অধ্যাপক গোলাম আজমের মতে ‘ইকামাতে দ্বীন’ কী?
অধ্যাপক গোলাম আযমের ‘ইকামাতে দ্বীন’ বইয়ে তিনি দ্বীনের কাজকে দুইভাগে ভাগ করেন।
১) ইকামাতে দ্বীন
২) খেদমতে দ্বীন
মরহুম গোলাম আযমের মতে, যারা ইসলামি রাজনীতি করেন, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেন, তারা ইকামাতে দ্বীনের কাজ করেন। আর যারা মাদ্রাসায় পড়ান, মসজিদে খুতবা দেন, মাহফিল করেন, মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দেন তারা খেদমতে ইসলামের কাজ করেন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জামায়াতে ইসলামি এবং অন্য আরো ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলো ইকামাতে দ্বীনের কাজ করেন। অন্যদিকে কওমি ও আলিয়া মাদ্রাসা, সালাফিরা, সূফীরা, মসজিদের ইমাম, লেখক ও মাহফিলের বক্তারা খেদমতে দ্বীনের কাজ করেন।
কারা ইকামাতে দ্বীনের কাজ করেন এবং কারা খেদমতে দ্বীনের কাজ করেন, তা নির্ণয় করার একটি মানদণ্ড দিয়েছেন প্রফেসর গোলাম আজম। তিনি বলেন, “ইসলামী জামায়াত হওয়া সত্ত্বেও যদি কায়েমী স্বার্থ কোন সংগঠকে সহ্য করে এবং তাদের বিরুদ্ধে কিছু না করে তাহলে ধরে নিতে হবে যে,এ জামায়াত ইসলামের বড় কোন খেদমত করলেও ইকামাতে দ্বীনের কোন কর্মসূচী নিয়ে কাজ করছে না। কায়েমী স্বার্থ বা প্রচলিত সরকার যদি কোন জামায়াতকে তাদের দুশমন মনে না করে তাহলে বুঝতে হবে যে,দ্বীনে হককে কায়েম করার কোন কর্মসূচি সে জামায়াতের নেই। ” (ইকামাতে দ্বীন, পৃ: ৭০)
অর্থাৎ, যদি সরকার কোনো সংগঠনের উপর জুলুম করে, তাহলে সেটি ইকামাতে দ্বীনের সংগঠন। আর যদি সরকার কোনো সংগঠনকে ইসলামের কাজ করতে দেয়, তাহলে তারা ইকামাতে দ্বীনের কাজ করে না বুঝতে হবে, বরং তারা খিদমাতে দ্বীনের কাজ করে।
ইকামাতে দ্বীন ও খেদমতে দ্বীনের এ ভাগ করাটা কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা হলো, যখন খিদমতে দ্বীনের লোকদের কাজকে ছোট করা হয়, এবং মনে করা হয় যে, সব ফরজের বড় ফরজ হলো ইকামাতে দ্বীনের কাজ করা। যদি খেদমতে দ্বীন ও ইকামাতে দ্বীনের মর্যাদা একই দেয়া হতো, তাহলে কোনো সমস্যাই ছিলো না। কিন্তু যখন মনে করা হয়, খেদমতে দ্বীনের কাজ করাই যথেষ্ট না, একজন ব্যক্তিকে খেদমতে দ্বীনের পাশাপাশি ইকামাতে দ্বীনের কাজ করাও ফরজ, তখনি সমস্যা শুরু হয়।
আমরা জানি, একই লোক একই সাথে ডাক্তারি ও ইঞ্জিনিয়ারিং উভয় কাজে দক্ষ হতে পারে না। তদ্রূপ, একই ব্যক্তি একইসাথে খেদমতে দ্বীন ও ইকামাতে দ্বীন একই সাথে করা সম্ভব না। কেউ যখন ইকামাতে দ্বীনের কাজ করতে যায়, তখন তার দ্বারা ভালোভাবে খেদমতে দ্বীনের কাজ করা সম্ভব হয় না। একইভাবে কেউ যদি খেদমতে দ্বীনের কাজ করতে যায়, তাহলে তার দ্বারা ইকামাতে দ্বীনের কাজ করা ভালোভাবে সম্ভব হয় না। আমরা মানুষ, সুপারম্যান নই। ফলে একই ব্যক্তি একই সাথে ভালো ডাক্তার ও ভালো ইঞ্জিনিয়ার হওয়া যেমন সম্ভব নয়, তেমনি ইকামাতে দ্বীন ও খেদমতে দ্বীনের কাজও একসাথে করা সম্ভব নয়। কেউ যদি দুটি কাজ একই সাথে করেন, তাহলে কোনো কাজই ভালোভাবে হয় না, এবং নানা ধরণের জটিলতা সৃষ্টি হয়।
মাওলানা মওদূদীর কথা থেকেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৯৪১ সালে যখন তিনি জামায়াতের আমীর নির্বাচিত হন তখনি তিনি নিন্মরূপ ঘোষণা দেন:
“পরিশেষে একটি কথা পরিষ্কার করে দিতে চাই। ‘ফিকাহ’ ও ইলমে কালামের বিষয়ে আমার নিজস্ব একটি তরীকা আছে। আমার ব্যক্তিগত অনুসন্ধান গবেষণার ভিত্তিতে আমি এটি নির্ণয় করেছি। গত আট বছর যারা ‘তারজুমানুল কুরআন’ পাঠ করেছেন তারা এ কথা ভালভাবেই জানেন। বর্তমানে এ জামায়াতের আমীর পদে আমাকে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। কাজেই এ কথা আমাকে পরিষ্কারভাবে বলে দিতে হচ্ছে যে,ফিকাহ ও কালামের বিষয়ে ইতিপূর্বে আমি যা কিছু লিখেছি এবং ভবিষ্যতে যা কিছু লিখব অথবা বলবো তা জামায়াতে ইসলামীর আমীরের ফয়সালা হিসেবে গণ্য হবে না বরং হবে আমার ব্যক্তিগত মত। এসব বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত রায়কে জামায়াতের অন্যান্য আলেম ও গবেষকদের উপর চাপিয়ে দিতে আমি চাই না এবং আমি এও চাইনা যে,জামায়াতের পক্ষ থেকে আমার উপর এমন সব বিধি-নিষেধ আরোপ করা হবে যার ফলে ইলমের ক্ষেত্রে,আমার গবেষণা করার এবং মতামত প্রকাশ করার স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেয়া হবে। জামায়াতের সদস্যদেরকে (আরকান) আমি আল্লার দোহাই দিয়ে নির্দেশ দিচ্ছি যে,ফিকাহ ও কালাম শাস্ত্র সম্পর্কিত আমার কথাকে আপনারা কেউ অন্যের সম্মুখে প্রমাণ স্বরূপ প্রকাশ করবেন না। অনুরূপভাবে আমার ব্যক্তিগত কার্যাবলীকেও—- যেগুলোকে আমি নিজের অনুসন্ধান ও গবেষণার পর জায়েজ মনে করেছি—-অন্য কেউ যেন প্রমাণ স্বরূপ গ্রহণ না করেন এবং নিছক আমি করেছি এবং করেছি বলেই যেন বিনা অনুসন্ধানে তার অনুসারী না হন। এব্যাপারে প্রত্যেকের পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। যারা যারা ইলম রাখেন,তারা নিজেদের গবেষণা অনুসন্ধান মুতাবেক আর যারা ইলম রাখেন না,তারা যারা ইলমের উপর আস্থা রাখেন,তার গবেষণা অনুসন্ধান মুতাবেক কাজ করে যান। উপরন্তু এ ব্যাপারে আমার বিপরীত মত পোষণ করার এবং নিজেদের মত প্রকাশ করার স্বাধীনতা প্রত্যেকের রয়েছে। আমরা প্রত্যেকেই ছোটখাটো এবং খুঁটিনাটি ব্যাপারে বিভিন্ন মতের অধিকারী হয়ে পরস্পরের মুকাবিলায় যুক্তি প্রমাণ পেশ করে এবং বিতর্কে অবতীর্ণ হয়েও একই জামায়াতের অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারি—যেমন সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়ল্লাহ আনহু ছিলেন।” (ইকামতে দ্বীন, পৃ ৭৬)
উপরের কথা থেকে স্পষ্ট যে, মাওলানা মওদূদীর ফিকহি ও কালামি কথাগুলোকে জামায়াতে ইসলামীর আমীরের কথা হিসাবে গ্রহণ করতে তিনি নিষেধ করেছেন। এখানে তার ফিকহি ও কালামি লেখাগুলোকে আমরা খেদমতে দ্বীনের কাজ হিসাবে উল্লেখ করতে পারি, আর রাজনৈতিক লেখাগুলোকে আমরা ইকামাতে দ্বীনের কাজ হিসাবে উল্লেখ করতে পারি। যখন মাওলানা মওদূদী রাজনৈতিক দলের আমীর হতে গেলেন, তখন তাকে বাধ্য হয়েই তার লেখাগুলোকে দুইভাগে ভাগ করতে হলো। একধরনের লেখা হলো রাজনৈতিক, এবং অন্য ধরনের লেখা হলো অরাজনৈতিক বা ফিকহি ও কালামি। তিনি তার কালামি লেখাগুলোকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হিসাবে নিতে বারণ করেছেন। খেদমাতে দ্বীনের লোকদেরকে যখন আমরা ইকামাতে দ্বীনের কাজে আনতে চাই, তখন ঠিক একই ধরণের জটিলতা তৈরি হয়। তাই খেদমতে দ্বীনের লোকজনকে তাদের স্থানে কাজ করতে দেয়া, এবং ইকামাতে দ্বীনের লোককে তাদের স্থানে কাজ করতে দেয়াই উত্তম। কেউ যদি খেদমতে দ্বীনের কাজ ও ইকামাতে দ্বীনের কাজকে সমান গুরুত্ব দেয়, তাহলে আর কোনো সমস্যা থাকে না। কিন্তু যখনি একটি কাজকে অন্য কাজের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়, তখনি সমস্যা শুরু হয়।
