ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ কি একে অপরের বিপরীত?
একজন ভাইয়া ফেসবুকে লিখেছেন –
ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ কি একে অপরের বিপরীত?
একজন ভাইয়া ফেসবুকে লিখেছেন –
“ইসলাম তীব্রভাবে আসাবিয়াহ’র ধারণাকে নিন্দা করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস অনুযায়ী, “যে আসাবিয়াহ’র জন্য যুদ্ধ করে বা এর প্রতি মানুষকে উত্তেজিত করে সে আমার দলের অন্তর্ভুক্ত না” (মুসলিম, ইমারাহ ৫৭)। আসাবিয়াহ বর্তমানে জাতীয়তাবাদে রূপ নিয়েছে, এটা এমন একটি আদর্শ যা গোত্র, দল বা জাতির প্রতি “নিঃশর্ত ও বন্ধনহীন” আনুগত্য দাবী করে। এই চূড়ান্ত আনুগত্য ও নানা জাতিতে বিভেদ সৃষ্টি এই দুটি বিষয়ের কারণেই জাতীয়তাবাদ ইসলামের সাথে একটি সাংঘর্ষিক মতবাদ বলে প্রমাণিত হয়েছে।”
এ ভাইয়ার বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, তিনি মনে করেন, ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ একে অপরের বিপরীত।
জাতীয়তাবাদ ও আসাবিয়্যাহ শব্দটিকে এখানে একই অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। যদিও জাতীয়তাবাদ ও আসাবিয়্যাহ শব্দ দুটি সম্পূর্ণ এক নয়। আসাবিয়্যাহ শব্দটি ইবনে খালদুনের মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি পরিচিতি পায়। তিনি এ শব্দটিকে জাতীয়তাবাদ নয়, বরং “জাতীয় সংহতি” (National Solidarity) বা “জাতীয় ঐক্য” হিসাবে ব্যবহার করেছেন।
আসাবিয়্যাহ অনেক প্রকারের হতে পারে। যেমন,
১) ধর্মীয় আসাবিয়্যাহ বা ধর্মের ভিত্তিতে গঠিত ঐক্য।
২) ভৌগোলিক আসাবিয়্যাহ বা দেশের ভিত্তিতে গঠিত ঐক্য।
৩) ভাষাগত আসাবিয়্যাহ বা ভাষার ভিত্তিতে গঠিত ঐক্য।
ইত্যাদি।
যাই হোক, আলোচনার সুবিধার্থে আসাবিয়্যাহ শব্দের অন্য অর্থগুলো বাদ দিয়ে আমরা ধরে নিচ্ছি, আসাবিয়্যাহ অর্থ হলো জাতীয়তা।
যারা জাতীয়তা বা জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করেন, তারা তাদের কথার পক্ষে নিম্নোক্ত হাদিসটিও তুলে ধরেন –
রাসূল (সা) বলেছেন:
أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: لَيْسَ مِنَّا مَنْ دَعَا إِلَى عَصَبِيَّةٍ، وَلَيْسَ مِنَّا مَنْ قَاتَلَ عَلَى عَصَبِيَّةٍ، وَلَيْسَ مِنَّا مَنْ مَاتَ عَلَى عَصَبِيَّةٍ
“সে আমাদের দলভুক্ত নয়, যে আসাবিয়্যাহর দিকে ডাক দেয়, বা আসাবিয়্যাহর কারণে লড়াই করে কিংবা আসাবিয়্যাহর কারণে মৃত্যুবরণ করে।’ (আবু দাউদ : ৫১২১)
এ হাদিসে ইবন আদীর কামিল এর সনদ মুনকাতি। আব্দুল্লাহ বিন আবূ সালামাহ ও জুবায়র ইবনে মুত্বঈম এর মাঝে বর্ণনাকারী বাদ পড়েছে। তাই এ হাদিসটি সহীহ হাদীস নয়, বরং দুর্বল হাদীস। তবুও আলোচনার জন্যে আমরা হাদিসটিকে আমলে নিতে পারি।
এ রকম আরো দু একটা হাদীস দিয়ে অনেকে প্রমাণ করেন যে, ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ একে অপরের বিপরীত।
কিন্তু আসলেই কি তাই? আসাবিয়্যাহ-র বিরোধিতা করে রাসূল (স) কি পরিবারের প্রতি ভালোবাসাকে অস্বীকার করেছেন? রাসূল (স) নিজের গোত্রের প্রতি দায়িত্ব পালন করাকে হারাম বলেছেন? নিজের জাতীর উন্নয়নের জন্য চেষ্টা-সাধনা করাকে নিষেধ করেছেন?
