ইবনুল আরাবীর কালিমা থিউরি

ইবনুল আরাবী তার ফুসুলুল হিকাম গ্রন্থের শুরুতেই একটি থিউরি দেন, যার মাধ্যমে তিনি দেখান যে – পবিত্র কোর’আন, মানুষ ও বিশ্বজগত একই সুতোয় গাঁথা। কোর’আন যেমন আল্লাহর নফস থেকে শব্দ বা কালিমা আকারে এসেছে, তেমনি মানুষ ও বিশ্বজগতও আল্লাহর নফস থেকে শব্দ আকারে এসেছে। অর্থাৎ, কোর’আন সহ পৃথিবীর সব কিছুই আল্লাহর শব্দ। আরো সহজ করে বললে, কোর’আন নিয়ে গবেষণা করা এবং মানুষ বা বিশ্বজগত নিয়ে গবেষণা করা একই কথা।

ইবনে আরাবীর মতে, বিশ্বজগতের প্রতিটি জিনিস আল্লাহ তায়ালার একেকটি শব্দ। কারণ, সব কিছুই আল্লাহর কুন (كن) শব্দের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে।

আল্লাহ তায়ালা বলছেন –

أَوَلَيْسَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بِقَادِرٍ عَلَىٰ أَن يَخْلُقَ مِثْلَهُم ۚ بَلَىٰ وَهُوَ الْخَلَّاقُ الْعَلِيمُ — إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَن يَقُولَ لَهُ كُن فَيَكُونُ

“যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, তিনি আবার এমন অনুরূপ কিছু সৃষ্টি করতে সমর্থ নন? হাঁ, নিশ্চয় তিনি মহাস্রষ্টা, সর্বজ্ঞ। তিনি যখন কোনো কিছু করার ইচ্ছে করেন, তখন তাকে বলেন “কুন বা হও”। তখন সাথেসাথে তা হয়ে যায়”। [সূরা ৩৬ / ইয়াসিন – ৮১, ৮২]

অর্থাৎ, এই মহাবিশ্বের প্রতিটি প্রাণী ও বস্তু তাদের বর্তমান রূপ লাভ করার পূর্বে ছিলো আল্লাহ তায়ালার একেকটি শব্দ।

একইভাবে আদম (আ) থেকে শুরু করে ঈসা (আ) সহ পৃথিবীর প্রতিটি মানুষও আল্লাহ তায়ালার একেকটি শব্দ। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলছেন –

إِنَّ مَثَلَ عِيسَىٰ عِندَ اللَّهِ كَمَثَلِ آدَمَ خَلَقَهُ مِن تُرَابٍ ثُمَّ قَالَ لَهُ كُن فَيَكُونُ

“নিশ্চয় ঈসার উদাহরণ আদমের-এর মতোই। তিনি তাকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, এরপর বললেন, “হও”, ফলে সে হয়ে গেলো”। [সূরা ৩/ আলে ইমরান – ৫৯]

কেবল আদম (আ) অথবা ঈসা (আ) নন, বরং আমরাও সৃষ্টি হবার পূর্বে ছিলাম আল্লাহ তায়ালার একেকটি শব্দ। আল্লাহ তায়ালা বলছেন –

هُوَ الَّذِي يُحْيِي وَيُمِيتُ فَإِذَا قَضَىٰ أَمْرًا فَإِنَّمَا يَقُولُ لَهُ كُن فَيَكُونُ

“তিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান, এবং যখন কোনো কিছু করার ইচ্ছে করেন, তখন তাকে বলেন – “হও”, ফলে তা হয়ে যায়”। [সূরা ৪০/ মু’মিন – ৬৮]

উপরোক্ত সবগুলো আয়াত থেকে ইবনুল আরাবী এই থিউরীতে উপনীত হন যে, কোর’আন যেমন আল্লাহর কালিমা বা শব্দ, তেমনি বিশ্বজগতের সবকিছু-ই আল্লাহর একেকটি শব্দ। সুতরাং, কোর’আনের মতোই বিশ্বজগতের বস্তুগুলো, প্রাণীগুলো ও মানুষগুলো সম্মানিত।

ইবনুল আরাবীর উপরোক্ত কালিমা থিউরি থেকে আধুনিক কালের অনেক সমস্যার সমাধান করা যায়।

