|

ইসলামী রাজনীতি : ইবাদত, উপকরণ বনাম বিদ‘আত – ড খোন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর

ইসলামী রাজনীতি : ইবাদত, উপকরণ বনাম বিদ‘আত

  • ড খোন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর

সমাজের সকল পর্যায়ে ইসলামের পরিপূর্ণ প্রতিফলন বা ইসলাম প্রতিষ্ঠা সকল ইসলাম প্রেমিক মানুষের প্রচেষ্টা। এজন্য কেউ ইসলামী শিক্ষার সম্প্রসারণকেই উত্তম মাধ্যম মনে করছেন। কেউ ওয়াজ নসীহতকেই সর্বোত্তম মাধ্যম মনে করছেন। কেউ সার্বিক গণচেতনা জাগানোর জন্য বিভিন্ন সংগঠন ইত্যাদিকে মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করছেন। কেউ পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের অধীনে দলীয় রাজনীতিকে এই ইবাদত পালনের সর্বোত্তম উপকরণ বলে মনে করছেন। সকলেই একই ইবাদত পালনের জন্য বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করছেন। প্রত্যেকেই নিজ উপকরণ বেশি ফলদায়ক বলে মনে করছেন।
অন্যান্য উপকরণ ও পদ্ধতি যেহেতু ইসলামের প্রথম যুগ থেকে চলে আসছে এজন্য এসকল ক্ষেত্রে সাধারণত কোনো বিতর্ক হয় না। তবে রাজনীতির ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি আছে এবং উপকরণ ও ইবাদতের মধ্যে পার্থক্য না করাতে অনেকে বিদ‘আতের মধ্যে নিপতিত হন। এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করতে চাই। আল্লাহই একমাত্র তাওফীক দাতা, তাঁরই উপর নির্ভর করছি।
প্রথমত, ইসলামী সমাজে আধুনিক গণতান্ত্রিক ও দলীয় রাজনীতি।

(ক). রাসূলুলাহ (স) আল্লাহর দ্বীনের জন্য দাওয়াত দিয়েছেন। একপর্যায়ে যখন মদীনার অধিকাংশ মানুষ ইসলামের ছায়াতলে চলে আসেন তখন সেখানে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। আল্লাহর ওহীর নির্দেশনা মোতাবেক রাসূলুলাহ (স) ইসলামী শাসন ব্যবস্থা অনুযায়ী শাসন করেন এবং জিহাদের মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্রের ও মুসলমানদের সংরক্ষণ করেন।

(খ). খেলাফতে রাশেদার পরে সাহাবীগণ, তাবেয়ীগণ ও তাবে-তাবেয়ীগণ ইসলামী রাষ্ট্রের মধ্যে অনেক ধরনের ব্যতিক্রম, অন্যায় ও ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ড দেখতে পান। এ সকল ক্ষেত্রে তাঁদের পদ্ধতি ছিল কথাবার্তা, লিখনি ইত্যাদির মাধ্যমে শাসকগণকে পরিপূর্ণ ইসলামী পদ্ধতিতে শাসন করতে এবং জনগণকে পরিপূর্ণ ইসলামী জীবনব্যবস্থার মধ্যে চলতে আহ্বান করা।

(গ). তাঁদের সামগ্রিক কর্মের আলোকে আমরা বুঝতে পারি যে, যিনি শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন তাঁর জন্য পরিপূর্ণ ইসলাম অনুযায়ী দেশ পরিচালনা ফরয। আলেম, ফকীহ ও সমাজের দায়িত্ববানদের জন্য ফরয হলো শাসকের শাসন কাজে তাঁকে সহযোগিতা করা, তাঁর কোনো ভুল হলে তাঁকে সংশোধনের পথ দেখানো ও সঠিক পথে শাসন পরিচালনা করতে আহ্বান করা।

(ঘ). পূর্বের যুগগুলিতে যুদ্ধবিগ্রহ বা রক্তাক্ত বিপ্লব ছাড়া ‘সরকার পরিবর্তন’-এর কোন সুযোগ ছিল না। এজন্য সাহাবী, তাবেয়ীগণের যুগ থেকে পরবর্তী সকল যুগে আলেম, ফকীহ ও সমাজ সংস্কারকগণ সাধারণত ‘সরকার পরিবর্তন’ করার সকল প্রচেষ্টাকে নিরুৎসাহিত করেছেন। তাঁরা সর্বদা ‘সরকারকে সংশোধন’ করতে চেষ্টা করেছেন।

(ঙ). বর্তমান যুগে আমরা একটি বিশেষ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি, যা তাঁদের যুগে ছিল না। একদিকে আমরা অনেকে এমন সমাজ ও রাষ্ট্রে বাস করি যেখানে সামান্য কিছু ইসলামী ব্যবস্থার পাশাপাশি সর্বস্তরে অনৈসলামিক পরিবেশ ও ব্যবস্থা বিদ্যমান। এগুলির প্রতিবাদ করা ও পরিবর্তনের চেষ্টা করা আমাদের উপর ফরয। অপরদিকে ইউরোপীয় সমাজব্যবস্থার সংস্পর্শে এসে আমরা আধুনিক গণতান্ত্রিক রাজনীতি শিখতে পেরেছি, যা পূর্ব যুগের মুসলিমগণ কোনোদিন জানতেন না। আগের যুগে নির্বিঘ্ন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ ছিল না। বর্তমানে তা আছে। তার মাধ্যম হচ্ছে আধুনিক গণতান্ত্রিক দলীয় রাজনীতি।