অনেকে আসাবিয়্যাহ বা জাতীয়তার বিপক্ষে আয়াত-হাদিস উপস্থাপন করেন। কিন্তু আসাবিয়্যাহ-র পক্ষেও যে অনেক আয়াত-হাদিস রয়েছে, সেটা আমরা লক্ষ্য করি না।
যেমন, কোর’আনে বলা হয়েছে,
১) আত্মীয়-স্বজনের সাথে ভালো ব্যবহার করো। [২/বাকারা, আয়াত: ৮৩]
২) তোমরা আত্মীয়-স্বজনের হক আদায় করো। [১৭/বনী ইসরাইল, আয়াত:২৬]
৩) আত্মীয়-স্বজন-প্রতিবেশীদের জন্যে উত্তম বস্তু ব্যয় করো। [২/বাকারা, আয়াত: ২১৫]
৪) আল্লাহর কিতাব অনুসারে রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজন; তারা একে অপরের বন্ধু [৮/আনফাল, আয়াত: ৭৫]
৫) রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারে ভয় করো। [নিসা, আয়াত: ১]
কোরআনে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীদের জন্য ভয়াবহ পরিণাম উল্লেখ করা হয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে সম্ভবত তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। আর যারা এরূপ করবে তাদের ওপরই আল্লাহর অভিসম্পাত বর্ষিত হবে। আর এ ধরণের লোকদেরকেই বধির এবং অন্ধ করে দেওয়া হবে।’ [৪৭/মুহাম্মাদ, আয়াত: ২২-২৩]
উপরোক্ত আয়াতে আরহাম (ارحام) শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে; যার অর্থ হলো রক্তের সম্পর্ক। মানুষ ক্ষমতায় যায় রক্তের সম্পর্কের উপরে ভিত্তি করে। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে যারা রক্তের সম্পর্ক ছিন্ন করে তাদেরকে আল্লাহ অভিশাপ দিয়েছেন।
দেখুন, কোর’আনের অনেক আয়াতে মুসলিম বা দ্বীনী ভাইদের সাথে সম্পর্ক ভালো রাখার কথা বলা হলেও, উপরোক্ত আয়াতগুলোতে কিন্তু দ্বীনী ভাইদের কথা বলা হয়নি। উপরোক্ত আয়াতগুলোতে বলা হয়েছে রক্তের সম্পর্ক ছিন্ন না করার কথা; বলা হয়েছে আত্মীয়-স্বজনকে দান করার কথা, ভালোবাসার কথা।
কেবল কোর’আনে নয়, হাদিসেও রক্তের সম্পর্ক দৃঢ় করার বিষয়ে জোর দেয়া হয়েছে।
১) রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, সে যেন তার আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখে”। [বুখারি, ইফা, ৫৫৯৫]
২) আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: আল্লাহ তাআলা যখন মাখলুক সৃষ্টি করে তা সমাপ্ত করলেন, তখন “রেহম” (আত্মীয়তা ও রক্ত সম্বন্ধ) দাঁড়িয়ে বলল, এ হচ্ছে আত্মীয়তার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করা থেকে আশ্রয় প্রার্থনাকারীর স্থান। তিনি (আল্লাহর রাসুল) বললেন: হ্যাঁ। তুমি কি এতে তুষ্ট নও যে, যে তোমাকে সংযুক্ত রাখবে আমিও তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখব, আর যে তোমাকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে, আমিও তাকে আলাদা করে দেব? তখন সে বলল, হ্যাঁ। (মুসলিম, ইফা, ৬২৮৭)
৩) আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করিম (স)-কে বলতে শুনেছি যে, ‘যে লোক রিজিক প্রশস্ত ও আয়ু বৃদ্ধি করতে চায়, সে যেন তার আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে। [সহিহ বুখারী, ইফা, ৫৫৫৯]
এভাবে আরো অনেক আয়াত ও হাদিসে আমরা দেখবো যে, কোরআনে আত্মীয়তার সম্পর্ককে খুবই গুরুত্বের সাথে দেখেছে। তাহলে কেন রাসূল জাতীয়তাবাদ বা আসাবিয়্যাহ-র বিরোধিতা করেছেন?
