বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ‘ জঙ্গিবাদ ‘
“কোনো মসজিদে কেউ জঙ্গিবাদকে সমর্থন করে বক্তব্য দিলে বা কৌশলে জঙ্গিবাদকে উসকিয়ে দিলে, তাদের চিহ্নিত করার নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক।” –প্রথম আলো; ০৬ ডিসেম্বর-১৫।
খবরটি ইতোমধ্যে সবাই জেনেছেন নিশ্চয়ই। এখন বুঝতে চেষ্টা করব – এ ঘোষণাটির মাধ্যমে সরকারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং সুদূরপ্রসারী চিন্তা-ভাবনাগুলো কি কি?
শহীদুল হক বলেছেন – কেউ কৌশলে জঙ্গিবাদকে সমর্থন করে বক্তব্য দিলে পুলিশ তাকে চিহ্নিত করবে। কিভাবে চিহ্নিত করবে তাও তিনি বলে দিয়েছেন। তিনটি উপায়ে তারা এ কাজটি করবে। এক. প্রত্যেক মসজিদে একজন করে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) সদস্য মোতায়েন করা হবে। দুই. মসজিদেরে ইমামদের বক্তব্য রেকর্ড করা হবে। তিন. প্রত্যেক মসজিদে সিসি ক্যামেরা বসানো হবে।
এখন আসুন, আইজিপি সাহেবের ঘোষণাটা একটু বিশ্লেষণ করা যাক। তাঁর ঘোষণাটির মধ্যে কয়েকটি শব্দ খুব লক্ষণীয়। মসজিদ, জঙ্গিবাদ, সমর্থন, বক্তব্য, কৌশল, উসকানি ও চিহ্নিত। এ শব্দগুলোর সরকারী-অর্থ বুঝতে পারলে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনেক স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।
প্রথমে দেখুন, জঙ্গিবাদ শব্দটি। বাংলাদেশে ‘জঙ্গিবাদ’ শব্দের আসল অর্থ কি?
পৃথিবীর নানা দেশে জঙ্গিবাদ শব্দটি নানা অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন, অ্যামেরিকা ইরানকে জঙ্গি-রাষ্ট্র বললেও রাশিয়া ইরানকে বন্ধু মনে করে। আবার রাশিয়া যাদেরকে জঙ্গি মনে করে অ্যামেরিকা তাদেরকে জঙ্গি মনে করে না। অ্যামেরিকা, ইউরোপ বা রাশিয়া কাকে কিভাবে জঙ্গি হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে, তাতে বাংলাদেশের কিছু যায় আসে না। বাংলাদেশ সরকার মনে করে – ‘যারা আওয়ামীলীগের সমালোচনা করে, বাক স্বাধীনতার কথা বলে কিংবা মৌলিক অধিকারের কথা বলে রাস্তায় নামতে চায়, তারাই এ দেশের জঙ্গি।’ ইউরোপ বা অ্যামেরিকা ইসলামকে দু’টি ভাগে বিভক্ত করে। মোডারেট ইসলাম ও ‘জঙ্গি’ ইসলাম। তারা মোডারেট ইসলামকে কিছুটা সমর্থন করলেও ‘জঙ্গি’ ইসলামকে মোটেও সহ্য করে না। ইউরোপ বা অ্যামেরিকা যেটাকে মোডারেট ইসলাম মনে করে, বাংলাদেশে সেটাকেও ‘জঙ্গি’ ইসলাম হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে।