(চ). রাজনীতি বলতে বুঝাচ্ছি — গণতান্ত্রিক পন্থায় দলীয় কার্যক্রমের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন করে পছন্দসই মানুষকে সরকারে প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া। রাজনীতি বলতে রাষ্ট্র পরিচালনা বুঝাচ্ছি না। যে মুসলমান রাষ্ট্রক্ষমতা বা বিচারক্ষমতা গ্রহণ করেছেন তাঁর জন্য সুন্নাতে মুহাম্মাদী অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনা করা ফরয। অন্যদের জন্য তাকে পরামর্শ প্রদান ও সহযোগিতা করা ফরয। এ বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই। বিতর্ক হচ্ছে নব উদ্ভাবিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতি নিয়ে। প্রশ্ন হলো : আমরা এখন কীভাবে কাজ করব? সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীগণের মতো শুধুমাত্র শাসক ও জনগণকে ইসলামের দিকে আহ্বান, আদেশ, নিষেধ ইত্যাদির মধ্যেই নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ রাখব? না-কি এই আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করব?
দ্বিতীয়ত, গণতান্ত্রিক ও দলীয় রাজনীতির সুন্নাত ও খেলাফে-সুন্নাত

(১). রাজনীতি না করা

বর্তমান মুসলিম বিশ্বে অনেক খ্যাতনামা আলেম, মুহাদ্দিস, ফকীহ, চিন্তাবিদ ও ধার্মিক মানুষ আধুনিক দলীয় ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক নন। কারণ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বা সমাজের ইসলাম বিরোধী কাজ রোধে, সৎকাজে আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করতে রাসূলুলাহ (স) , তাঁর সাহাবীগণ, তাবেয়ীগণ বা তাবে- তাবেয়ীগণ কখনো রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের জন্য দলগঠন, নির্বাচন ইত্যাদি করেননি। তাঁরা শাসক ও জনগণকে ইসলাম মতো চলতে আহ্বান করতেন, শাসকের ভুলগুলি তাকে বলে তাকে সংশোধিত হতে আহ্বান করতেন এবং ইসলামী শিক্ষা ও মূল্যবোধ প্রচারে সাধ্যমতো চেষ্টা করতেন। কাজেই, আমাদেরও সেভাবে চলা উচিত।

এখানে সমস্যা হলো ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত বর্জনের মধ্যে পার্থক্য না করা। প্রথম যুগের মুসলিমগণ দলীয় রাজনীতি করেননি বা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তন করে ভালো সরকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেননি, তার কারণ হলো এই ব্যবস্থা তাঁদের যুগে ছিল না। তাঁদের সমাজে রাষ্ট্রের শাসককে শান্তিপূর্ণভাবে পরিবর্তন করা যেত না। তাই তাঁরা সাধারণত শাসকের পরিবর্তনের চেষ্টা না করে তার সংশোধনের চেষ্টা করতেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে সে সুযোগ আছে। আমরা যদি তা ব্যবহার না করি তাহলে দুই দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হব :

প্রথমত, সৎকাজে আদেশ ও সমাজের ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ড পরিবর্তন করে পরিপূর্ণ ইসলাম প্রতিষ্ঠার একটি বড় মাধ্যম আমরা হারাব। যদিও আমাদের দায়িত্ব শুধু চেষ্টা করা। সালফে সালেহীনের পদ্ধতিতে কথা, লেখনী ইত্যাদির মাধ্যমে চেষ্টা করলেই আমাদের দায়িত্ব পালিত হবে, তবুও অধিক উপকারী মাধ্যম অকারণে পরিত্যাগ করা অনুচিত।
দ্বিতীয়ত, বর্তমানে সমাজে যারা ইসলামী মূল্যবোধের প্রসার ও প্রতিষ্ঠা চান না, তারা এই মাধ্যম ব্যবহার করে ইসলামী মূল্যবোধের বিকাশ রোধ করবেন। একারণে, ইসলামের বিরুদ্ধে সকল প্রচেষ্টার মুকাবিলা করাও আমাদের দায়িত্ব।
এজন্য রাজনীতিকে একটি নব উদ্ভাবিত উপকরণ হিসাবে বিবেচনা করতে হবে এবং প্রয়োজনে ইসলামী শরীয়তের শিক্ষার আলোকে শরীয়ত-সম্মতভাবে সৎকাজে আদেশ, অসৎকাজে নিষেধ ইত্যাদি ইসলামের সুনির্দিষ্ট ইবাদত পালনের মাধ্যম হিসাবে একে ব্যবহার করতে হবে।

আমরা ইতঃপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, আল্লাহ তা’আলা ইসলামকে সকল যুগের সকল জাতির সকল মানুষের পালন ও অনুসরণ যোগ্য করে প্রেরণ করেছেন। জাগতিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, জনকল্যাণমূলক ও প্রাকৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে ইসলামে খুবই প্রশস্ততা রাখা হয়েছে। যেন প্রত্যেক যুগে প্রত্যেক জাতির মানুষ তাদের সমাজের প্রচলিত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় রীতিনীতির মধ্যে থেকেই পরিপূর্ণ ইসলামে প্রবেশ করতে পারে। এরই একটি দিক হলো রাষ্ট্র পরিচালনার দিক।
মহিমাময় আল্লাহ ও তাঁর মহান রাসূল (স) রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে জনগণের পরামর্শ গ্রহণের এবং ন্যায়নীতি ও ইনসাফের সাথে শাসনের নির্দেশনা প্রদান করেছেন। কিন্তু পরামর্শ গ্রহণের পদ্ধতি নির্দিষ্ট করে দেননি। যেন সকল যুগের ও সকল দেশের মানুষ নিজ নিজ দেশের সামাজিক কাঠামোর মধ্যে থেকে ইসলামের অনুশাসনের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে জনগণের পরামর্শ ও মতামত গ্রহণের ব্যবস্থা করতে পারে। ফলে অতীত যুগের এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রচলিত গোত্রীয় বা রাজতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে থেকে ইসলামের এই নির্দেশ পালন সম্ভব ছিল। এজন্য কোনো সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্রয়োজন ছিল না। তেমনি বর্তমান গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে থেকেও একইভাবে আল্লাহর এই নির্দেশ পালন করা সম্ভব। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে জনগণের পরামর্শ গ্রহণের একটি নব উদ্ভাবিত উপকরণ ও পদ্ধতি হলো গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক রাজনীতি। যেখানে এই পদ্ধতি ব্যবহারের সুযোগ আছে সেখানে মুসলিমগণ শরীয়তের নির্দেশনার ভিতরে তা ব্যবহার করবেন।

