সুবিধাভোগী হিন্দু-মুসলিমের চোখে নজরুল
“বাংলার মুসলমান সমাজ ধনে কাঙাল কিনা জানিনে, কিন্তু মনে যে কাঙাল এবং অতি মাত্রায় কাঙাল, তা আমি বেদনার সঙ্গে অনুভব করে আসছি বহুদিন হতে। আমায় মুসলমান সমাজ ‘কাফের’ খেতাবের যে শিরোপা দিয়েছে, তা আমি মাথা পেতে গ্রহণ করেছি। একে আমি অবিচার বলে কোনোদিন অভিযোগ করেছি বলে তো মনে পড়ে না। তবে আমার লজ্জা হয়েছে এই ভেবে, কাফের-আখ্যায় বিভূষিত হবার মতো বড় তো আমি হইনি। অথচ হাফেজ-খৈয়াম-মনসুর প্রভৃতি মহাপুরুষের সাথে কাফেরের পঙক্তিতে উঠে গেলাম। হিন্দু-লেখক জনসাধারণ মিলে যে স্নেহ–যে নিবিড় প্রীতি-ভালোবাসা দিয়ে আমায় এত বড় করে তুলেছেন, তাদের সে ঋণকে অস্বীকার যদি আজ করি, আমার শরীরে মানুষের রক্ত আছে বলে কেউ বিশ্বাস করবে না। অবশ্য কয়েকজন নোংরা হিন্দু ও ব্রাহ্ম লেখক ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে আমায় কিছুদিন হতে ইতর ভাষায় গালাগালি করেছেন এবং কয়েকজন গোঁড়া ‘হিন্দু সভাওয়ালা’ আমার নামে কুৎসা রটনাও করে বেড়াচ্ছেন, কিন্তু এঁদের আঙ্গুল দিয়ে গোনা যায়। এঁদের ক্রোশ সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িক বা ব্যক্তিগত। এঁদের অবিচারের জন্য সকল হিন্দুসমাজকে দোষ দিই নাই এবং দিব না। তাছাড়া আজকার সাম্প্রদায়িক মাতলামির দিনে আমি যে মুসলমান এইটেই হয়ে পড়েছে অনেক হিন্দুর কাছে অপরাধ–আমি যত বেশি অসাম্প্রদায়িক হই না কেন।প্রথম গালাগালির ঝড়টা আমার ঘরের দিক অর্থাৎ মুসলমানের দিক থেকেই এসেছিল–এটা অস্বীকার করিনে; কিন্তু তাই বলে মুসলমানরা যে আমায় কদর করেননি, এটাও ঠিক নয়। যারা দেশের সত্যিকার প্রাণ, সেই তরুণ মুসলিম বন্ধুরা আমায় যে ভালোবাসা, যে প্রীতি দিয়ে অভিনন্দিত করেছেন, তাতে নিন্দার কাঁটা বহু নিচে ঢাকা পড়ে গেছে। প্রবীণদের আশীর্বাদ–মাথার মণি হয়তো পাইনি, কিন্তু তরুণদের ভালোবাসা, বুকের মালা আমি পেয়েছি। আমার ক্ষতির ক্ষেতে ফুলের ফসল ফলেছে।”- কাজী নজরুল ইসলাম, নজরুলের পত্রাবলি, পৃ ৬০, ৬১