১) আধুনিক কালে মানবাধিকার নিয়ে যে আন্দোলন হচ্ছে, সে আন্দোলনটা বুঝার জন্যে ইবনুল আরাবীর কালিমা থিউরিটা বুঝা প্রয়োজন। ইবনে আরাবীর মতে, কোর’আনের আয়াতের মতো প্রতিটি মানুষও আল্লাহর আয়াত। কোর’আনের মতো প্রতিটি মানুষও আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা একেকটি শব্দ। সুতরাং, কোর’আনের মতো মানুষকেও সম্মান করা প্রয়োজন।

২) আধুনিক জামানার অন্য একটি আন্দোলন হলো পরিবেশ আন্দোলন। মানুষ নিজের ভোগ বিলাসের জন্যে ইচ্ছেমতো পরিবেশের ক্ষতি করে চলছে। ইবনুল আরাবীর কালিমা থিউরির মাধ্যমে আমরা বুঝেছি, মানুষ যেমন আল্লাহর শব্দ, তেমনি গাছপালা, সাগর-নদী, জন্তু-জানোয়ার সহ পরিবেশের সকল উপাদান আল্লাহর একেকটি শব্দ। সুতরাং, মানুষ কোর’আনকে যেমন সম্মানের সাথে গ্রহণ করে, পরিবেশকেও সেভাবে সম্মানের সাথে গ্রহণ করা উচিত, এবং পরিবেশের ক্ষতি না করা উচিত। সুতরাং, মুসলিমদের দায়িত্ব হলো, প্রতিটি মানুষ, প্রাণী ও বস্তুকে আল্লাহ তায়ালা যেভাবে সৃষ্টি করেছেন, তাদেরকে ঠিক সেভাবে রক্ষা করা।

৩) ধর্ম ও বিজ্ঞানের যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে আধুনিককালে, সে দ্বন্দ্বও মিটে যায় ইবনে আরাবীর এই থিউরির মাধ্যমে। ইবনে আরাবীর মতে, কোর’আনে যেমন আল্লাহর শব্দ ও আয়াত রয়েছে, তেমনি বিশ্বজগতেও আল্লাহর শব্দ ও আয়াত রয়েছে। সুতরাং, কোর’আনের আয়াত নিয়ে গবেষণা করা আর বিশ্বজগত নিয়ে গবেষণা করা একই কথা। দুটি কাজ-ই আল্লাহর ইবাদাত।

৪) ইবনুল আরাবীর মতে জড় বস্তু বলে কিছু নেই, সুতরাং বস্তুবাদী বলেও কিছু নেই। যেহেতু প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি প্রাণী ও প্রতিটি বস্তু আল্লাহর একেকটি “কুন” শব্দ থেকে সৃষ্টি হয়েছে, সুতরাং সকল মানুষ, সকল প্রাণী ও সকল বস্তুর-ই একেকটি নির্দিষ্ট ভাষা রয়েছে। পৃথিবীর সকল কিছুই আল্লাহর ইবাদাত করতে পারে।

৫) ভাষা প্রকাশের মাধ্যম কেবল মুখ নয়, বরং ভাষা প্রকাশের আরো হাজারো মাধ্যম রয়েছে। পাখী, বা পাহাড় সবাই তাদের ভাব প্রকাশ করতে পারে, এবং মানুষ তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী তা বুঝতে পারে। নবী-রাসূল ও জ্ঞানী ব্যক্তিরা বিভিন্ন পশুপাখি ও বস্তুর ভাষা বুঝতেন, এটি অস্বাভাবিক কোনো কিছু নয়। একজন কবি বা সাহিত্যিক যেমন সাগর-নদী-পাহাড়-বনের ভাষা বুঝার চেষ্টা করেন, তেমনি আমরাও যোগ্যতা অর্জন করলে বিভিন্ন প্রাণী ও বস্তুর ভাষা বুঝতে পারবো। একজন চাইনিজ ব্যক্তি তার মুখের সাহায্যে নিজের ভাষা প্রকাশ করলেও যোগ্যতার অভাবে যেমন আমরা বুঝতে পারি না, তেমনি আমাদের যোগ্যতার অভাবেই আমরা পাখী, পিঁপড়া বা পাহাড়ের ভাষা বুঝতে পারি না।

26 August 2019 at 9:22 pm

আরো পোস্ট