(২). উপকরণকে ইবাদত মনে করা

অপরপক্ষে যারা প্রচলিত পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক রাজনীতির মাধ্যমে ইসলামের খেদমত ও ইসলামী মূল্যবোধের বিকাশের চেষ্টা করছেন তারাও এক্ষেত্রে বহুবিধ খেলাফে সুন্নাত বা বিদ‘আত কর্ম ও ধারণার মধ্যে নিপতিত হচ্ছেন।
প্রধান বিভ্রান্তি হচ্ছে, তাঁরা এই ‘উপকরণ’-কে ইবাদত মনে করছেন। লাফালাফি করে যিকিরকারী যেমন যিকিরের ফযীলতে বর্ণিত আয়াত ও হাদীসকে নিজের কাজের প্রমাণ হিসাবে পেশ করে তার ‘লাফালাফিকে’ ইবাদত হিসাবে প্রমাণ করছেন, চিল্লা ও নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে তাবলীগের ইবাদত আদায়কারী যেমন দাওয়াত, তাবলীগ ও জিহাদের আয়াত ও হাদীসকে নিজের বিশেষ পদ্ধতির সমর্থনে পেশ করছেন, তেমনিভাবে রাজনীতির মাধ্যমে ইসলামের দাওয়াত, সংস্কার, প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি ইবাদত পালনকারী সৎকর্মে আদেশ, অসৎকর্ম থেকে নিষেধ, জিহাদ, দাওয়াত ইত্যাদি বিভিন্ন ইবাদতের সাধারণ ফযীলতমূলক আয়াত ও হাদীসকে তার বিশেষ পদ্ধতির সপক্ষে পেশ করে তাঁর পদ্ধতিটাকেই ইবাদত বলছেন। রাসূলুলাহ (স) ও তাঁর সাহাবীগণ এ সকল ইবাদত করেছেন, তবে এই দলীয় রাজনীতির পদ্ধতিতে নয়। আমরা জানি যে, উপকরণ কখনো উপকরণ হিসাবে জরুরি হতে পারে, কিন্তু উপকরণকে ইবাদত, ইবাদতের অংশ বা সাওয়াবের কারণ মনে করলে তা বিদ‘আতে পরিণত হবে। এখানে আমরা কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করি :

(ক). রাজনৈতিক দল গঠন, সদস্য, সমর্থক ইত্যাদি ফরম পূরণ বা দলে নাম লিখানো, সদস্যসংগ্রহ, ভোট, প্রার্থী, প্রচার ইত্যাদি ইবাদত হতে পারে না, কারণ রাসূলুলাহ (স) এগুলি এভাবে করেননি। এগুলিকে ইবাদত বা ইবাদতের অংশ মনে করার অর্থ লাফালাফিকে যিকিরের অংশ মনে করা। উভয়ই একই প্রকার বিদ‘আত।

(খ). আমাদের দেখতে হবে এই কাজগুলির মাধ্যমে আমরা কোন্ ইবাদত করতে চাচ্ছি। অনেকে একে “ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব” বলে মনে করি। ইসলাম মানব জীবনের পরিপূর্ণ ব্যবস্থা। এখানে “রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা”, “ব্যক্তি প্রতিষ্ঠা” ইত্যাদি পৃথকভাবে বা বিচ্ছিন্নভাবে কোনো ইবাদতের নাম দেওয়া হয়নি। এখানে সার্বিকভাবে “দ্বীন প্রতিষ্ঠা”-র দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দ্বীন প্রতিষ্ঠার অর্থ ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বের সকল পর্যায়ে ইসলামের ঈমান, ইবাদাত, মুআমালাত বা ইসলামী বিশ্বাস, ইবাদত ও ইসলামী জাগতিক ব্যবস্থাদি প্রতিষ্ঠা করা। কাজেই যিনি এগুলির সব একত্রে বা এগুলির কোনো একটি প্রতিষ্ঠা করার কাজে রত রয়েছেন তিনিই “দ্বীন প্রতিষ্ঠা”-র কর্মে রত রয়েছেন। এখন পদ্ধতি ও উপকরণের কারণে যদি কেউ মনে করেন যে, আমার কর্ম “দ্বীন প্রতিষ্ঠার ইবাদত” বলে গণ্য ও আপনার কর্ম এই ইবাদত বলে গণ্য নয় তাহলে তা বিদ‘আত, বিচ্ছিন্নতা ও অকারণ বিবাদে পরিণত হবে।

(গ). দ্বীন প্রতিষ্ঠার এই দায়িত্ব কুরআন, হাদীস ও ইসলামী ফিকহের পরিভাষায় “হুসবা” বা “আমরু বিল মা’রুফ ওয়ান নাহউ আনিল মুনকার” অর্থাৎ সৎকাজে আদেশ দান ও অন্যায় থেকে নিষেধ করা, সমাজ সংস্কার ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে। বর্তমান যুগে কোনো কোনো ইসলামী চিন্তাবিদ কুরআন কারীমের ব্যবহারের আলোকে একে “ইকামতে দ্বীন” বা “দ্বীন প্রতিষ্ঠা” বলে অভিহিত করেছেন। দ্বীন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দুই পর্যায়ের : ফরয আঈন বা ব্যক্তিগত ফরয দায়িত্ব ও ফরয কিফায়াহ বা সামষ্টিক ফরয দায়িত্ব। মুসলিমের ব্যক্তি জীবনে ও নিজের অধীনস্থদের জীবনে দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করা তার জন্য ফরয আঈন দায়িত্ব। সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বের অন্যদের জীবনে তা প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করা সাধারণভাবে ফরয কিফায়া।

