বিয়ের আগে মেয়ের সাথে পরিচিত হতে হবে?
বিয়ে করতে গেলে তিনটি পর্ব বা তিনটি সময় অতিক্রম করতে হয়।
এক – খিতবাহ বা মেয়ের সাথে পরিচিতি পর্ব।
দুই – আকদ বা বিয়ের চুক্তি পর্ব।
তিন – নিকাহ বা দাম্পত্য জীবন পর্ব।
আমাদের দেশে বিয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বটি সম্পর্কে অনেকের স্বচ্ছ ধারণা থাকলেও প্রথম পর্বটি নিয়ে কেউ কেউ বেশ দ্বিধায় থাকেন। অর্থাৎ, খিতবাহ পর্ব বা মেয়ের সাথে পরিচয় পর্বটা আসলে কেমন হবে? –এটা অনেকের কাছে স্বচ্ছ নয়।
খিতবাহ হলো বিয়ের উদ্দেশ্যে ছেলে-মেয়ে পরস্পরকে দেখা ও জানা-বুঝার পর্ব। মেয়ে যদি বিধবা হয়, তাহলে মেয়ের পরিবারের অজ্ঞাতেই ছেলে মেয়েটিকে জানা-বুঝার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু, মেয়ে যদি কুমারী হয়, তাহলে মেয়ের পরিবারের সম্মতিতে মেয়েকে দেখা ও জানা-বুঝা চেষ্টা করাটাকে খিতবাহ পর্ব বলা হয়।
খিতবাহ পর্বটি ভালোভাবে না বুঝার কারণে সাধারণ দুটি ভুল হয়।
প্রথমত, অনেকে বলেন, বিয়ের আগে কিছুদিন প্রেম না করলে কিভাবে মেয়েটি সম্পর্কে জানব? এখানে ভুলটা হলো, কেউ যদি কোনো মেয়েকে দেখতে, জানতে বা বুঝতে চায়, তাহলে ঐ মেয়ের পরিবার থেকে আগে অনুমতি নিয়ে নিতে হবে। এরপর, দেখা, জানা ও বুঝাবুঝি শেষে, হয় মেয়েটিকে “না” করে দিতে হবে, অথবা, পরিবারের সাথে বিয়ের চুক্তি করে ফেলতে হবে।
দ্বিতীয়ত, অনেকে বলেন, পরিবারের সাথে বিয়ের চুক্তি করার আগে ছেলে-মেয়ে পরস্পরকে দেখাদেখি করা, কথাবার্তা বলা বা জানাশোনা চেষ্টা করা উচিত না। এখানে ভুলটা হলো, অনেকে ‘খিতবাহ’ ও ‘আকদ’কে একসাথে মিলিয়ে ফেলেন।
ধরুন, একটি মেয়ের স্বামী মারা গেলো। চার মাস দশদিন পর্যন্ত ঐ মেয়ের সাথে বিয়ের চুক্তি করা বা আকদ করা বৈধ নয়। কিন্তু, ঐ বিধবা মেয়েটিকে বিয়ে করা উদ্দেশে তাঁর সাথে স্বাভাবিক কথাবার্তা বলা বা ‘খিতবাহ’র সম্পর্ক করাতে কোনো গুনাহ নেই।
কোর’আনের এই আয়াতটি দেখুন –
وَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِيمَا عَرَّضْتُم بِهِ مِنْ خِطْبَةِ النِّسَاءِ أَوْ أَكْنَنتُمْ فِي أَنفُسِكُمْ ۚ عَلِمَ اللَّهُ أَنَّكُمْ سَتَذْكُرُونَهُنَّ وَلَٰكِن لَّا تُوَاعِدُوهُنَّ سِرًّا إِلَّا أَن تَقُولُوا قَوْلًا مَّعْرُوفًا ۚ وَلَا تَعْزِمُوا عُقْدَةَ النِّكَاحِ حَتَّىٰ يَبْلُغَ الْكِتَابُ أَجَلَهُ ۚ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا فِي أَنفُسِكُمْ فَاحْذَرُوهُ ۚ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ غَفُورٌ حَلِيمٌ
“নারীদেরকে যদি তোমরা বিয়ের প্রস্তাব (খিতবাহ) কর, অথবা, তোমাদের বিষয়টি অন্তরে গোপন রাখ, তাহলে তোমাদের কোনো পাপ নাই। আল্লাহ জানেন যে, তোমরা অবশ্যই সে নারীদেরকে স্মরণ করবে এবং তাদের সাথে ভালো কথাবার্তা বলবে, কিন্তু গোপনে তাদের সাথে কোনো অঙ্গীকার করো না, এবং বিয়ের চুক্তি (আকদ) করবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না তার নির্দিষ্ট পূর্ণ হয়। জেনে রেখো, তোমাদের মনে যে কথা রয়েছে, আল্লাহ তা জানেন। কাজেই তাঁকে ভয় কর। আরো জেনে রেখো, আল্লাহ ক্ষমাকারী ও ধৈর্যশীল।” [সূরা ২/বাকারা – ২৩৫]
