আওয়ামী লীগ কি শেখ মুজিবকে মূল্যায়ন করছে?
শেখ মুজিবের ভারত বিরোধিতা
“১৯৬৫ সালে ভারতের সহিত যুদ্ধ চলিতে থাকার সময় যে সকল রাজনৈতিক নেতা ভারতীয় আক্রমণের নিন্দা করেন আমি তাহাদের অন্যতম এবং পাকিস্তান সরকারের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে পুরোপুরিভাবে সমর্থন করার জন্য আমি, আমার পার্টি ও জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাই। যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সম্ভাব্য সকল প্রকার সাহায্য করার জন্য আহ্বান জানাইয়া আমার প্রতিষ্ঠান পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও উহার সকল ইউনিটের নিকট সার্কুলার প্রেরণ করে।
উক্ত যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ভবনে যে সর্বদলীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় উহার পক্ষ হইতে আমি এই অংশের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের সহিত একটি যুক্ত বিবৃতি ইস্যু করি। উক্ত বিবৃতিতে ভারতীয় আক্রমণের নিন্দা করা হয় এবং ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করিয়া যাওয়ার জন্য এবং দেশের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সাহায্য করার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান হয়।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে আগমন করিলে আমন্ত্রিত হইয়া আমি স্বয়ং এবং অন্যান্য সকল রাজনৈতিক নেতা তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করি। উক্ত সাক্ষাৎকারের সময়ে আমি পূর্ব পাকিস্তানকে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দান এবং যুদ্ধের সময়ের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানকে প্রতিরক্ষার ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণ করিয়া তোলার জন্য প্রেসিডেন্টের নিকট আবেদন জানাই। কারণ যুদ্ধের সময়ে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান এবং বিশ্বের অবশিষ্ট অংশ হইতে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছিল।
আমি তাসখন্দ ঘোষণাকেও সমর্থন করিয়াছিলাম। কারণ আমার পার্টি ও আমি অগ্রগতির জন্য বিশ্বশান্তিতে বিশ্বাসী বিধায় শান্তিপূর্ণ উপায়ে যাবতীয় আন্তর্জাতিক বিরোধের মীমাংসা হওয়া উচিৎ বলিয়া মনে করি।”
সূত্র: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা : শেখ মুজিবের জবানবন্দী (দৈনিক আজাদ: ২৯ জানুয়ারি ১৯৬৯; পৃষ্ঠা -২)
June 4, 2015 at 11:14 PM ·
১
“ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন বাংলাদেশ দখল করে মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায়, তখন বাংলার এত সম্পদ ছিল যে, একজন মুর্শিদাবাদের ব্যবসায়ী গোটা বিলাত শহর কিনতে পারত। সেই বাংলাদেশের এই দুরবস্থা চোখে দেখেছি যে, মা মরে পড়ে আছে, ছোট বাচ্চা সেই মরা মার দুধ চাটছে। কুকুর ও মানুষ একসাথে ডাস্টবিন থেকে কিছু খাবার জন্য কাড়াকাড়ি করছে। ছেলেমেয়েদের রাস্তায় ফেলে দিয়ে মা কোথায় পালিয়ে গেছে। পেটের দায়ে নিজের ছেলেমেয়েকে বিক্রি করতে চেষ্টা করছে। কেউ কিনতেও রাজি হয় নাই। বাড়ির দুয়ারে এসে চিৎকার করছে, ‘মা বাঁচাও, কিছু খেতে দাও, মরে তো গেলাম, আর পারি না, একটু ফেন দাও।’ এই কথা বলতে বলতে ঐ বাড়ির দুয়ারের কাছেই পড়ে মরে গেছে। আমরা কি করবো? হোস্টেলে যা বাঁচে দুপুরে ও রাতে বুভুক্ষুদের বসিয়ে ভাগ করে দেই, কিন্তু কি হবে এতে?”