আসলে রাসূল (স) জাতীয়তা বা আসাবিয়্যাহ-র বিরোধিতা করেননি, তিনি বিরোধিতা করেছেন অন্যায় স্বজনপ্রীতির। আমি আমার ভাইকে, আমার পরিবারকে বা আমার জাতীকে ভালোবাসতে পারি, তাতে কোনো সমস্যা নেই, বরং রাসূল নিজেই তার উৎসাহ দিয়েছেন। কিন্তু ভালোবাসার নামে নিজের ভাই বা জাতীকে অন্যায়ভাবে সমর্থন দিতে নিষেধ করেছেন। কেবল নিজের ভাই বা নিজের জাতী নয়, যে কাউকে অন্যায়ভাবে সমর্থন দেয়াকে রাসূল নিষেধ করেছেন।
নিজের জাতীকে ভালোবাসা আর অন্যায়ভাবে নিজের জাতীর পক্ষে দাঁড়ানো এক নয়। নিজের জাতীকে ভালোবাসার নাম জাতীয়তা বা আসাবিয়্যাহ, আর অন্যায়ভাবে নিজের জাতীকে সমর্থন করার নাম রেসিজম।
এ পার্থক্যটা আমরা আরো ভালোভাবে করতে পারবো রাসূলের অন্য একটা হাদীস থেকে।
রাসূল স বলেন –
عَنْ بِنْتِ وَاثِلَةَ بْنِ الْأَسْقَعِ، أَنَّهَا سَمِعَتْ أَبَاهَا، يَقُولُ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، مَا الْعَصَبِيَّةُ؟ قَالَ: أَنْ تُعِينَ قَوْمَكَ عَلَى الظُّلْمِ
“ওয়াসিলাহ ইবনুল আসকা’ (রা:)-এর কন্যা সূত্রে বর্ণিত। তিনি তার পিতাকে বলতে শুনেছেন. আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আসাবিয়্যাত (পক্ষপাতিত্ব) কি? তিনি বললেন: তুমি তোমার কওমকে অত্যাচার করার জন্য সহযোগিতা করলে।” (আবু দাউদ, তাহকীক্কৃত, ৫১১৯)
উপরের হাদিসটি থেকে স্পষ্ট যে, যে কোনো আসাবিয়্যাহ বা জাতীয়তা মাত্র-ই রাসূল (স) তার বিরোধিতা করেননি। রাসূল (স) কেবল সে ধরণের আসাবিয়্যাহ-র বিরোধিতা করেছেন, যা আসলে অন্যায়ভাবে নিজের জাতীর পক্ষে দাঁড়ায়। এটা সাধারণ অর্থে জাতীয়তাবাদ নয়, বরং রেসিজম।
সুতরাং, জাতীয়তাবাদ বা আসাবিয়্যাহ মাত্রই তা ইসলামের বিপরীত তা আমরা বলতে পারি না; বরং যে ধরণের জাতীয়তা বা গোত্রপ্রীতি মানুষকে অন্যায়ের দিকে ধাবিত করে, সে জাতীয়তাবাদই খারাপ।
ইবনে খালদুন তার মুকাদ্দিমা গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, আসাবিয়্যাহ বা জাতীয়তাবাদ ছাড়া কোনো রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব নয়, এমনকি ধর্ম প্রচারও সম্ভব নয়। রাসূল (স) যখন ধর্ম প্রচার শুরু করেন, তখন তিনি তার পরিবার ও গোত্র থেকেই সবচেয়ে বেশি সমর্থন পেয়েছিলেন।
রাসূল (স) জাতীয়তাবাদকে খুবই গুরুত্ব দিয়েছেন। সহিহ বুখারির হাদিসে এসেছে –