(ঘ). সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বে দ্বীন প্রতিষ্ঠার এই দায়িত্ব পালনের জন্য রাসূলুলাহ (স), সাহাবীগণ, তাবেয়ীগণসহ পূর্ববর্তী যুগের মুসলিম উম্মাহর উপকরণ ইতঃপূর্বে আলোচনা করেছি। এবং উপকরণের বিবর্তন ও নতুন উপকরণের প্রয়োজনীয়তাও দেখেছি।

(ঙ). এই অবস্থায় আমরা বলতে পারি, যে ব্যক্তি ইসলামী শিক্ষা বিস্তার, ওয়াজ, লিখনি, প্রচার, তাবলীগ ইত্যাদি উপকরণ ব্যবহার করে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বের বিভিন্ন পর্যায়ে ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ড দূর করে ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে, অথবা ইসলামী ব্যবস্থার কোনো দিক প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন তিনিও “দ্বীন প্রতিষ্ঠা”-র কর্মে নিয়োজিত। অপরদিকে যিনি রাজনৈতিক দল গঠন, ভোটের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি হিসাবে ইসলামী ব্যক্তিত্বকে নির্বাচন ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় এই দায়িত্ব পালন করছেন তিনিও “দ্বীন প্রতিষ্ঠা”-র কর্মে নিয়োজিত। কোন্ উপকরণ বেশি সুন্নাত-সম্মত, কোন্ উপকরণ বর্তমান সমাজের জন্য বেশি উপকারী বা উপযোগী ইত্যাদি বিষয়ে আমরা অনেক আলোচনা ও বিতর্ক করতে পারি। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই কোনো একটি নতুন ও খেলাফে-সুন্নাত উপকরণকে একমাত্র উপকরণ বা ইবাদতের অংশ মনে করতে পারি না।

(চ). উপকরণ বা রাজনীতিকে ইবাদত মনে করার ফলে অনেকে মূল ইবাদত পালনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তিনি মনে করছেন যে, প্রথম ব্যক্তির “দ্বীন প্রতিষ্ঠার” দায়িত্ব পালিত হচ্ছে না। অথবা এই কাজগুলি কোনোটিই দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজ নয়, শুধুমাত্র পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক রাজনীতিই দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজ। অথবা উপরের কাজগুলি সবই দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজ বলে গণ্য হবে, যখন ঐ ব্যক্তি আমরা দলের ব্যানারে বা অনুরূপ কোনো রাজনৈতিক দলের ব্যানারে তা করবে। এই চিন্তাগুলি সবই বিদ’আত ও উপকরণকে ইবাদত মনে করার ফল। অর্থাৎ, তিনি মনে করছেন যে, সদস্য ফরম পূরণ করা অথবা দলে নাম লিখানো “দ্বীন প্রতিষ্ঠা” নামাক ইবাদতের অংশ। এই অংশটুকু বাদে দ্বীন প্রতিষ্ঠার অন্য সকল কাজ অপূর্ণ রয়ে যায়।
এই ব্যক্তির উদাহরণ ঐ ব্যক্তিটির মতো যিনি বলেন যে, আপনি যতই তাকওয়া, ইবাদত, জিহাদ ও দ্বীন প্রতিষ্ঠা করুন, আমার পীরের মুরীদ না হলে আপনার কোনো কাজই ইবাদত বলে গণ্য হবে না, অথবা এগুলির পূর্ণ সাওয়াব পাবেন না। তিনিও উপকরণকে ইবাদতের অংশ মনে করছেন।

এই পর্যায়ের বিদ‘আতে ইসলামী রাজনৈতিক কর্মে লিপ্ত অনেক মানুষই নিপতিত হচ্ছেন। শুধুমাত্র নিজের দলে যোগ না দেওয়ার কারণে বা সক্রিয় গণতান্ত্রিক দলীয় রাজনীতি না করার জন্য অন্য পদ্ধতিতে বা সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীগণের পদ্ধতিতে “দ্বীন প্রতিষ্ঠা”-র কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তির কঠোর সমালোচনা করছেন। তাঁর দাবি ঐ ব্যক্তি এই ইবাদতটি করছেনই না। অর্থাৎ, তিনি রাজনীতিকেই একটি পৃথক ইবাদত মনে করছেন। তিনি এমন একটি উপকরণকে ইবাদত মনে করছেন যা রাসূলুলাহ (স) ও তাঁর সাহাবীগণ ব্যবহার করেননি। এই সমালোচনা পাল্টা সমালোচনার সৃষ্টি করে। এভাবে ইসলামী কর্মে নিয়োজিত মানুষেরা পরস্পরের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটিতে লিপ্ত হন।

