উলিল আমর কারা?

ইসলামী রাজনীতিতে কর্মীদেরকে নিজের আয়ত্তে আনার জন্যে, অর্থাৎ, নেতার আনুগত্য করার জন্যে একটি আয়াত ব্যবহার করা হয়।

আয়াতটি হলো –

يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓا۟ أَطِيعُوا۟ ٱللَّهَ وَأَطِيعُوا۟ ٱلرَّسُولَ وَأُو۟لِى ٱلْأَمْرِ مِنكُمْ ۖ فَإِن تَنَـٰزَعْتُمْ فِى شَىْءٍۢ فَرُدُّوهُ إِلَى ٱللَّهِ وَٱلرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلْيَوْمِ ٱلْءَاخِرِ ۚ ذَ‌ٰلِكَ خَيْرٌۭ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا

“হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর। রাসূল ও উলিল আমরের আনুগত্য কর। এরপর যদি তোমাদের মধ্যে কোনো বিষয়ে মতবিরোধ ঘটে, তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের নিকট ফিরে যাবে; যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতকে বিশ্বাস কর। এটাই তোমাদের জন্যে সুন্দর ও উত্তম উপায়”। [সূরা ৪/নিসা – ৫৯]

এ আয়াতটি অনুবাদ করার সময় বাংলাদেশের ইসলামপন্থীরা ‘উলিল আমরের’ অর্থ করেন – ‘নেতা’। এবং এ আয়াতকে সূত্র ধরে তারা বলেন, নেতার আনুগত্য করা ফরজ। অনেক সময়ে কর্মীদের ভিন্ন চিন্তা ও যুক্তিকে দমন করার জন্যেও এই আয়াতটিকে ব্যবহার করা হয়।

অথচ, উলিল আমরের অর্থ যদি “নেতা” করা হয়, তাহলে কোর’আনের নিচের আয়াতটির সাথে বৈপরীত্য তৈরি হয়।

وَقَالُوا رَبَّنَا إِنَّا أَطَعْنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَاءَنَا فَأَضَلُّونَا السَّبِيلَا

“হে আমাদের পালনকর্তা, আমরা আমাদের নেতা ও বড়দের বা মুরব্বীদের কথা মেনে নিয়েছিলাম, তাই তারা আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল”। [সূরা ৩৩/আহযাব – ৬৭]

দেখুন, প্রথম আয়াতে ‘নেতা’র আনুগত্য করার কথা বলা হয়েছে, আর দ্বিতীয় আয়াতে নেতার আনুগত্য করার কারণে জাহান্নামে যেতে হয়েছে। তার মানে দুই আয়াতের ‘নেতা’ শব্দের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। প্রথম আয়াতের উলিল আমর মানে আসলে কেবল ‘নেতা’ নয়। উলিল আমরের আরো অনেক অর্থ রয়েছে।

উলিল আমর [أُو۟لِى ٱلْأَمْرِ ] দুটি শব্দ – উলিল ও আমর। উলিল শব্দের অর্থ অধিকারীগণ, অভিভাবকগণ, বা, সহযোগীগণ। “আমর” শব্দটি কোর’আনে অসংখ্য অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন –

কোর’আনে সবচেয়ে বেশি ‘আমর’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে “কাজ” অর্থে। মানুষ যখন কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করার জন্যে ওয়াদাবদ্ধ হয়, তখন সেই কাজের কর্মকর্তাকে উলিল আমর বলা হয়।
[সূত্র – কোর’আন, ২৪: ৬২]

‘আমর’ শব্দের দ্বিতীয় অর্থ হলো ওহী বা আল-কোর’আন। যারা কোর’আনের অধিকারী বা কোর’আনের জ্ঞানে জ্ঞানী তাদেরকে ‘উলিল আমর’ বলা হয়।
[সূত্র – কোর’আন, ২১: ৭৩]

‘আমর’ শব্দের তৃতীয় অর্থ হলো ইসলামী শরিয়াহ বা ইসলামী আইন। যারা ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ বা বিচারকার্য পরিচালনা করেন, তাদেরকে ‘উলিল আমর’ বলা হয়।
[সূত্র – কোর’আন, ৪৫: ১৮]

‘আমর’ শব্দের চতুর্থ অর্থ হলো আদেশ। যারা আদেশ করার ক্ষমতা রাখেন, তাদেরকে ‘উলিল আমর’ বলা হয়। আল্লাহ ও রাসূল (স)-এর পর একজন মানুষকে আদেশ করার সর্বাধিক অধিকারী হলেন তার মা ও বাবা।
[সূত্র – কোর’আন, ১৯: ৩২; ৬: ১৫১]

‘আমর’ শব্দের পঞ্চম অর্থ হলো রূহ। রূহের অধিকারী স্বচ্ছ ও সুন্দর হৃদয়কে ‘উলিল আমর’ বলা হয়।
[সূত্র – কোর’আন, ১৭: ৮৫]

কোনো ধরণের প্রতিদানের আশা না করে যারা আল্লাহর পথে মানুষকে ডাকে, তাদেরকেও ‘উলিল আমর’ বলা হয়।
[সূত্র – কোর’আন, ১০: ৭২; ৩: ১০৪]

সমাজের যে কোনো জ্ঞানী মানুষদেরকেও ‘উলিল আমর’ বলা হয়।
[সূত্র – কোর’আন, ৫২: ৩২; ২১: ৭]

সুতরাং, ‘উলিল আমর’ অর্থ কেবল নেতা নয়, বরং উলিল আমর অর্থ হলো কোর’আনের জ্ঞানে জ্ঞানী, সাধারণ জ্ঞানের জ্ঞানী, ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ, স্বার্থহীন সৎকাজের আদেশকারী, কোনো কাজের দায়িত্বশীল, মাতা-পিতা, শিক্ষক, এবং নিজের আকল-বুদ্ধি।

অর্থাৎ, উলিল আমর দ্বারা অনেক ভিন্ন ভিন্ন মানুষের আনুগত্যের কথা বলা হয়েছে, কেবল নেতার আনুগত্য নয়। আর, নিজের বিবেক বুদ্ধি বাদ দিয়ে কেবল নেতার আনুগত্য করলে হয়তো জাহান্নামেও যেতে হবে।

আরো পোস্ট