“মুহাম্মাদ ইবনে যুবায়র ইবনে মুতঈম (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বর্ণনা করেন যে, তারা কুরাইশের একটি প্রতিনিধি দলের সাথে মু‘আবিয়াহ (রা:)-এর নিকট ছিলেন। তখন মু‘আবিয়াহ (রা:)-এর নিকট সংবাদ পৌঁছল যে, ‘আবদুল্লাহ্ ইবনে ‘আমর (রা:) বর্ণনা করেন যে, অচিরেই কাহতান গোত্র থেকে একজন বাদশাহ্ হবেন। এ শুনে তিনি বাক্রুদ্ধ হলেন এবং দাঁড়ালেন। এরপর তিনি আল্লাহ্ তা‘আলার যথাযোগ্য প্রশংসা করলেন, তারপর তিনি বললেন, যা হোক! আমার নিকট এ মর্মে সংবাদ পৌঁছেছে যে, তোমাদের কিছু লোক এমন কথা বলে থাকে যা আল্লাহর কিতাবে নেই এবং যা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকেও বর্ণিত নেই। এরাই তোমাদের মাঝে সবচেয়ে জাহিল। সুতরাং তোমরা এ সকল মনগড়া কথা থেকে যা স্বয়ং বক্তাকেই পথভ্রষ্ট করে- সতর্ক থাক। আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি যে, (খিলাফতের) এ বিষয়টি কুরাইশদের মধ্যেই থাকবে, যদ্দিন তারা দ্বীনের উপর দৃঢ় থাকবে। যে কেউ তাদের বিরোধিতা করে তবে আল্লাহ্ তাকেই অধোমুখে নিপতিত করবেন।” (বুখারী, ইফা, ৬৬৫৪)
বুখারী ও মুসলিম উভয় সহীহ গ্রন্থে অন্য একটি হাদীস এসেছে, রাসূল (স) বলেন –
لاَ يَزَالُ الأَمْرُ فِي قُرَيْشٍ مَا بَقِيَ مِنْهُمُ اثْنَانِ
“(খিলাফতের) এই বিষয়টি সর্বদাই কুরাইশদের মধ্যেই থাকবে, যতদিন তাদের থেকে দু’জন লোকও অবশিষ্ট থাকবে।” (বুখারী, ইফা, ৬৬৫৫; মুসলিম, ইফা, ৪৫৫৩ )
সহীহ মুসলিমে আরেকটি হাদীস এসেছে –
“জাবির ইবনে সামুরা (রা:) থেকে বর্ণিত যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এ বিষয়টি (ইসলামী রাষ্ট্র) পরাক্রমশালী থাকবে বারোজন খলীফা পর্যন্ত। রাবী বলেন, তারপর তিনি কিছু বললেন, যা আমি বুঝতে পারিনি। তাই আমি আমার পিতাকে জিজ্ঞাসা করলাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি বললেন? তিনি বললেন, (বলেছেন:) তাঁদের সকলেই হবে কুরাইশ থেকে।” (মুসলিম, ইফা, ৪৫৫৮)
উপরোক্ত হাদিসগুলোকে অনেকেই অস্বীকার করেন। বিশেষত, যারা জাতীয়তাবাদকে ইসলামের বিপক্ষে দাঁড় করাতে চান, তারা উপরোক্ত হাদিসগুলোকে অস্বীকার করেন, বা নিজের মতো করে ব্যাখ্যা দাঁড় করান। অথচ উপরোক্ত হাদিসগুলো থেকে স্পষ্ট যে, রাসূল (স) কুরাইশ বংশ বা জাতীয়তার অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন। কারণ, জাতীয়তা ছাড়া মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা যায় না।
ইবনে খালদুন জাতীয়তাকে রাষ্ট্র গঠনের অন্যতম প্রধান উপাদান মনে করতেন। ইবনে খালদুন ‘মুকাদ্দিমা’ থেকে আমরা হুবহু কয়েকটি অনুচ্ছেদ তুলে দিচ্ছি।
খলিফা কোরায়েশ বংশের হতে হবে, এর ব্যাখ্যায় ইবনে খালদুন বলেন –