(৩). ফরযে আইনকে ফরযে কেফায়া বা উপকরণের অধীন কল্পনা করা

অনেক আবেগী ইসলাম-প্রিয় মুসলিম রাজনীতিকে শুধু ইবাদতই নয়, আরকানে ইসলাম ও অন্যান্য ইবাদতের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। তাঁরা মনে করেন, রাজনীতির মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে তো ইসলাম ঠিকমতো পালন করা যাচ্ছে না। কাজেই, যে ব্যক্তি “দ্বীন প্রতিষ্ঠা”-র দায়িত্ব পালন করছেন না, অথবা “দ্বীন প্রতিষ্ঠা”-র জন্য জন্য অন্যান্য মাসনূন বা ‘গতানুগতিক’ পদ্ধতিতে চেষ্টা করছেন, কিন্তু রাজনীতি করছেন না তাঁর শুধু এই একটি ইবাদতই নষ্ট হচ্ছে না, বরং তাঁর অন্যান্য ইবাদতও হচ্ছে না; বা হলেও কম সাওয়াব হচ্ছে। এজন্য তিনি “রাজনীতি” না করে শুধু ঈমান বিশুদ্ধ করা, নামায আদায় করা, যিকির করা, যাকাত প্রদান করা, হজ্ব করা, রোযা রাখা, ইলম শিক্ষা, দাওয়াত প্রদান ইত্যাদি সকল ইবাদত পালনকে অর্থহীন বা অপূর্ণ বলে দাবি ও প্রচার করেন। এভাবে মুসলিম সমাজে জঘন্য হিংসা ও বিদ্বেষ ছড়ানো ছাড়াও তাঁরা কয়েকভাবে অনেকগুলো ভুল করছেন :

প্রথমত, রাজনীতি কোনো ইবাদত নয়। ‘দ্বীন প্রতিষ্ঠা’ নামাক ইবাদত পালনের অনেক উপকরণের মধ্যে একটি নতুন উপকরণ। কিন্তু আমরা উপকরণকেই ইবাদত ভাবছি।

দ্বিতীয়ত, কোনো একটি ইবাদত না করলে অন্য কোনো ইবাদত হবে না, — একথা বলতে হলে স্পষ্টভাবে কুরআন বা হাদীসের নির্দেশনা প্রয়োজন। শুধুমাত্র যুক্তিতর্ক দিয়ে একথা বললে আল্লাহর নামে বানোয়াট কথা বলা হবে। কেউ যদি সমাজের অন্যায় ও ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ড দেখে অসন্তুষ্ট হলেও এর প্রতিবাদ ও প্রতিকারের জন্য একেবারেই চেষ্টা না করেন তাহলে তিনি গোনাহগার হবেন। কিন্তু তাঁর অন্য কোনো ইবাদত কবুল হবে না বা সাওয়াব হবে না অথবা কম হবে — একথা স্পষ্টভাবে কোথাও বলা হয়নি। আর যদি তিনি নিজের সাধ্যমতো অন্যায়ের প্রতিবাদ ও পরিবর্তনের চেষ্টা করেন, তাহলে নির্দিষ্ট পদ্ধতি বা উপকরণ ব্যবহার না করার জন্য তাঁর কোনো গোনাহ হবে মনে করা খেলাফে-সুন্নাত।

তৃতীয়ত, ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, ব্যক্তি জীবনে “দ্বীন প্রতিষ্ঠা” ফরয আঈন। সমাজ ও রাষ্ট্রে তা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা “ফরয কিফায়া”। প্রথম প্রকারের ইবাদতের জন্য মুমিন ব্যক্তিগতভাবে দায়ী ও এর শাস্তি বা পুরস্কার পাবে। দ্বিতীয় প্রকারের ইবাদত সামাজিক দায়িত্ব। এক্ষেত্রে মু’মিনের দায়িত্ব হচ্ছে সমাজের অন্যান্য মানুষকে দাওয়াত দেওয়া, আহ্বান করা, নির্দেশ দেওয়া ও নিষেধ করা। সাধ্য ও ক্ষমতা অনুসারে তা পালন করতে হবে। দাওয়াত ও আহ্বানের দায়িত্ব পালনের পরে যদি কেউ না শোনেন, তাহলে মু’মিনের কোনো গোনাহ হবে না। সমাজ পরিবর্তন, অন্যায় রোধ বা ইসলাম প্রতিষ্ঠা এই পর্যায়ের ইবাদত। এজন্য মু’মিনের সাধ্যমতো আহ্বান, নির্দেশ ও নিষেধের পরেও সমাজের মানুষ ইসলাম বিরোধী কর্মে লিপ্ত থাকলে সে জন্য তাঁর কোনো অপরাধ হবে না। আর এই আহ্বান, নির্দেশ ও নিষেধের ইবাদত পালনে মু’মিন সুন্নাতের বাইরে কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম পালন করতে বাধ্য নয়। আমরা বিষয়টি উল্টে নিয়েছি এবং মনে করছি — সমাজের অন্য মানুষে গোনাহ করছে বলে আমার সাওয়াবের কাজ বোধহয় কবুল হচ্ছে না।

চতুর্থত, এই ধারণা ও কর্মের ফলে “দ্বীন প্রতিষ্ঠা”-র কর্ম ব্যাহত হচ্ছে। সমাজে অনেক ধার্মিক মানুষ রয়েছেন, যাঁরা পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক রাজনীতির সাথে সরাসরি বা সক্রিয়ভাবে সংযুক্ত থাকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন-না বা স্বীকার করেন-না। তবে তাঁরা ইসলামকে ভালবাসেন ও ধার্মিক মানুষদেরকে ভালবাসেন। সরাসরি রাজনীতিতে জড়িত না থাকলেও ভোটাভুটির সময় তাঁরা ইসলামপ্রিয় ধার্মিক মানুষকে ভোট দিতে আগ্রহী থাকেন। কিন্তু “ইসলাম প্রিয় ধার্মিক রাজনীতিবিদের” পক্ষ থেকে যখন এ সকল রাজনীতি বিমুখ ধার্মিক মানুষগুলিকে গালাগালি করা হয় এবং তাঁদের কোনো ইবাদতই হচ্ছে-না বলে বলা হয় তখন স্বভাবত মানবীয় দুর্বলতা ও জেদাজেদির ফলে তাঁরা উক্ত ইসলামী রাজনীতিতে লিপ্ত ব্যক্তির বিরোধিতা ও গালাগালিতে লিপ্ত হন।

