মসজিদে কি নারী-পুরুষ পরস্পর কথা বলতে পারবে?
‘রিক্লেইমিং দ্যা মস্ক’ বইয়ের ধারাবাহিক অনুবাদ: পর্ব-১১
যেসব মসজিদে নারীদেরকে যেতে দেয়া হয়, সেখানেও মসজিদের ভেতর নারী-পুরুষের সাধারণ কথাবার্তাকে অত্যন্ত স্পর্শকাতর হিসেবে দেখা হয়। কখনো কখনো কথাবার্তা বলার উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এখনকার মসজিদগুলোর বিদ্যমান সমস্যাগুলোর মধ্যে এটিও অন্যতম। মজার ব্যাপার হলো, ঠিক এই নারী-পুরুষরাই তাদের সামাজিক ও পেশাগত জীবনের অন্যসব ক্ষেত্রে পরস্পরের মধ্যে এবং অন্যান্যদের সাথে স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা বলেন।
আমরা যদি আবারো সুন্নাহর দিকে ফিরে তাকাই, তাহলে দেখি যে রাসূলের (সা) যুগে মসজিদে নারী-পুরুষের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ ছিলো। বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয়ে তাঁদের মাঝে স্বাভাবিক কথাবার্তা হতো।
এটা সত্য যে সীমালঙ্ঘনের কিছু ঘটনা হাদীসে এসেছে। কিন্তু সেগুলোকে সংশ্লিষ্টদের ব্যক্তিগত সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এ ধরনের সীমালঙ্ঘনমূলক ঘটনার কারণে নারী-পুরুষের মধ্যে কথাবার্তা বলার যে প্রচলন ছিলো, তাতে কোনো পরিবর্তন যেমন আনা হয়নি; তেমনি মসজিদ-কাঠামোরও কোনো পরিবর্তন করা হয়নি।
নারী ও পুরুষ সাহাবীগণ কর্তৃক বর্ণিত কয়েকটি হাদীস নিচে তুলে ধরা হলো।
রাসূলের (সা) যুগে মসজিদে নারী-পুরষ কীভাবে পরস্পর কথাবার্তা বলতেন, সে-ব্যাপারে অল্প কয়েকটা উদাহরণ এসব হাদীস থেকে পাওয়া যাবে। এগুলো এতই সুস্পষ্ট যে বাড়তি কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়বে না।
ইতোপূর্বে আমরা একটা হাদীস উল্লেখ করেছিলাম যেখানে আসমা (রা) বর্ণনা করেছেন:
“… এরপর লোকেরা শান্ত হলে আমার সামনে বসা পুরুষটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন! রাসূল (সা) বক্তব্যের উপসংহারে কী বলেছিলেন?’ … ”[1]
ইবনে ওমর (রা) থেকে নাফি, নাফি থেকে মালিকের সূত্রে আবদুর রহমান বর্ণনা করেছেন:
“সাহাবীরা একসাথে ওজু করতেন। আবদুর রহমান বলেন, আমি মালিককে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কি নারী-পুরুষ উভয়কে বুঝাচ্ছেন?’ মালিক জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ।’ আমি আবারো জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটা কি রাসূলের (সা) জীবনকালের ঘটনা?’ তিনি নিশ্চিত করলেন, ‘হ্যাঁ’।[2]
নিচের ঘটনাটি জাবের (রা) বর্ণনা করেছেন:
“খুতবা দেয়ার সময় রাসূল (সা) সাধারণত একটা গাছের গুঁড়ির উপর দাঁড়াতেন। একদিন এক আনসার মহিলা রাসূলকে (সা) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার একজন দাস কাঠমিস্ত্রীর কাজ পারে। আমি কি তাকে দিয়ে আপনার জন্য একটি মিম্বর তৈরি করে দেবো?’ রাসূল (সা) বললেন, ‘হ্যাঁ’। মহিলা তাই করলেন। তারপর রাসূল (সা) সেটি ব্যবহার করতে শুরু করলেন। এক জুমাবারে রাসূল (সা) যখন নতুন বানানো মিম্বরের উপর দাঁড়িয়ে খুতবা দিচ্ছিলেন, তখন আমরা ওই গাছের গুঁড়ি থেকে কাতর আর্তনাদ শুনতে পেলাম। রাসূল (সা) বললেন, ‘গাছের গুঁড়িটি কাঁদছে। কারণ, আমি যে তার উপর দাঁড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসা করতাম, এটি তা মিস করছে।[3]
আয়েশা (রা) বর্ণনা করেছেন:
“আনসারী নারীগণ কতই না ভালো! (মসজিদের ভেতর) দ্বীনের ব্যাপারে যে কোনো ধরনের প্রশ্ন করা এবং দ্বীনকে ভালোভাবে বুঝার ক্ষেত্রে তাদের লজ্জাশীলতা তাদেরকে থামাতে পারেনি।”[4]
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বর্ণনা করেছেন:
“একবার রাসূল (সা) কয়েকজন আনসারী নারীকে সাথে নিয়ে মসজিদে প্রবেশ করলেন। তিনি তাদের সাথে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বললেন এবং শেষে বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা তিনজন সন্তানকে হারিয়েছো, তারা অবশ্যই ধৈর্যের পুরস্কার হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ তখন তাদের মধ্যকার সবচেয়ে সম্মানিত নারীদের একজন উঠে দাঁড়ালেন এবং জানতে চাইলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! যে নারী দুই সন্তান হারিয়েছে, তার কী হবে?’ রাসূল (সা) বলেলন, ‘দুই সন্তান হারানো নারীরও একই অবস্থা হবে।’[5]
আসমা বিনতে ইয়াজিদ (রা) বর্ণনা করেছেন:
“একদিন আল্লাহর রাসূল (সা) আমাদের সামনে দাজ্জাল সম্পর্কে কথা বললেন। তারপর একজন নারী বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, দাজ্জালের মোকাবেলায় আমরা কতই না দুর্বল হবো!’ রাসূল (সা) বললেন, ‘যদি আমি তোমাদের মাঝে থাকা অবস্থায় দাজ্জাল বের হয়, তাহলে আমিই তাকে মোকাবেলা করবো। আর যদি সে আমার পরে আসে, তাহলে আমার পক্ষ থেকে আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক মুসলিমকে রক্ষা করবেন।’”[6]
আবু হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত:
“আল্লাহর রাসূল (সা) বলেছেন, ‘একজন পুরুষ তার স্ত্রীর সাথে ব্যক্তিগতভাবে যা করে, পুরুষরা কি তা বলে বেড়াও? কিংবা, একজন নারীর সাথে তার স্বামী যা করে, নারীরা কি তা বলে বেড়াও?’ একজন কালো নারী উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘হ্যাঁ, আল্লাহর শপথ, ইয়া রাসূলুল্লাহ! নারীরাও এটা করে, পুরুষরাও এটা করে।’ রাসূল (সা) বললেন, ‘এমনটি করবে না। এমন করার মানে হলো, এক শয়তান পুরুষ এক শয়তান নারীর সাথে রাস্তায় শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করছে, আর সবাই তা দেখছে।’”[7]
আয়েশা (রা) বর্ণনা করেছেন:
“সাদ ইবনে মুয়াজ (রা) খন্দকের যুদ্ধে আহত হলেন। … তখন রাসূল (সা) সাদের (রা) জন্যে মসজিদের ভেতর একটি তাবু স্থাপন করলেন, যেন তাকে ঘন ঘন দেখতে যেতে পারেন।[8] এই বর্ণনাটির ব্যাখ্যায় ইবনে হাজার আসকালানী বলেন, রাসূল (সা) আসলে তাঁর মসজিদের পাশে স্থাপিত রুফাইদার (রা) তাবুতে সাদকে (রা) রাখতে বলেছিলেন। আহতদের চিকিৎসায় দক্ষতার কারণে রুফাইদা (রা) বেশ পরিচিত ছিলেন। রাসূল (সা) বলেছেন, ‘সাদকে রুফাইদার তাবুতে রাখো, যেন আমি কাছ থেকে তাকে দেখতে পারি।’”[9]
মসজিদে নারী-পুরুষের পারস্পরিক সাধারণ কথাবার্তার এই প্রচলন ইসলামের ইতিহাসের সোনালী যুগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো। নারীরা মসজিদে নির্দ্বিধায় নিজেদের মতামত প্রদান করতো। কখনো কখনো তারা ইমামের কোনো কথার সংশোধনীও দিতো।
নারীদের দেনমোহর সম্পর্কিত ওমরের (রা) ঘটনাটি এর একটি উদাহরণ। ওমর (রা) তখন খলিফা। একদিন তিনি রাসূলের (সা) মিম্বরে দাঁড়িয়ে জনগণের উদ্দেশ্যে বললেন, “তোমরা নারীদেরকে রাসূলের (সা) যুগের চেয়েও বেশি দেনমোহর কেন দাও? সাহাবীগণ তো চার’শ দিরহাম বা এরচেয়ে কম দেনমোহর দিতেন। দেনমোহর বাড়িয়ে দেয়া যদি আল্লাহর দৃষ্টিতে সম্মানের বিষয় হতো, তাহলে এ ব্যাপারে তোমরা সাহাবীগণকে ছাড়িয়ে যেতে পারতে না। তাই কোনো নারীকে চার’শ দিরহামের বেশি দেনমোহর দেয়ার ঘটনা যেন আমাকে শুনতে না হয়।”
এরপর ওমর (রা) যখন মিম্বর থেকে নামলেন, তখন কোরাইশ গোত্রের একজন নারী (অন্য বর্ণনায় তাকে চ্যাপ্টা নাক ও দীর্ঘকায় মহিলা হিসেবে বলা হয়েছে) ওমরকে (রা) থামিয়ে দিয়ে বললেন, “হে আমীরুল মুমিনীন, আপনি কি নারীদের দেনমোহর হিসেবে চার’শ দিরহামের বেশি দিতে জনগণকে নিষেধ করেছেন?”