এ আয়াতে স্পষ্ট যে, খিতবাহ ও আকদ এক নয়। বিধবা নারীর ইদ্দত শেষ হবার আগে বিয়ের উদ্দেশ্যে কেউ তাঁর সাথে কথাবার্তা বলা বা ‘খিতবাহ’ দোষের কিছু নয়, কিন্তু, সে সময়ে বিয়ের চুক্তি করা বা ‘আকদ’ জায়েজ নেই।
বিষয়টি আরো স্বচ্ছভাবে বুঝার জন্যে এই আয়াতের পরবর্তী আরো দুটি আয়াত আমরা দেখতে পারি। আল্লাহ তায়ালা বলছেন –
لَّا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ إِن طَلَّقْتُمُ النِّسَاءَ مَا لَمْ تَمَسُّوهُنَّ أَوْ تَفْرِضُوا لَهُنَّ فَرِيضَةً ۚ وَمَتِّعُوهُنَّ عَلَى الْمُوسِعِ قَدَرُهُ وَعَلَى الْمُقْتِرِ قَدَرُهُ مَتَاعًا بِالْمَعْرُوفِ ۖ حَقًّا عَلَى الْمُحْسِنِينَ —- وَإِن طَلَّقْتُمُوهُنَّ مِن قَبْلِ أَن تَمَسُّوهُنَّ وَقَدْ فَرَضْتُمْ لَهُنَّ فَرِيضَةً فَنِصْفُ مَا فَرَضْتُمْ إِلَّا أَن يَعْفُونَ أَوْ يَعْفُوَ الَّذِي بِيَدِهِ عُقْدَةُ النِّكَاحِ ۚ وَأَن تَعْفُوا أَقْرَبُ لِلتَّقْوَىٰ ۚ وَلَا تَنسَوُا الْفَضْلَ بَيْنَكُمْ ۚ إِنَّ اللَّهَ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ
(২৩৬) “যদি তোমরা স্ত্রীদেরকে স্পর্শ করার এবং কোন মাহর সাব্যস্ত করার পূর্বে তালাক দিয়ে দাও, তবে তাতেও তোমাদের কোন পাপ নেই। কিন্তু তাদেরকে কিছু খরচ দেবে, সামর্থ্যবানদের জন্য তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী এবং কম সামর্থ্যবানদের জন্য তাদের সাধ্য অনুযায়ী। যে খরচ প্রচলিত রয়েছে তা সৎকর্মশীলদের উপর দায়িত্ব।”
(২৩৭) “আর যদি মাহর সাব্যস্ত করার পর, কিন্তু স্পর্শ করার পূর্বে তালাক দিয়ে দাও, তাহলে মাহর হিসাবে যা সাব্যস্ত করা হয়েছে তার অর্ধেক দিতে হবে। অবশ্য যদি নারীরা মাফ করে দেয় কিংবা বিয়ের বন্ধন যার অধিকারে সে যদি মাফ করে দেয়, তবে তা স্বতন্ত্র কথা। আর তোমরা পুরুষরা যদি ক্ষমা কর, তবে তা হবে তাকওয়ার নিকটবর্তী। তোমরা পারস্পরিক সহানুভূতির কথা বিস্মৃত হয়ো না। নিশ্চয় তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ সেসবই অত্যন্ত ভাল করে দেখেন।” [সূরা বাকারা]
উপরোক্ত আয়াত দুটি থেকে স্পষ্ট যে, বিয়ের তিনটি পর্ব রয়েছে।
এক – মেয়ে ও মেয়ের পরিবারের সাথে পরিচিতি পর্ব, বা খিতবাহ পর্ব। এ পর্বে থাকাকালীন সময়ে যদি ছেলে-মেয়ে পরস্পরের মিল না হয়, এবং তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়, তাহলে তাতে কোনো পাপ নেই। তখন মেয়েকে কিছু উপহার দিয়ে দিলেই হবে।
দুই – বিয়ের চুক্তি ও মাহর নির্ধারণ করার পরের পর্ব, বা আকদ পর্ব। এ পর্বেও যদি কোনো কারণে ছেলে-মেয়ের মধ্যে সম্পর্ক বিচ্ছেদ ঘটে যায়, তাহলে ছেলেকে অর্ধেক মাহর দিতে হবে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে মেয়ে চাইলে ক্ষমাও করে দিতে পারে।
তিন – বিবাহ পর্ব, বা নিকাহ পর্ব। এ পর্বে এসে দাম্পত্য জীবন শুরু হয়। তখন যদি কেউ স্ত্রীকে তালাক দেয় বা বিবাহ বিচ্ছেদ করতে চায়, তাহলে সূরা বাকারার ২২৬ নং আয়াত থেকে ২৩৩ নং আয়াতের নিয়মানুযায়ী তালাক দিতে হবে। এ পর্বে এসে তালাক দিলে পূর্ণ মাহর প্রদান করতে হবে।