অথচ, ইসলামী রাজনীতিতে লিপ্ত ব্যক্তি যদি এদের ধর্মপালনের প্রতি আন্তরিক ভালবাসা ও প্রকৃত ইসলামী ভাতৃত্ববোধসহ এদেরকে বুঝাতেন যে, আপনারা যে উদ্দেশ্যে নামায, যিকির, মাদ্রাসা, দাওয়াত ইত্যাদি ইবাদতে নিয়োজিত রয়েছেন সেই উদ্দেশ্যের পূর্ণতার জন্যই আমরা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছি। আপনারা ও আমরা সকলেই দ্বীন প্রতিষ্ঠার কর্মে নিয়োজিত। আপনারা আপনাদের প্রক্রিয়ায় কাজ করুন, আমাদের জন্য দোয়া করুন এবং অন্য সময় সক্রিয় না-হলেও ভোটের সময় সেই ব্যক্তিকে ভোট দিন যিনি আপনাদের এই কর্মগুলি করবেন ও করাবেন। প্রচলিত “রাজনৈতিক মুনাফেকী” নয়, প্রকৃত ইসলামী ভাতৃত্ববোধ ও শ্রদ্ধাবোধসহ এভাবে কাজ করলে “দ্বীন প্রতিষ্ঠা”-র কর্ম উত্তমরূপে পালিত হতো।

উপকরণকে ইবাদত মনে করার কারণেই আমরা চিন্তা করি যে, প্রত্যেক মুসলিমের জন্য দলে নাম লিখানো এবং দলের সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়া ফরয আঈন। কাজেই, দলে নাম না লিখিয়ে দ্বীন প্রতিষ্ঠার অন্যান্য কর্মে রত থেকে ভোটাধিকার প্রয়োগ করলে এতে “দ্বীন প্রতিষ্ঠার”-র দায়িত্ব পালিত হবে-না বা পূর্ণ হবে-না। এভাবে আমরা এমন একটি কর্মকে দ্বীনের অংশ মনে করছি যা কখনো রাসূলুলাহ (স) ও সাহাবীগণ দ্বীন হিসাবে পালন করেননি।

(৪). অন্য কিছু ইবাদতকে অবহেলা করা
ইতঃপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, আভিধানিক অর্থে নিজ জীবনে বা সমাজে ইসলাম প্রতিষ্ঠার সকল চেষ্টাই জিহাদ। তবে শরীয়তের পরিভাষায় জিহাদ একটি বিশেষ ইবাদত। ইসলামী রাষ্ট্রের হেফাজত, ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর সংরক্ষণের জন্য ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের নির্দেশে তাঁর নেতৃত্বে কাফির বা বিদ্রোহী শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধকে ফিকহের পরিভাষায় জিহাদ বলা হয়। হাদীসেও মূলত জিহাদ এই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কুরআন কারীমে এই অর্থে ও অন্যান্য বিভিন্ন প্রচেষ্টার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

“দ্বীন প্রতিষ্ঠার” ইবাদত বা “আমর বিল মা’রুফ ওয়ান নাহইউ আনিল মুনকার” নামক ইবাদতকে শাব্দিক অর্থে “জিহাদ” বলা চলে এবং এ বিষয়ে কিছু হাদীস রয়েছে। তবে ইসলামের পরিভাষাগত জিহাদ অন্য ইবাদত। রাজনীতিকে জিহাদ বলে জিহাদের সকল আয়াত ও হাদীস এক্ষেত্রে ব্যবহার করে আমরা অনেক সময় মনে করছি যে, আমরা বোধহয় মূল জিহাদের সাওয়াব পেয়ে যাচ্ছি। যেমন, কেউ মনে করছেন যে, আত্মশুদ্ধি করে বা নিয়মিত নামায আদায় করে বা দাওয়াতের কাজ করেই তিনি জিহাদের ইবাদত আদায় করছেন। এতে মূল জিহাদ নামক ইবাদতের প্রতি অবহেলা হচ্ছে।

(৫). ইসলামী পরিভাষার অপব্যবহার ও ভুল ধারণা

এছাড়া এভাবে ‘জিহাদ’ শব্দের অপব্যবহার হচ্ছে। ফিকহ শাস্ত্রে পারিভাষিক জিহাদের যে সকল বিধান আছে, দাওয়াত, আত্মশুদ্ধি, সমাজশুদ্ধি বা ইসলাম প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক উপকরণের ক্ষেত্রে সেসকল বিধান ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন, যুদ্ধের সময় রেশম পরিধান করার বা দাড়িতে খেযাব লাগানোর অনুমতি আছে। এখন কোনো আত্মশুদ্ধি, তাবলীগ বা রাজনীতির মাধ্যমে ‘জিহাদ’ পালনকারী নিজের জন্য এগুলি জায়েয করে নিচ্ছেন।

ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধানের নির্দেশে ও নেতৃত্বে জিহাদের ক্ষেত্রে শত্রু“পক্ষকে আঘাত করা, হত্যা করা ও যুদ্ধের অন্যান্য বিধান আছে। আমরা অনেক সময় দাওয়াত, দ্বীন প্রতিষ্ঠা ইত্যাদিকে পারিভাষিক ‘জিহাদ’ মনে করে সে ক্ষেত্রেও বিরোধী ব্যক্তিকে আঘাত করা জায়েয ভেবে স্পষ্ট হারামে নিপতিত হই। এ বিষয়ে রাসূলুলাহ (স) ও তাঁর সাহাবীগণের সুন্নাত না দেখে সাধারণ ফযীলতের আয়াত ও হাদীসের উপর আমল করতে যেয়ে আমরা পাপে নিপতিত হই।