উপরের কথাগুলো শুনতে ইসলামপন্থীদের কথা মনে হলেও এটা লিখেছেন শেখ মুজিব। তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে। দেখুন পৃষ্ঠা ১৮।
শেখ মুজিবকে পূর্ণভাবে ধারণ করতে পারে না বর্তমানের আওয়ামীলীগ। শেখ মুজিব পাকিস্তান স্বাধীন করার জন্যে লড়েছেন যে একটা লম্বা সময়, সে সময়টাকে কোনোভাবেই মূল্যায়ন করে না আওয়ামীলীগ। আজ ১৪ আগস্ট, বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতা দিবস। এই দিনের জন্যে কত ত্যাগ স্বীকার করেছেন শেষ মুজিব, অথচ কোনো আওয়ামীলীগকে দেখিনি শেষ মুজিবের এসব ত্যাগ নিয়ে কোনো কথা বলতে।
২
“পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে গোপালগঞ্জ শহর মুখরিত হয়ে উঠলো।”
- শেখ মুজিব, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ ২১
৩
শেখ মুজিবকে মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলো একটা জায়গায় এসে এক হয়ে যায়। সেটা হলো, সবগুলো বড় রাজনৈতিক দল শেখ মুজিবের জীবনের শেষ পাঁচ বছর দিয়ে শেখ মুজিবকে মূল্যায়ন করেন। অথচ শেখ মুজিবের জন্ম তো ১৯৭১ সালে নয়, তাঁর জন্ম ১৯২০ সালে। ১৯৭১ এর আগেও ৫০ বছর পৃথিবীর বুকে হেঁটে ছিলেন শেখ মুজিব। সে ৫০ বছরে শেখ মুজিবের অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগ রয়েছে মুসলিমদের অধিকার আদায়ের জন্যে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, শেখ মুজিবের ৫০ বছরকে বাদ দিয়ে কেবল শেষ পাঁচ বছর নিয়ে পড়ে থাকে মুজিব-প্রিয় এবং মুজিব-বিরোধী দলগুলো। অর্থাৎ, শেখ মুজিবের ৫০ বছরের বেড়ে উঠা এবং তাঁর সংগ্রাম ও ত্যাগকে অস্বীকার করার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী সবাই এক।
কেউ যদি সত্যিকার অর্থে শেখ মুজিবকে মূল্যায়ন করতে চায়, তাহলে তাকে শেখ মুজিবের শেষ পাঁচ বছর নিয়ে অতিরিক্ত ভক্তি বা অতিরিক্ত ঘৃণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। শেখ মুজিবের সারাজীবন নিয়ে যদি কেউ বিশ্লেষণ করেন, তখন শেখ মুজিব নিয়ে অতিরিক্ত ভক্তি ও অতিরিক্ত ঘৃণা দুটোই কমে যাবে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনে যেমন শেখ মুজিবের অবদান আছে, তেমনি পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন করার ক্ষেত্রেও শেখ মুজিবের অবদান রয়েছে। শেখ মুজিব কখনোই চাননি ভারতের সাথে মিশে থাকতে বা মিশে যেতে। এ জন্যে ১৯৭১ সালে সবাই যখন পালিয়ে ভারত গিয়েছেন, শেখ মুজিব তখন ভারতে না গিয়ে পাকিস্তানের কারাগারে যেতেই বেশি পছন্দ করেছেন। যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশে ফিরে আসার সময়েও শেখ মুজিব ভারতের বিমানে না এসে ব্রিটিশ রয়াল এয়ারফোর্সের প্লেনে এসেছেন।
শেখ মুজিবের জীবনের বড় অংশ কেটেছে তাঁর মুসলিম পরিচয়কে প্রতিষ্ঠিত করতে, এবং শেষ জীবনটা কেটেছে বাঙালি পরিচয়কে প্রতিষ্ঠিত করতে। কিন্তু তিনি কখনো মুসলিম পরিচয়কে বাঙালি পরিচয়ের সাথে দ্বন্দ্ব হিসাবে দেখতেন না। তিনি নিজেকে একই সাথে মুসলিম ও বাঙালি পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন। অথচ, বর্তমান আওয়ামী লীগের অধীনে থাকা সেকুলারগণ মুসলিম পরিচয়ের সাথে বাঙালি পরিচয়ের দ্বন্দ্ব লাগিয়ে দেন।
শেখ মুজিব যে চেতনা নিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন, সে চেতনার সাথে বর্তমান ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র কোনো মিল নেই। শেখ মুজিবের জীবনের শেষ পাঁচ বছরের সাথে তাঁর জীবনের আরো যে ৫০ বছর আছে, সে ৫০ বছর সহ শেখ মুজিবকে মূল্যায়ন না করলে বাংলাদেশে শেখ মুজিব ঐক্যের প্রতীক না হয়ে বিচ্ছেদের মন্ত্র হিসাবে দেখা দিবে।