বাংলা নববর্ষ কি শুভ না অশুভ, বিজ্ঞানমনষ্ক না কুসংস্কারাচ্ছন্ন, সাম্প্রদায়িক না সার্বজনীন, উৎসব না শোষণ?

বাংলা নববর্ষ কি শুভ না অশুভ, বিজ্ঞানমনষ্ক না কুসংস্কারাচ্ছন্ন, সাম্প্রদায়িক না সার্বজনীন, উৎসব না শোষণ –এ সব নিয়ে সমাজে নানা লম্বা বিতর্ক রয়েছে। ভেবেছিলাম গ্রামের বাড়ি এসেছি; এ বিতর্ক গুলো থেকে দূরে থাকব। কিন্তু ফেইসবুকে লাবিব ভাইয়ের টাইমলাইনে একটা ছবি দেখে দু’এক লাইন লিখতে ইচ্ছা হল। ছবিটিতে দেখা যায়, মধ্যবিত্ত বাঙ্গালিরা আনন্দ উৎসবের বিলাসী প্রতিযোগিতা করছে, অথচ পাশেই দাঁড়িয়ে আছে একটি অনাথ মেয়ে। তাকে কেউ যত্ন বা সাহায্য করা তো দূরের কথা, সুন্দর একটা কথা বলারও কেউ নেই। এই ছবিটা থেকেই নববর্ষের আধুনিক চরিত্র বোঝা সম্ভব।সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেছিলেন হিজরি সনের উপর ভিত্তি করেই। কিন্তু তিনি এর ঐতিহাসিক, দার্শনিক ও মানবিক দিকটি মোটেও গুরুত্ব দেন নি। হিজরি সন নির্ধারণের পিছনে যে কারণটি ছিল, তিনি তার ঠিক বিপরীত কারণেই বাংলা সনের প্রবর্তন করলেন।হজরত ওমর (রা) আরবি সন নির্ধারণ করার জন্যে যখন পরামর্শে বসলেন; তখন সাহাবীদের কেউ কেউ বললেন, রাসূল (স)-এর জন্ম থেকে সন গণনা শুরু হোক; আবার কেউ বললেন, রাসূল (স)-এর মৃত্যু থেকে সন গণনা শুরু হোক। কিন্তু পরামর্শ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হল- যেহেতু হিজরতের মাধ্যমে রাসূল (স) তাঁর জীবনের সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছেন, সেহেতু হিজরতের বছর থেকেই সন গণনা শুরু হবে। আকবর সাহাবীদের ত্যাগের এই দর্শন গ্রহণ করলেন না; তিনি নিলেন ভোগের আনন্দ। গরিব কৃষকদের থেকে কড়া-গণ্ডায় খাজনা আদায় করার নিমিত্তে তিনি বাংলা সনের প্রবর্তন করলেন।আকবরের পূর্বে মোগল সম্রাটরা হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করতেন। হিজরি সন যেহেতু চাঁদের উপর নির্ভরশীল, তাই এ অঞ্চলের কৃষি ফলনের সাথে নববর্ষের মিল ছিল না। ফলে কৃষকরা যখন যা পারতেন, তাই খাজনা দিতেন; কোনো জবরদস্তী ছিল না। কিন্তু আকবর কৃষকদের সাথে সে মানবিকতা দেখাতে পারলেন না। তিনি হিজরি সনের পরিবর্তন করে ‘ফসলি সন’ প্রবর্তন করলেন; যার বর্তমান নাম ‘বাংলা সন’ । কারণ একটাই; যাতে কৃষদের ফসল তোলার দিনে খাজনা না দিতে পারলে তাদের ফসল কেড়ে নেয়া যায়।প্রশ্ন হল, আকবর-প্রবর্তিত আরও নানা কিছুই তো আছে, যেমন ‘দ্বীনে-এলাহি’ বা ‘এলাহি সন’। এগুলো মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা না পেয়ে কেবল ‘ফসলি সন’ বা বাংলা সন কেনও এখন পর্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে আছে? উত্তর খুব সোজা। এখানে বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থ আছে; তারা এটাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সব ধরনের অন্যায়-শক্তির প্রয়োগ করে এসেছে যুগে যুগে; যাতে উৎসবের নামে গরিব কৃষকদের ধোঁকা দিয়ে শোষণ করা যায়।আকবরের সময় পহেলা বৈশাখে যে অনুষ্ঠান হত; তা ছিল শোষণের হাতিয়ার ও অবিচ্ছেদ্য অংশ, সংস্কৃতির অংশ নয়। বিপুল সংখ্যক দরিদ্র কৃষক তাদের ফসলের শেষ পয়সা দিয়ে জমিদারের পাওনা টাকা বা মহাজনের উচ্চহারে সূদের টাকা শোধ করার নিমিত্তে এ অনুষ্ঠানে যোগ দান করতে হত। এটা জমিদার-মহাজনদের জন্যে ছিল উৎসবের দিন, মেলা ও নাচ-গান করার দিন; কিন্তু গরিব ও কৃষকদের জন্যে ছিল সবচেয়ে কষ্টের দিন।আকবর’রা মরে না; শোষণের সম্রাট হয়ে বারে বারে ফিরে আসে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে আকবরের প্রতিনিধিত্ব করছেন কিছু কট্টর পুঁজিবাদী গোষ্ঠী; যারা এখানে সেক্যুলার পোষাকে চলাফেরা করেন। মোটা দাগে বললে, যারা বাংলাদেশের মেহনতি মানুষের সাথে মুনাফেকি করে যাচ্ছেন নিয়মিত, তারাই এখানে আকবরের একনিষ্ঠ কর্মী। নিজেদের টাকা-পয়সার দরকার হলে ‘কৃষক-কৃষক’ বা ‘দুনিয়ার মজদুর’ বলে শ্লোগান তুলেন; আর ‘পহেলা বৈশাখ’, ‘ফাল্গুন’, ‘থার্টি ফাস্ট নাইট’ বা ‘ভালোবাসা দিবস’ আসলে পুঁজিবাদী হালখাতায় মহাজনের স্থানে নিজেদের নাম লেখান। এটাই বাংলাদেশের তথাকথিত ‘বামপন্থী’ রাজনীতি।


May 28, 2015 at 11:27 PM ·

আরো পোস্ট