তাঁদের সুন্নাতের আলোকে আমরা দেখতে পাই যে, ইসলাম প্রতিষ্ঠা, সমাজ সংস্কার, অন্যায় পরিবর্তন, জিহাদ ইত্যাদি ইবাদত পালনের দুটি পর্যায় রয়েছে : রাষ্ট্রীয় ও রাষ্ট্র বহির্ভূত বা ব্যক্তিগত ও দলগত। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রয়োজনে এগুলির ক্ষেত্রে ক্ষমতা ব্যবহার করা ফরয। আর রাষ্ট্র বহির্ভূত ব্যক্তিগত বা দলগত পর্যায়ে এগুলি পালনের ক্ষেত্রে ক্ষমতা প্রয়োগ নিষিদ্ধ।

আইনানুগ বিচারকের বিচার ও রাষ্ট্রপ্রধানের নির্দেশ ব্যতিরেকে কাউকে আঘাত করা, শাস্তি দেওয়া বা হত্যা করা ইসলামের দৃষ্টিতে জঘন্যতম কবীরা গোনাহগুলির অন্যতম। ইসলামী বিচার বা রাষ্ট্র না থাকলে বিভিন্ন সুন্নাত সম্মত “গতানুগতিক” বা প্রয়োজনীয় নতুন উপকরণের মাধ্যমে তা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু রাষ্ট্র ও বিচার ব্যবস্থার বাইরে আইন, বিচার বা শাস্তি প্রদান করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরে রাষ্ট্রপ্রধানের নির্দেশে ও নেতৃত্বেই শুধুমাত্র এই পর্যায়ের জিহাদ ও বিচার করা যায়।
ব্যক্তি বা দলপর্যায়ের দাওয়াত বা ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজকে যতই শাব্দিক অর্থে জিহাদ বলা হোক তা কখনোই ইসলামের পারিভাষিক জিহাদ নয়, বরং তা ‘সংস্কার’ ও ‘পরিবর্তন’ এবং শরীয়তের পরিভাষায় তা ‘দাওয়াত’ বা ‘আদেশ-নিষেধ’। এক্ষেত্রে দেশের প্রচলিত আইন ও শরীয়ত-সিদ্ধ উপকরণাদি ব্যবহার করতে হবে।

“খারিজী’ ও “বাতেনী শিয়া” সম্প্রদায় ছাড়া মুসলিম উম্মাহর আলেমগণ কখনোই দলকে “রাষ্ট্র” ভাবা, দলগত “সৎকাজে আদেশ, অন্যায় থেকে নিষেধ” বা “ইসলাম প্রতিষ্ঠার” কর্মকে জিহাদ মনে করা এবং দল বা দল প্রধানের নির্দেশে রাষ্ট্রের নাগরিককে হত্যা, অপহরণ, সম্পদ ধ্বংস ইত্যাদি কর্মের অনুমতি দেননি বা এ ধরনের কর্মে কেউ লিপ্ত হননি। তাঁরা সর্বদা সাহাবীগণের কর্মের আলোকে ব্যক্তি বা দলগত কর্ম ও রাষ্ট্রগত কর্মের মধ্যে পার্থক্য রক্ষা করেছেন।

(৬) উপকরণের অনৈসলামিক ব্যবহার

আধুনিক গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও রাজনীতির মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের পদ্ধতি উদ্ভাবিত, বিবর্তিত ও বিকশিত হয়েছে ইউরোপে। এর অনেক পদ্ধতি বা কর্মকাণ্ড রয়েছে যা ইসলামী শিক্ষা ও মূল্যবোধের বিরোধী। আমরা দেখেছি যে, নব-উদ্ভাবিত উপকরণকে ইসলামের শিক্ষার আলোকে ব্যবহার করতে হবে। এজন্য মুসলিম উম্মাহকে রাজনীতির উপকরণ ব্যবহারে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। প্রয়োজনে উলামাগণ পরামর্শের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন যে, নির্দিষ্ট পদ্ধতিটি ইসলামের আলোকে ব্যবহার করা যাবে কি- না।

যেমন, হরতাল, মিছিল, বিক্ষোভ, র‌্যালি, ভোট ও ভোটের প্রচারণা, বিভিন্ন দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা, একদল কর্তৃক অন্য দলের ভুল জনগণের সামনে তুলে ধরা ইত্যাদি বিষয় গণতান্ত্রিক রাজনীতির অংশ। এগুলির সাথে বিভিন্নভাবে ইসলামী মূল্যবোধ, দায়িত্ব ও অধিকারের চেতনা, ভ্রাতৃত্ববোধ ইত্যাদির সংঘর্ষ হতে পারে।

যেমন, হরতালের সময় কর্মচারী ও কর্মকর্তাগণ কাজ বন্ধ করে দেন। ইসলামের নির্দেশে কর্মচারী বা কর্মকর্তা কর্মদাতার সাথে চুক্তি মোতাবেক পরিপূর্ণ সময় কর্ম করতে বাধ্য। তিনি তাঁর চুক্তি বাতিল করতে পারেন, কিন্তু চুক্তিবদ্ধ থাকা অবস্থায় চুক্তি ভঙ্গ করতে পারেন না। তাহলে জুলুম ও মানুষের হক নষ্ট করার পাপে পতিত হবেন। তিনি তাঁর কর্মদাতার অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারেন। কিন্তু পাপের মাধ্যমে নয়। কর্মদাতার অন্যায়ের ক্ষেত্রেও তিনি কর্ম না করে টাকা নিতে পারেন না। আইনানুগ পদ্ধতিতে অন্যায়ের প্রতিবাদ ও প্রতিকার করতে পারেন।