একটি উদাহরণ দেখুন। পৃথিবীর কোথাও জাকির নায়েকের ‘পিস টিভি’কে জঙ্গিবাদের অজুহাতে বন্ধ করার দাবী তোলা হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশে পুলিশের আইজিপির নিকট কেউ কেউ এই দাবী তুলেছেন। কারা, কেনো এই দাবী তুলতে বাধ্য হয়েছেন, সে আলোচনায় পরে আসছি। তবে, একটি ব্যাপার নিশ্চিত – ‘পিস টিভি’ যা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে চালু হয়েছে, সে টিভি চ্যানেলকে যদি বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের অজুহাতে বন্ধ করে দেয়া হয়, তাহলে আপনি যত ‘শান্তি আর শান্তি’র কথাই বলুন না কেনো, সরকারের অপছন্দ হলে সেটাও ‘জঙ্গি’ শব্দ দ্বারা সংজ্ঞায়িত হয়ে যাবে।
আরেকটি উদাহরণ দিচ্ছি। বাংলাদেশ টেলিভিশনের পর্দায় বিভিন্ন সময় ‘জঙ্গি’ বই পুস্তক দেখেছেন নিশ্চয়। ইসলামী ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত আল কুর‘আনের অনুবাদকে বড় করে দেখানো হয় ‘জঙ্গি’ বই হিসাবে। বিভিন্ন হাদিসের বইকে বলা হয় হয় ‘জঙ্গি’ বই। একবার দেখলাম, ‘মরণের আগে ও পরে’ এই নিরীহ বইটাকেও দেখানো হচ্ছে জঙ্গি বই আকারে। এখন ধরুন, কোনো মসজিদের ইমাম কোর‘আন-হাদিস থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বললেন – ‘মৃত্যুর পর আল্লাহর শাস্তি থেকে কেউ আমাদের রক্ষা করতে পারবে না’। এ কথা বলার পর সরকারের পুলিশ যদি ভদ্র ঘরের সন্তান হয়, তাহলে বলবে – ‘ঈমান সাহেব এবার থামেন। মিম্বার থেকে নামেন। কৌশলে জঙ্গিবাদকে উসকিয়ে দিলেন। এবার হাজতে চলেন।’ আর পুলিশ যদি অভদ্র হয় তাহলে তো কথাই নেই। গলা ধাক্কা দিয়ে মসজিদের ইমামকে মিম্বার থেকে জেলে নিয়ে যাবে।
পুলিশের আইজিপি ‘কৌশল’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এবার আসুন, ‘কৌশল’ শব্দটির সরকারী-অর্থ কি, তা বুঝতে চেষ্টা করি। মসজিদের ইমাম সাহেব তাঁর বক্তব্যের মাঝে যতই ‘চেতনাময়’ শব্দের সংমিশ্রণ ঘটাক না কেনো, সরকারের যদি সন্দেহ হয়, সরকার বলবে – ‘হুজুর কৌশলে চেতনাময় শব্দগুলো ব্যবহার করলেও আসলে সে জঙ্গিবাদকে উসকিয়ে দিয়েছে।’ ধরুন, ঈমান সাহেব তাঁর বাংলা বক্তব্যে সারাক্ষণ দেশে, বঙ্গবন্ধু ও সরকারের প্রশংসা করে গেলেন। কিন্তু আরবিতে খুতবা দেয়ার সময় তিনি ভুল করে কোর‘আনের এমন একটি আয়াত পড়লেন, যেখানে জিহাদ শব্দটি এসে গেছে। তখন আমাদের মূর্খ সরকারের পুলিশ কি বলবে জানেন? বলবে – ‘ব্যটা, বাংলায় খুতবা দেয় সরকারকে খুশি করার জন্যে, আর কৌশলে আরবিতে খুতবা দেয় জঙ্গিবাদকে উসকে দেয়ার জন্যে। সুতরাং আজ থেকে আরবি খুতবা দেয়া বন্ধ।’
ঈমান সাহেব কোন কোন শব্দ বলতে পারবেন, আর কোন কোন শব্দ বলতে পারবেন না, তা পুলিশের আইজিপি বা সরকার স্পষ্ট করে দেয়নি। সুতরাং ইমাম সাহেব যাই বলুক না কেনো তাতে যদি সরকারের বিন্দু পরিমাণও সন্দেহ জাগে, সরকার বলবে, ‘ব্যাটা কৌশলে জঙ্গিবাদকে সমর্থন দিয়েছিস। চল জেল-হাজতে।’
