| |

মতপার্থক্য কেন স্বাভাবিক একটি বিষয়?

অনেকে আফসোস করে বলেন, মুসলিমদের মাঝে এত মতপার্থক্য কেন? আসলে মতপার্থক্য কখনোই খারাপ কিছু ছিলো না। রাসূলের যুগ থেকেই মতপার্থক্য ছিলো, এবং কেয়ামত পর্যন্ত মতপার্থক্য থাকবেই।

আল্লাহ তায়ালা নিজেই ঘোষণা করেছেন, তিনি প্রত্যেক মানুষকে আলাদা আলাদা চিন্তা দিয়ে তৈরি করেছেন, প্রত্যেক মানুষের জন্যে আলাদা শরিয়ত, আলাদা মানহাজ ও আলাদা পথ তৈরি করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ لَجَعَلَكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَلَٰكِن لِّيَبْلُوَكُمْ فِي مَا آتَاكُمْ فَاسْتَبِقُوا الْخَيْرَاتِ إِلَى اللَّهِ مَرْجِعُكُمْ جَمِيعًا فَيُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ

“আমি তোমাদের প্রত্যেককে এককটি শরিয়ত (আইন) ও একেকটি মানহাজ (পথ) দিয়েছি। যদি আল্লাহ চাইতেন, তবে তোমাদের সবাইকে এক উম্মত করে দিতেন, কিন্তু এরূপ করেননি-যাতে তোমাদেরকে যা দিয়েছেন, তাতে তোমাদের পরীক্ষা নেন। অতএব, দৌঁড়ে কল্যাণকর বিষয়াদি অর্জন কর। তোমাদের সবাইকে আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। অতঃপর তিনি অবহিত করবেন সে বিষয়, যাতে তোমরা মতবিরোধ করতে। ” (৫: ৪৮)

সব মানুষ আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবার আগে সবাই কখনো ঐক্যমত্যে পোঁছাবে না। এবং এটি আল্লাহ নিজেই চাননি যে, সব মানুষ একই পথে চলুক, বা একই মাজহাবের অনুসরণ করুক। একেক মানুষ একেক পথে চলবে, এটাই স্বাভাবিক। প্রত্যেক মানুষকে আল্লাহ আলাদা আলাদা যে পথ দিয়েছেন, সে পথের মাধ্যমে প্রত্যেকেই আল্লাহর পথে দৌঁড়াবে, এটাই হলো সবার কাজ।

কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হয় তখনি, যখন আমরা নিজেদের পথ ধরে আল্লাহর দিকে না দৌঁড়িয়ে অন্য মানুষের পথের দিকে তাকিয়ে সময় নষ্ট করি। অন্য মানুষ যে-পথ ধরে আল্লাহর দিকে দৌঁড়চ্ছেন, আমরা যখন সে-পথকে ভুল পথ হিসাবে চিহ্নিত করতে উঠেপড়ে লেগে যাই, তখনি সমস্যার সৃষ্টি হয়।

কেউ আমার পথে চলুক, বা অন্য পথে চলুক, সেটা সমস্যা না। আমাদের দেখতে হবে, যে-মানুষ যে-পথেই চলুক না কেন, সেটা আল্লাহর পথ কিনা। কেউ যদি নিজের পথকে আল্লাহর পথ বলে, তাহলে তার পথকে ভুল বলার অধিকার আমাদের নেই। আমরা সর্বোচ্চ এটা করতে পারি যে, আমাদের নিজেদের পথের কৈফিয়ত দিতে পারি। কিন্তু অন্যের পথকে ভ্রান্ত বলতে পারি না। আল্লাহ প্রত্যেক মানুষের জন্যে ভিন্ন ভিন্ন পথ তৈরি করেছেন।

এ বিষয়ে সাহাবীদের থেকে একটি উদাহরণ দিচ্ছি।

কিছু সাহাবী ছিলেন ঐতিহ্যপন্থী, এবং কিছু সাহাবী ছিলেন সংস্কারপন্থী। উসমান রা ছিলেন সংস্কারপন্থী সাহাবীদের অন্যতম।

রাসূল সা মসজিদে নববীর যে ডিজাইন করেছেন, সে ডিজাইনটা আবু বকর রা কোনো পরিবর্তন করেননি, অবশ্য পরিবর্তন করার তখন দরকারও ছিলো না। উমর রা এর যুগে মুসল্লি বেড়ে যাওয়ায় মসজিদের সাইজ তিনি কিছু বাড়িয়েছেন, কিন্তু রাসূলের তৈরি করা খুঁটিগুলো পরিবর্তন করেননি। কিন্তু উসমান রা এর সময়ে তিনি মসজিদে নববীর খুঁটি ও দেওয়াল সহ সবকিছুর একটি বিরাট সংস্কার করলেন। ।তিনি রাসূলের দেওয়া কাঁচা ইটের পরিবর্তে নকশি পাথর ও চুন-সুরকি দিয়ে মসজিদের দেওয়াল করেন। রাসূলের দেওয়া খেজুর গাছের খুঁটি পরিবর্তন করে সেখানে নকশা ওয়ালা পাথরের খুঁটি বসান। এবং রাসূলের দেওয়া খেজুরের ডালের পরিবর্তে সেগুনের কাঠ দিয়ে মসজিদের ছাদ করেন।।(বুখারী, ইফা, ৪৩৩)

উসামান রা-এর এসব সংস্কারপন্থী কাজকে পছন্দ করেননি কিছু সাহাবী। তারা উসমান রা এর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উপস্থাপন করেন। তখন উসমান রা বলেন, “তোমরা আমার উপর অনেক বাড়াবাড়ি করছো। অথচ আমি রাসূলুল্লাহ সা-কে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে মসজিদ নির্মাণ করে, আল্লাহ তার জন্যে জান্নাতে অনুরূপ ঘর তৈরি করেন।”(বুখারী, ইফা, ৪৩৭)

ঐতিহ্যপন্থী সাহাবীদের যুক্তি ছিলো, রাসূল সা যেভাবে মসজিদটি তৈরি করেছেন, ঠিক সেভাবেই থাকা উচিত। সংস্কারপন্থী সাহাবীদের যুক্তি ছিলো, মসজিদকে যারা সুন্দর করবে, তাদের জন্যে আল্লাহ জান্নাতে তেমন সুন্দর ঘর নির্মাণ করবেন। মসজিদ দেখতে খারাপ হলে জান্নাতের ঘরটিও খারাপ হবে।

এই যে ঐতিহ্যপন্থী এবং সংস্কারপন্থী সাহাবীদের মতপার্থক্য, এটা কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে। এসব মত পার্থক্য নিয়ে আফসোস করার কিছু নেই। এটাই আল্লাহর ইচ্ছে। আমাদের কাজ হলো অন্যের পিছনে লেগে না থেকে, সবাই নিজ নিজ পথে আল্লাহ দিকে দৌঁড়ানো।

আরো পোস্ট

একটি মন্তব্য লিখুন

আপনার ইমেইল অ্যাড্রেস প্রকাশ করা হবে না। তারকা (*) চিহ্নিত ঘরগুলো পূরণ করা আবশ্যক