনে খালদুন ইতিহাস থেকে অনেক উদাহরণ দেন। একটি উদাহরণ এমন।
ইব্রাহীম নামের একজন বাগদাদের সিংহাসনে বসার পর বাগদাদে চরম অরাজকতা শুরু হয়। চতুর্দিকে চুরি, ডাকাতি, খুন, ঘুম, লুণ্ঠন, দুর্নীতি চলতে থাকে। তখন বাগদাদের নাগরিকরা শাসক ইব্রাহীমের কাছে এসব অত্যাচারের বিচার চায়, কিন্তু, ইব্রাহীম নাগরিকদের কথায় কোনো সাড়া দেয়নি, এবং এসব অন্যায় ও জুলুম প্রতিরোধ করার কোনো ব্যবস্থাও গ্রহণ করেননি।
এরপর কিছু ধার্মিক ও সৎ ব্যক্তি এসব চোর-ডাকাত, খুনি ও দুষ্কৃতিকারীদের প্রতিরোধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তখন খালেদ নামের এক ব্যক্তি সাধারণ মানুষকে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করতে আহবান জানান। সাধারণ মানুষ দুষ্কৃতিকারীদের উপর আক্রমণ চালায়, এবং খালেদ দুষ্কৃতিকারীদের শাস্তি দিয়ে তাদেরকে দমন করে।
এর কিছুদিন পর, আবু হাতেম নামে আরেক ব্যক্তি আবির্ভূত হন। তিনি তার গলায় কোর’আন ঝুলিয়ে মানুষকে সৎকর্মের আদেশ ও অসৎ কর্মের নিষেধ করেন। এবং আল্লাহর কিতাব ও নবীর সুন্নত পালনের প্রতি আহবান করেন। আবু হাতেমের ডাকে বিভিন্ন স্তরের মানুষ সাড়া দেয়। তিনিও চোর-ডাকাত-খুনিদের অত্যাচার বন্ধ করতে সক্ষম হন।
কিন্তু, এরপর আবু হাতেম বললো, যারা কোর’আন-হাদিস মানে না, আমি তাদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করবো। তখন আবু হাতেমকে খালেদ বললেন যে, “দ্যাখো, আমি শাসক ইব্রাহীমের কোনো দোষ দেখি না। তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রয়োজন নেই।” তখন আবু হাতেম বললেন, “আমি এমন সব লোকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো, যারা আল্লাহর কোর’আন ও রাসূলের সুন্নতের বিরোধিতা করে, সে যত বড় শাসকই হোক না কেন”।
আবু হাতেমের এ কথা শুনে শাসক ইব্রাহীম তার সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত করেন, এবং আবু হাতেমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। অতঃপর আবু হাতেম পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায়।
অর্থাৎ, গোত্রপ্রীতির মাধ্যমে অথবা দেশপ্রেমের মাধ্যমে উজ্জীবিত একদল মানুষকে নিজের সাথে না রেখে, কেবল ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে তোলা একটি দলকে নিয়ে, আবু হাতেম বাগদাদের শাসক ইব্রাহীমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজেই পালিয়ে যান।
৪)
উপরোক্ত ঘটনাটি উল্লেখ করার পর ইবনে খালদুন বলেন –
ثم اقتدى بهذا العمل بعد كثير من الموسوسين يأخذون أنفسهم بإقامة الحق ولا يعرفون ما يحتاجون إليه في إقامته من العصبية، ولا يشعرون بمغبة أمرهم ومآل أحوالهم. والذي يحتاج إليه في أمر هؤلاء إما المداواة إن كانوا من أهل الجنون، وإما التنكيل بالقتل أو الضرب إن أحدثوا هرجاً، وإما إذاعة السخرية منهم وعدهم من جملة الصقاعين.
[مقدمة ابن خلدون ص: 80، بترقيم الشاملة آليا]
“এমন বহু লোকের আবির্ভাব ঘটেছে, যারা তাঁদের মনের মধ্যে সত্য প্রতিষ্ঠার একটি অসার ধারণা পোষণ করতেন। অথচ, সেই সত্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে যে গোত্রপ্রীতি বা দেশপ্রেমের প্রয়োজন, সে সম্পর্কে কোনো খোঁজই তারা রাখতেন না। এসব লোক তাদের কাজের বাধাবিপত্তি দূর করা এবং তাদের চতুর্দিকের বাস্তবতার প্রতি কোনো খেয়ালই করতেন না। এসব লোকের চিকিৎসা করতে হবে, যদি তারা পাগল হয়ে থাকে। এরা যদি গোলযোগ সৃষ্টি করার চেষ্টা করে, তবে তাদেরকে পিটুনি দিতে হবে। অথবা, এসব কিছুই না করে তাদেরকে ভাঁড় মনে করে তাদের সব কথাকে হাসি-তামাসা করে উড়িয়ে দিতে হবে।“ [মুকাদ্দিমা, ১ম খণ্ড, পৃ – ৩০২]
৫)
যে কোনো সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার জন্যে ইবনে খালদুন একটি তত্ত্ব প্রদান করেছেন, যা বাংলায় বললে এমন – “মাছ ধরতে নদীতে নামো, কিন্তু কুমিরের সাথে লড়াই করো না”।
এ তত্ত্বটি রাসূল (স)-এর একটি হদিসের আলোকেই নির্মাণ করেছেন ইবনে খালদুন।
রাসূল (স) বলেন –
من رأى منكم منكراً فليغيره بيده، فإن لم يستطع فبلسانه، فإن لم يستطع فبقلبه
“তোমাদের মধ্যে কেউ যদি কোনো অন্যায় দেখে, তাহলে সে যেন তা হাতের দ্বারা বন্ধ করে। যদি এতে সমর্থ না হয়, তাহলে যেন জিহ্বার দ্বারা বন্ধ করে। যদি এতেও সমর্থ না হয়, তাহলে যেন অন্তর দ্বারা প্রতিহত করে।“
ইবনে খালদুনের মতে, মানুষ তার সমর্থের বাইরে কিছু করা উচিত নয়। যেহেতু এই হাদিসে তিনটি অপশন যে হয়েছে, তাই যে যার সমর্থ অনুযায়ী অসৎ কাজের নিষেধ করবে। কেউ যদি হাত দিয়ে প্রতিহত করতে চায়, তাহলে আগে বাস্তবতা বুঝতে হবে, এবং দেখতে হবে দেশপ্রেমের ভিত্তিতে গঠিত সংঘবদ্ধ কোনো দল তার সমর্থনে আছে কিনা। যদি দেশপ্রেমিক সংঘবদ্ধ কোনো দল কারো অধীনে থাকে, তখন সে হাত দ্বারা প্রতিহত করতে পারবে। কিন্তু সমর্থ ব্যতীত কেউ যদি হাত দ্বারা অন্যায় প্রতিহত করতে যায়, তাহলে সে নিজেই ধ্বংস হয়ে যাবে।
একইভাবে, ইবনে খালদুনের মতে, কেবল ধর্মীয় দল দ্বারাও সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা যায় না। গোত্রপ্রীতি বা দেশপ্রেম ছাড়া কেবল ধর্মের দাবী নিয়ে যারা ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে চায়, বা ক্ষমতায় যেতে চায়, তারাও ধ্বংস হয়ে যায়।