সুতরাং, খিতবাহ পর্বটি হচ্ছে এমন একটি পর্ব, যেখানে বিয়ের কোনো চুক্তি হয় না, কিন্তু মেয়ে ও মেয়ের পরিবারের সাথে ছেলের বোঝাপড়া চলতে থাকে। এ অবস্থায় যদি মেয়েকে বা মেয়ের পরিবারকে পছন্দ না হয়, তখন ঐ মেয়েকে ছেড়ে দেয়াটা অন্যায়ের কিছু না।
এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, কোনো ছেলের সাথে কোনো মেয়ের বা মেয়ে-পরিবারের পরিচয় পর্ব (খিতবাহ) চলাকালীন সময়ে অন্য কোনো ছেলের সাথে ঐ মেয়ের পরিবারের কথা বলা উচিত নয়। এ বিষয়ে রাসূল (স) বলছেন –
نَهَى النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ يَبِيعَ بَعْضُكُمْ عَلَى بَيْعِ بَعْضٍ، وَلاَ يَخْطُبَ الرَّجُلُ عَلَى خِطْبَةِ أَخِيهِ، حَتَّى يَتْرُكَ الخَاطِبُ قَبْلَهُ أَوْ يَأْذَنَ لَهُ الخَاطِبُ
“নবী (স) নিষেধ করেছেন যে, যখন কেউ কোনো কিছু ক্রয়ের জন্যে কথা বলে, তখন অন্য কেউ এসে তা ক্রয় করা উচিত না। যখন কোনো পুরুষ বিয়ের প্রস্তাব দেয়, তখন অন্য কেউ এসে প্রস্তাব দেয়া ঠিক না। যতক্ষণ না প্রথমজন ছেড়ে চলে যায়, অথবা, অন্যজনকে অনুমতি দেয়।” [সহীহ বুখারী, মাকতাবায়ে শামেলা – ৫১৪২]
এবার মূল প্রসঙ্গে আসি।
আমাদের দেশে বিয়ের ক্ষেত্রে ‘খিতবাহ’ পর্বটিকে সঠিকভাবে ব্যাবহার করা হয় না। অর্থাৎ, বিয়ে করতে গেলে মেয়েকে ভালোভাবে দেখা এবং মেয়েকে বোঝার চেষ্টা করাকে অনেকেই খারাপভাবে দেখেন। তাদের কথা হলো, বিয়ের আগে ছেলে-মেয়ের কথাবার্তা বলা ঠিক না। অথচ অসংখ্য হাদিসে মেয়েকে ভালোভাবে দেখে নিতে বলা হয়েছে।
যেমন, একটি হাদিস হলো –
أن المغيرة بن شعبة أراد أن يتزوج امرأة، فقال له النبي صلى الله عليه وسلم: «اذهب فانظر إليها، فإنه أحرى أن يؤدم بينكما» ، ففعل، فتزوجها، فذكر من موافقتها
“মুগিরা বিন শোয়াইব (রা) রাসূল (স)-কে বললেন – “আমি একটি মেয়েকে বিয়ে করতে চাই”। রাসূল (স) তাঁকে বললেন – “তুমি আগে মেয়েটিকে দেখ, যাতে তোমাদের উভয়ের ভুল বুঝাবুঝি না হয়।” অতঃপর মুগিরা (রা) তাই করলেন, এবং এরপর তাকে বিয়ে করলেন। ফলে, তাদের উভয়ের মধ্যে মেলবন্ধন হয়।” [সুনানে ইবনে মাজাহ, মাকতাবায়ে শামেলা, ১৮৬৫]
এ রকম অনেক হাদিস আছে। রাসূল (স) বিয়ের আগে মেয়েকে ভালোভাবে দেখে নিতে বলেছেন। এখানে দেখা মানে শুধু মুখ দেখা নয়। কেননা যে কোনো নারীর মুখ দেখা অনেক ইমামের মতেই জায়েজ। সুতরাং বিয়ের উদ্দেশ্যে কোনো নারীকে দেখা মানে ঐ নারীটিকে ভালোভাবে জেনে-বুঝে নেয়া। সূরা বাকারার ২৩৫ নং আয়াতে আমরা দেখেছি, খিতবাহ অবস্থায় নারীর সাথে ভালো কথাবার্তা বলাটা দোষের কিছু নয়। অথবা, বিভিন্ন হাদিসেও এ কারণে দেখাতে বলা হয়েছে, যাতে একে-অপরকে ভালোভাবে বুঝতে পারে।
আমাদের দেশে খিতবাহ পর্বটিকে গুরুত্বের সাথে দেখা হয় না। ফলে, কেউ পরিবারের অজ্ঞাতে প্রেম করে বেড়ায়, আবার কেউ বলেন, বিয়ে বা আকদের আগে মেয়েদের সাথে কথা বলা উচিত না।
কিন্তু, কোর’আন ও হাদিসে আমরা দেখি, বিয়ের দ্বিতীয় পর্ব আকদ বা বিয়ের চুক্তি হবার আগেই, মেয়ের পরিবারের অনুমতি নিয়ে মেয়েকে ভালোভাবে দেখে-জেনে-বুঝে নেয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।