এবার আসুন আরেকটি প্রসঙ্গে। সরকার এবার মসজিদে কেনো ‘জঙ্গি’ খুঁজতে আরম্ভ করল? কেনো এবার মসজিদকেই টার্গেট করতে হলো? উত্তর খুব সোজা। প্রথমত, সারা বাংলাদেশে এখন অঘোষিত কারফিউ চলছে। চার-পাঁচ জন মিলে কোথাও বসা যাচ্ছে না, এমনকি কথাও বলা যাচ্ছে না। পুলিশ সবাইকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ক’দিন আগে পত্রিকায় পড়লাম, বাবা তার দুই সন্তানের সাথে ঘরের ভিতর একটি সাংসারিক বৈঠকে বসেছেন। আর পুলিশ বাহাদুর এসে তাদেরকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। আমাদের অনেক বড় ভাই ও বন্ধুরা গোপনে বিয়ে-শাদী করছে। কারণ বিভিন্ন বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে পুলিশ গণহারে গ্রেফতার করে। অন্যদিকে ফেইসবুক থেকে শুরু করে বিভিন্ন সোশ্যাল মাধ্যমগুলোও বন্ধ করে রেখেছে সরকার। সুতরাং, এখন মসজিদ ছাড়া মানুষের একত্রিত হবার আর কোনো জায়গা নেই। সমাজের মানুষ একত্রিত হয়ে পারস্পরিক খবরাখবর নেয়ারও আর কোনো সুযোগ নেই। সরকার চায় না মসজিদের মাধ্যমে পারস্পরিক এই যোগাযোগ ও বন্ধনটা টিকে থাকুক। কারণ সামাজিক যে কোনো বন্ধন যালিম সরকারের জন্যে হুমকি স্বরূপ। তাই এবার সরকার ঘোষণা দিয়ে মসজিদে মসজিদে পুলিশের অভিযান শুরু করেছে।
সরকার মসজিদকে টার্গেট করার দ্বিতীয় কারণ হলো তারা সেক্যুলার। নিয়মিতভাবে ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ করাই তাদের স্বভাব। কিছুদিন আগেও সরকার বলতো – যারা ‘স্বাধীনতা বিরোধী’ আমরা কেবল তাদেরকেই শাস্তি দিচ্ছি এবং ফাঁসিতে ঝুলাচ্ছি। একথা বলে বলে দেশের অনেক আলেম-ওলামা ও ইসলামী স্কলারকে সরকার শাস্তি দিয়েছে এবং ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে। এবার সরকার তার পরবর্তী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে শুরু করেছে। ‘স্বাধীনতা বিরোধী’ বলে ইসলামের বড় একটি অংশকে জেলের ভিতর নিয়ে যাওয়া হলেও বাদ-বাকিরা তো রয়ে গেছে। তাদেরকেও অন্য আরেকটি অজুহাতে জেলে ঢুকাতে হবে এবং শাস্তি দিতে হবে। সুযোগ থাকলে ফাঁসিতেও ঝুলাতে হবে। আলেমদেরকে শাস্তি দেয়ার জন্যে এখন আর ‘স্বাধীনতা বিরোধী’ হওয়া লাগবে না। কেবল সরকারী চেতনার বিপরীতে সত্য কথা বললেই হবে। মসজিদের মিম্বার থেকে সোজা জেল-হাজতে পাঠিয়ে দেয়া হবে। এ লক্ষ্যেই এখন মসজিদে মসজিদে পুলিশের অভিযান শুরু হয়েছে।
মাঝখানে ফেলে আসা একটি বিষয়ে আবার ফিরে যাই। কেউ কেউ বলবেন – ‘অনেক আলেম তো এসব কাজে সরকারকে সমর্থন দিচ্ছেন। আপনি কেনো বিরোধিতা করছেন?’ বিশ্বাস করুন, এসব আলেমদের কিছুই করার নেই। তাঁদেরকে দোষ দিয়েও লাভ নেই। অনেকক্ষেত্রেই তাঁরা বাধ্য হয়ে এসব করছেন। আমার নিজের কথাই বলি। আমরা যখন টুপি-পাঞ্জাবি ও দাঁড়ি নিয়ে শাহবাগে শ্লোগান দিতাম, আশেপাশের হেঁটে চলা পথিকেরা বলাবলি করতো – ‘ঐ দেখ, নাস্তিক হুজুর।’ আল্লাহর কাছে সাহায্য ও ক্ষমা চাওয়া ব্যতীত আমাদের তখন আর করার কিছুই ছিল না। আমরা বাধ্য হয়েছিলাম শাহবাগে যেতে ও শ্লোগান দিতে। কেনো বাধ্য হয়েছিলাম, সে কথা আগের স্ট্যাটাসে বলেছি। সুতরাং, কিছু আলেম সরকারকে সমর্থন দিয়েছেন, -এ কথার অর্থ আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত বুঝব না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা আলেম-ওলামাদের সাথে কথা বলে তাঁদের দুঃখ-বেদনার কথাগুলো জানব।
দুঃখিত। স্ট্যাটাসটা অনেক বড় হয়ে গেলো, কিন্তু এখনো আসল কথায় প্রবেশ করতে পারলাম না। যে কথা বলার জন্যে লিখতে বসেছিলাম। সরকারের জন্যে আজ খুব দুঃখ হচ্ছে আমার। পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যায়, অত্যাচারী শাসকরা যখন তাদের অত্যাচারের শেষ সীমায় এসে পোঁছায় এবং ধ্বংসের নিকটবর্তী হয়ে যায়, তখন তারা একটি কাজ করে। আর তা হল – মসজিদে বাধা প্রদান করা। আল্লাহ তায়ালার ভাষায়, যে মসজিদে বাধা প্রদান করে, তার চেয়ে বড় অত্যাচারী আর কে?
তিনি বলেন-
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّن مَّنَعَ مَسَـٰجِدَ ٱللَّهِ أَن يُذْكَرَ فِيهَا ٱسْمُهُۥ وَسَعَىٰ فِى خَرَابِهَآ ۚ أُو۟لَـٰٓئِكَ مَا كَانَ لَهُمْ أَن يَدْخُلُوهَآ إِلَّا خَآئِفِينَ ۚ لَهُمْ فِى ٱلدُّنْيَا خِزْىٌۭ وَلَهُمْ فِى ٱلْءَاخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٌۭ
যে ব্যক্তি আল্লাহ্র মসজিদসমূহে তাঁর নাম উচ্চারণ করতে বাধা প্রদান করে এবং মসজিদগুলোকে উজাড় করে দিতে চেষ্টা করে, তার চেয়ে বড় অত্যাচারী আর কে হতে পারে? ভীত-সন্ত্রস্ত না হয়ে তাদের মসজিদে প্রবেশ করা উচিত হয়নি। পৃথিবীতে তাদের জন্যে রয়েছে লাঞ্ছনা, এবং পরকালে রয়েছে মহাশাস্তি। [ সূরা বাকারা, আয়াত – ১১৪]
কোর‘আনে এ রকম আরো বেশ কিছু আয়াত আছে। যেমন, সূরা জিন -১৮, সূরা বাকারা – ২১৭, সূরা মায়েদা – ২ এবং সূরা আনফাল – ৩৪।
আয়াতগুলো থেকে কয়েকটি বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। এক, সরকারের উচিত হয়নি মসজিদের ইমামদেরকে পুলিশি নজরদারির মধ্যে রাখা। এটা নিশ্চিত অনেক বড় একটি অত্যাচার। দুই, মুসল্লিরা গ্রেফতারের ভয়ে মসজিদে আসাতে চাইবে না। কিন্তু এভাবে মুসল্লিদের মসজিদে আসতে বাধা দেয়াকে আল্লাহ তায়ালা মোটেও সহ্য করেন না। তিন, পুলিশের উচিত ছিল নিজেরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে মসজিদে প্রবেশ করা। তা না করে, পুলিশেরা দাম্ভিকতার সাথে তথাকথিত ‘জঙ্গি’ খুঁজতে মসজিদে প্রবেশ করছে। পৃথিবীতে চরমভাবে লাঞ্ছিত হবার জন্যে সরকারের এ কাজটিই যথেষ্ট। মানুষ যেখানে আল্লাহকে খুঁজতে যায়, সরকার সেখানে ‘জঙ্গি’ খুঁজতে যায়।
হায়! আফসোস! এ সরকারের জন্যে!
December 6, 2015 at 7:33 PM