ওমর (রা) উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ।”
জবাবে নারীটি বললেন, “দেনমোহর সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা কোরআনে কী বলেছেন, তা কি আপনি শুনেননি?”
ওমর (রা) অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কোন আয়াতের কথা বলছেন?”
নারীটি বললেন, “আপনি কি শুনেননি যে আল্লাহ বলেছেন, ‘যদি তোমরা এক স্ত্রীর স্থলে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করতে চাও এবং তাদের একজনকে প্রচুর অর্থ-সম্পদ দিয়েও থাকো, তবু তা থেকে কিছুই ফিরিয়ে নিও না। তোমরা কি (স্ত্রীর নামে) মিথ্যে দুর্নাম রটিয়ে সুস্পষ্ট গুনাহ করে তা ফেরত নেবে?’” (সূরা নিসা ৪:২০)
এরপর ওমর (রা) বললেন, “হে আল্লাহ, আমি তোমার নিকট ক্ষমা চাই! প্রত্যেকেই ওমরের চেয়ে বেশি জ্ঞানী… নারীটির বক্তব্যই সঠিক এবং পুরুষটির ধারণা ভুল।”[10]
(চলবে)
[মূল: জাসের আওদা, অনুবাদ: জোবায়ের আল মাহমুদ]
অন্যান্য পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রেফারেন্স:
[1] ‘হট্টগোল’ শব্দটি পর্যন্ত বর্ণিত হয়েছে সহীহ বুখারীর জানাজা অধ্যায়ে, ৪৭৯/৩, এবং বাকি অংশ বর্ণিত হয়েছে সুনানে নাসায়ীতে, ২০০/৭, নাসায়ীতেও বুখারীর সনদ অনুযায়ী বর্ণিত হয়েছে।
[2] দেখুন, আল-মুয়াত্তা ইমাম মালিক, ২৪/১; এবং “এবং তারা একসাথে অজু শুরু করতেন”– এই বর্ণনাটুকুসহ দেখুন মুসনাদে আহমদ, ১০৩/২। এছাড়া দেখুন সুনানে নাসায়ী, পবিত্রতা অধ্যায়, নারী-পুরুষের একত্রে অজু করা পরিচ্ছেদ, ৫৭/১; এবং সহীহ ইবনে খুজায়মাহ, ৬৩/১।
[3] মুসান্নাফ, আবু শায়বা, ৩১৯/৬
[4] জামে বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাদলিহী, ৩৭৫/১।
[5] মুজামুল আওসাত, ১৫৮/৬। এছাড়া এটি আনাস কর্তৃক সুনানে নাসায়ীতে বর্ণিত হয়েছে, ৪০০/২।
[6] মুজামুল কাবীর, ১৭৩/২৪।
[7] মুসান্নাফে ইবনে আবু শায়বা, ৩৯১/৪।
[8] সহীহ বুখারী, জিহাদ অধ্যায়, ৪১৬/৮; এবং সহীহ মুসলিম, জিহাদ অধ্যায়, ১৬০/৫।
[9] ফাতহুল বারী, ৪১৫/৮।
[10] ইবনে কাসীরের মুসনাদে ফারুক, ৫৭৩/২; এবং আবু ইয়ালা মাওসিলীর আয-জাওয়াইদ, ৩৩৫/২।