তাহলে যেক্ষেত্রে কর্মদাতার কোনো অন্যায় নেই, রাষ্ট্রের বা অন্য কারে অন্যায়ের প্রতিবাদে তিনি চুক্তির খেলাফ করে কর্মবর্জনের পাপ করবেন কী-ভাবে! বিষয়টি খুবই সতর্কতার সাথে বিচার করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমাদের প্রতিটি কাজের জন্য একদিন আল্লাহর দরবারে চুলচেরা হিসাব দিতে হবে। এই দুনিয়ার সামাজিক জীবনে এ সকল হক নষ্ট করা হয়ত আমরা খুবই হালকাভাবে দেখি, কারণ, কোনো অন্যায় সর্বত্র ঘটতে দেখলে তা গা-সওয়া হয়ে যায়। কিন্তু আল্লাহর হিসাবে আমরা পার হতে পারব কি?
হরতাল, মিছিল, বিক্ষোভ ইত্যাদির ক্ষেত্রে কাউকে বলপূর্বক অংশগ্রহণ করানো একেবারেই না-জায়েয। কারো জান বা মালের ক্ষতি করা একেবারেই হারাম। বিভিন্ন দলীয় প্রচারণার ক্ষেত্রে খুবই নোংরাভাবে আমরা গীবতের আশ্রয় গ্রহণ করি। একদিকে যেমন রয়েছে নিজ দলের কথা জনগণের কাছে বলার প্রয়োজনীয়তা, অপরদিকে কারো সমালোচনার ক্ষেত্রে সংযমের জন্য ইসলামের নির্দেশ। এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয়ের ব্যবস্থা করবেন ইসলামী রাজনীতিতে জড়িত নেতৃবৃন্দ। ইসলামের দৃষ্টিতে উদ্দেশ্য যেমন শরীয়তসঙ্গত হতে হবে, উদ্দেশ্য অর্জনের পদ্ধতিও শরীয়তসঙ্গত হতে হবে। ওয়াজিব উদ্দেশ্য পালনের জন্য আমরা হারাম মাধ্যম ব্যবহার করতে পারি না। সর্বোপরি এখানে বান্দার হক জড়িত।

গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিভিন্ন দল থাকবেই। বিভিন্ন দল নিজ নিজ দলের উপযোগিতা ও অন্যান্য দলের দুর্বলতা বলবেন। কিন্তু এই পদ্ধতি অনেক সময় ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় আমরা রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা বা ‘ইসলামী দলের’ বিরোধিতাকে ‘ইসলাম বিরোধিতা’ বলে মনে করে রাজনৈতিক বিরোধীকে ‘ইসলামের শত্রু’ হিসাবে চিহ্নিত করি। অথবা আমরা গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতাকে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের মধ্যে ‘ভালো কাজের প্রতিযোগিতা’ ( فاستبقوا الخيرات ) হিসাবে গ্রহণ না করে ব্যক্তিগত শত্রুতার পর্যায়ে গ্রহণ করি। ফলে মুসলমানদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি, গীবত, মারামারি এমনকি খুনোখুনি পর্যন্ত হয়। কিভাবে এই ঘৃণিত হারাম থেকে সমাজের মুসলমানদের রক্ষা করা যাবে তা নিয়ে ভাববেন আমাদের প্রাজ্ঞ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ।

(৭) প্রশস্ততাকে সঙ্কীর্ণ করা

রাজনীতি যেহেতু একটি নতুন উপকরণ। এর ব্যবহার করতে হবে শরীয়তের শিক্ষার আলোকে ও শরীয়তের বিধিবিধানের মধ্যে থেকে। এর ব্যবহারের মধ্যে প্রশস্ততা রয়েছে। পৃথক দলগঠন করা, কোনো বৃহৎ দলকে সমর্থন করা, ক্ষমতার ‘লবি’ তৈরি করা, কোনো দলকে শর্তসাপেক্ষ সমর্থন দান করা, সক্রিয় অংশগ্রহণ, মৌন সমর্থন ও ভোট প্রদান ইত্যাদি বিভিন্নভাবে এর ব্যবহার করা যাবে। কিভাবে ব্যবহার করলে বা বর্জন করলে মুসলিম উম্মাহর বেশি উপকার হবে তা উলামায়ে কেরাম ইজতিহাদের মাধ্যমে নির্ধারণ করবেন। বিভিন্ন দেশ ও সমাজের পরিস্থিতির কারণে তা বিভিন্ন হবে। তেমনি একই দেশের আলেমগণের মধ্যে এ বিষয়ে মতবিরোধের সুযোগ রয়েছে। নিঃসন্দেহে এ সকল ক্ষেত্রে এজমা বা ঐকমত্যই সর্বোত্তম অবস্থা। তবে সাধারণত তা সম্ভব নয়। এজন্য এই নব উদ্ভাবিত উপকরণের ব্যবহারের ক্ষেত্রে মতবিরোধ হলে তাকে সহজভাবে গ্রহণ করে পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসার সাথে প্রত্যেকে নিজ পথে কর্ম করাই সুন্নাতের শিক্ষা। এক্ষেত্রে মতবিরোধকে পরস্পরের মধ্যে শত্রু“তা, ঝগড়াঝাঁটি ও কাদা ছোড়াছুড়ির মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করা নিঃসন্দেহে রাসূলুলাহ(স) -এর শিক্ষার বিপরীত।

বর্তমান যুগে ইসলামী কর্মে লিপ্ত মানুষদের মধ্যে যত কোন্দল, ভেদাভেদ ও কাদা ছোড়াছুড়ি তার একটি বড় কারণ হলো মূল ইবাদত ও উপকরণের মধ্যে পার্থক্য না বুঝে উপকরণকে ইবদাত মনে করা। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর সন্তুষ্টির পথে থাকার তৌফিক দান করুন।

সূত্র – আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর, এহইয়াউস সুনান।

আরো পোস্ট