“কোরায়শ বংশীয় হওয়ার ব্যাপারটি সম্পর্কে বক্তব্য এ যে, সাফিকা দিবসে সাহাবীরা এ বিষয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। ঐদিন আনসারগণ সাদ ইবনে উবাদার প্রতি আনুগত্য স্বীকার করতে উদ্যোগী হয়ে বলেছিলেন “আমাদের মধ্য থেকে একজন সর্দার এবং তোমাদের মধ্য থেকে একজন সর্দার হবে।” কোরায়েশগণ তখন হজরত মুহম্মদ (স) এর এ বাণী – ‘ইমামগণ কোরায়েশদের মধ্য থেকে হবে’ – এর দ্বারা উপরোক্ত প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। তারা আরো বলেন, নবী (স) আমাদেরকে উপকারকারীদের উপকার করতে এবং তাদের প্রতি অসদাচরণ থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। যদি সর্দারি তোমাদের মধ্যেই থাকবে, তা হলে তিনি অন্তিম উপদেশে এ নির্দেশ দিতেন না। এভাবে তারা আনসারগণকে যুক্তি-প্রমাণে সম্মত করিয়ে তাদের সেই প্রস্তাব – ‘আমাদের মধ্যে একজন সর্দার ও তোমাদের মধ্যে একজন সর্দার’ – তা থেকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন, এবং তারাও এ উদ্দেশ্যে সাদের প্রতি আনুগত্য থেকে ফিরে এসেছিলেন। বিশুদ্ধ হাদীসে আরো প্রমাণ আছে যে, খেলাফতের বিষয়টি সর্বদাই কোরায়েশের কোনো গোত্রে অবস্থান করবে। এ প্রকার প্রমাণ অসংখ্য।
এ বিষয়টি বহু বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিকে সন্দেহে ফেলেছে এবং তারা কোরায়েশ বংশীয় হবার শর্তটিকে বাতিল করে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে তাঁরা হজরত মুহম্মদের (স) এর এ বাণীটি ব্যবহার করে প্রমাণ উপস্থিত করে। রাসূল (স) বলেছেন –
اسمعوا وأطيعوا وإن ولي عليكم عبد حبشي ذو زبيبة
“তোমরা শোন ও আনুগত্য প্রকাশ কর, যদিও তোমাদের উপর এমন কোন হাবশীকে আমীর নিযুক্ত করা হয় – যার মাথা কিসমিসের মতো। (বুখারী, ইফা, ৬৬০)
আসলে এ হাদীস দ্বারা এ বিষয়ে কোনো প্রমাণ উপস্থিত করা যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ এটা উদাহরণ থাকার উপর জোর দেয়া হয়েছে।
যেমন হজরত উমর (রা) বলেছেন, হুজায়ফার মুক্ত ক্রীতদাস সালেম যদি জীবিত থাকত, আমি তাঁকে শাসক নিযুক্ত করতাম। অথবা তার সম্পর্কে আমার কোনো আপত্তি থাকত না। এ উক্তি দ্বারাও প্রমাণ সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। কারণ এটা সকলের জানা যে, সাহাবীর মত ও পথ দ্বারা কোনোকিছু প্রমাণ করা যায় না। তদুপরি কোনো জাতীর মুক্ত ক্রীতদাস তাদেরই অন্তর্গত। এ দিক থেক কোরায়শের সাথে গোত্রপ্রীতিতে সালেমের সম্পর্ক বিদ্যমান। বংশ বিশেষের শর্ত আরোপ করা এটাই উপকারিতা এ কারণে হজরত উমর (রা) যখন খেলাফতের বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত হলেন এবং তাঁর ধারণা মত তাঁর শর্তাদি নিবিষ্ট হওয়ার পথ বলে মনে হল, তখন তিনি সালেমের উদাহরণ উপস্থিত করলেন। কারণ, তাঁর মতে সালেমের মধ্যে এ সকল শর্তের পূর্ণতা বিরাজমান ছিল। এমন কি এ প্রসঙ্গে তিনি বংশের কথাও উল্লেখ করলেন। কারণ গোত্রপ্রীতির ক্ষেত্রে এ বংশের প্রয়োজনীয়তা সর্বাধিক, যেমন আমরা পরে বর্ণনা করব। অবশ্য সালেমের ক্ষেত্রে প্রকাশ্য কোনো বংশমর্যাদা ছিলো না। কিন্তু হজরত উমর একে জরুরি মনে করেননি। কারণ বংশধারার তাৎপর্য তাঁর গোত্রপ্রীতির মধ্যে নিহিত। এবং তা এখানে আশ্রিত পোষ্য হওয়ার মধ্য দিয়ে পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং তাঁর উদাহরণ তুলে ধরে হজরত উমর (রা) মুসলমানদের এমন ব্যক্তি নিয়োগ ও তাঁর আনুগত্যের প্রতি উৎসাহী করেছেন, যার উপর কোনো দুর্নাম আরোপিত কিংবা যার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার অভিযোগ উত্থাপিত না হয়।
কোরায়েশ বংশীয় হবার শর্তটি অস্বীকারকারীদের মধ্যে কাজী আবূ বকর বাকেল্লানী অন্যতম। তিনি কোরায়েশদের গোত্রপ্রীতি বিনষ্ট ও বিক্ষিপ্ত হতে দেখে এবং তাদের উপর অনারব রাজন্যবর্গের ঘটনা লক্ষ করে কোরায়েশ বংশীয় হওয়ার শর্তটি বিলোপ করে দিয়েছেন। যদিও এটা বাহ্যত খারিজীদের মতের অনুরূপ, তথাপি তাঁর সমকালীন যুগে তাদের অবস্থা দেখে তিনি এরূপ উক্তি করতে বাধ্য হয়েছেন। তবে অধিকাংশ জ্ঞানী অবশ্য কোরায়েশদের শর্তের অনুকূলেই রয়ে গেছেন এবং কোরায়েশ বংশীয় হওয়ার মধ্যে কোনো অসুবিধা দেখেননি। এমন কি তাঁরা যদি মুসলমানের দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হন, তথাপি। … কারণ, আসাবিয়্যাহ নষ্ট হয়ে গেলে কার্য নির্বাহের ক্ষমতাও সেই সঙ্গে অন্তর্হিত হবে। এভাবে যোগ্যতার অভাব দেখা দিলে তা জ্ঞান ও ধর্মের ক্ষেত্রেও সংক্রমিত হবে। এভাবে একের পর এক শর্তগুলো লোপ পেতে থাকলে সমগ্র বিষয়টিই সর্বসম্মত মতের বিরোধী হয়ে উঠবে।
আমরা এখন বংশ মর্যাদাকে শর্ত হিসাবে গ্রহণ করা সম্পর্কে কথা বলব, যাতে উক্ত মতের মধ্যকার শুদ্ধ যুক্তির তাৎপর্য উদ্ঘাটিত হয়ে পড়ে। সুতরাং আমাদের বক্তব্য এ যে, ধর্মীয় বিধি-বিধানের প্রতিটির জন্যই সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য, সেই উদ্দেশ্য অনুযায়ী নির্দেশ এবং তার প্রবর্তনার বিষয়টি থাকতে হবে। আমরা যখন কোরায়েশ বংশীয় হওয়ার শর্ত আরোপ এবং এ সম্পর্কে ধর্মপ্রবর্তকের উদ্দেশ্য আলোচনা করতে বসি, তখন তাঁকে সুপরিচিত ধারণা অনুসারে শুধুমাত্র নবী বংশের মর্যাদার সাথে যুক্ত হওয়ার উপলক্ষ্য বলে ক্ষান্ত হতে পারি না। যদিও উক্ত কোরায়েশ বংশের সাথে সংযুক্ত হওয়ার মধ্যে পুণ্যলাভের ব্যাপার আছে, তথাপি পাঠক নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন যে, এটাই ধর্মীয় বিধানের উদ্দেশ্য হতে পারে না।
সুতরাং বংশমর্যাদার শর্তের জন্য অবশ্যই একটি উপযোগিতা বিদ্যমান, যাকে সম্মুখে রেখে এ বিধান দেয়া হয়েছে। আমরা যখন এ ব্যাপারে গভীরভাবে তলিয়ে দেখি, অনুসন্ধান করি; তখন এটাই দেখতে পাই যে, কোরায়েশ বংশীয় হবার শর্ত আরোপের একমাত্র উদ্দেশ্য হল আসাবিয়্যাহ বা জাতীয়তা, যা দিয়ে সহায়তা ও অধিকার আদায় সম্ভব হয়ে থাকে। এ শক্তি যার আছে তিনি স্বয়ং পদমর্যাদার অধিকারী হলে কোনো প্রকার মতভেদ ও দলাদলি থাকে না, জাতি ও বংশ তাঁর আশ্রয়ে নিরাপত্তা বোধ করে এবং সম্প্রীতির রজ্জু সকলকে একত্রে বেঁধে তুলতে পারে। …
যখন এটা স্থিরীকৃত হল যে, কোরায়েশ বংশের শর্ত আরোপ, তাদের গোত্রপ্রীতি ও প্রাধান্যের দ্বারা সর্ববিধ কলহ দূর করার জন্যই করা হয়েছিল, তখন তা থেকে আমরা এ কথাও জানতে পারলাম যে, রাসূলের এ নির্দেশাবলী বিশেষ কোনো গোত্র, কাল বা জাতীকে লক্ষ্য করে প্রদান করেননি। আর তা একান্তই যোগ্যতার ব্যাপার; সুতরাং (আসাবিয়্যাহকে) আমরা যোগ্যতা হিসাবেই গণ্য করব এবং তা থেকে সর্বজনীন কারণটি বের করে নেব। সুতরাং এ যোগ্যতার নাম আসাবিয়্যাহ বা জাতীয়তা ছাড়া আর কিছুই নয়। সুতরাং আমরা এ শর্ত আরোপ করবো যে, মুসলমানদের শাসনের দায়িত্ব তারাই গ্রহণ করবে, যারা নিজ কালে ও পরিবেশে সর্বাপেক্ষা অধিক শক্তিশালী আসাবিয়্যাহ বা গোত্রপ্রীতি শক্তির অধিকারী।”
(কোরায়শী, ১ম খণ্ড, ৩৫৭, ৩৫৮, ৩৬০)
ইবনে খালদুন আরো বলেন –
“আপনারা ধর্মীয় বিধি-নিষেধ প্রবর্তনের পক্ষপাতী এবং উক্ত ব্যাপারটি কিছুতেই আসাবিয়্যাহ ও জাতীয়তার প্রতাপ ছাড়া সম্ভব নয়। আর আসাবিয়্যাহ তার স্বাভাবিক পরিণতিতে রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়।”
(কোরায়শী, ১ম খণ্ড, ৩৫৫)
উপরোক্ত কোরআন, হাদীস ও ইবনে খালদুনের তত্ত্ব অনুসারে আমরা এটা সহজেই বলতে পারি যে, মানুষের আবেগ-ভালোবাসার যেমন ভালো ও খারাপ দুটি দিক আছে, তেমনি আসাবিয়া ও জাতীয়তাবাদের ভালো ও খারাপ দুটি দিক আছে। রাসূল স একদিকে ভালো জাতীয়তাবাদ বা আসাবিয়াকে রাষ্ট্রের নেতা হবার শর্ত হিসাবে দিয়েছেন, অন্যদিকে উগ্র জাতীয়তাবাদ বা রেসিজমের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। সুতরাং ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ একে অপরের বিপরীত নয়, বরং পরিপূরক।