ইকামাতে দ্বীনের যে সংজ্ঞা প্রফেসর গোলাম আজম উপরে দিয়েছেন, তাতে বলা হয়েছে, ইকামাতে দ্বীনের কাজ সেটাই, যেটাতে কায়েমী স্বার্থের বাধা আসবে। এক্ষেত্রে কায়েমী স্বার্থ বলতে আসলে কেবল মুসলিম দেশের সরকারকেই মনে করা হয়। অথচ সরকার ছাড়াও বিদেশি শক্তি, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও শয়তান সহ আমাদের অনেক শত্রু রয়েছে।
কওমি মাদ্রাসার আলেমরা সরকারকে শত্রু মনে করে না ঠিক, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী ও বিদেশি শক্তিকে ঠিকই শত্রু মনে করে। তারা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন না করলেও বিদেশি ও সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। যেহেতু কওমি মাদ্রাসার আলেমরা সরাসরি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে না, তাই সরকারও সরাসরি তাদের বিরোধিতা করে না। কিন্তু সরকার কারো বিরোধিতা না করলেই সে দল বা সে গোষ্ঠী ইকামাতে দ্বীনের কাজ করছে না, এমন বলা যাবে না। কারণ ২০০ বছর কওমি মাদ্রাসা সাম্রাজ্যবাদী ও বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে লড়েছে, এবং নিয়মিত লড়ছে। ফলে নিজ দেশের সরকারের বিরোধিতা করে না বলে কওমি মাদ্রাসার আলেমদেরকে কেবল খেদমতে দ্বীনের আওতাধীন করে ফেলা ঠিক নয়।
এরপর আসুন সূফীদের কথা। প্রফেসর গোলাম আযমের মতে, সূফীরাও ইকামতে দ্বীনের কাজ করে না, বরং খেদমতে দ্বীনের কাজ করে। কারণ, সূফীরা সরকারের বিরোধিতা করেন না। সূফীরা সরকারের বিরোধিতা করেন না ঠিক আছে, কিন্তু তারা আরো বড় শত্রুর মোকাবেলা করেন, যার নাম শয়তান। কোরআনে সবচেয়ে বড় শত্রু হিসাবে শয়তানকেই চিহ্নিত করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন,
إِنَّ الشَّيْطَانَ لَكُمْ عَدُوٌّ فَاتَّخِذُوهُ عَدُوًّا إِنَّمَا يَدْعُو حِزْبَهُ لِيَكُونُوا مِنْ أَصْحَابِ السَّعِيرِ
“শয়তান তোমাদের শত্রু; অতএব তাকে শত্রু রূপেই গ্রহণ কর। সে তার দলবলকে আহবান করে যেন তারা জাহান্নামী হয়। “[ সুরা ফাতির ৩৫:৬ ]
শয়তানকে যারা শত্রু মনে করে, শয়তান নিশ্চয় তাদেরকে নির্যাতন করে, কিন্তু সেটা আমরা দেখি না। কোনো সুফী যদি সরকারের বিরোধিতা না করে আসল শত্রু শয়তানের বিরোধিতা করে, এবং শয়তানের অত্যাচারের স্বীকার হয়, তবুও সে সূফী ইকামাতে দ্বীনের কাজ করে না, এমনটা বলা যায়?
আসলে সূফী, তাবলিগী, কওমি, সালাফী সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে ইকামাতে দ্বীনের কাজ করে যাচ্ছেন। কেউ ইকামাতের দ্বীনের কাজ বেশি করছেন, কেউ খেদমতে দ্বীনের কাজ বেশি করছেন। ইকামাতে দ্বীনের কাজ যারা করছেন, তারা যখন মনে করেন, আমরাই সবচেয়ে বড় ফরজের কাজ করছি, অন্যদেরকে আমাদের সাথে যোগ দেয়া প্রয়োজন, তখনি সমস্যাটা শুরু হয়। একইভাবে খেদমতে দ্বীনের কাজ যারা করছেন, তারা যখন মনে করেন, আমরাই আসল কাজ করছি, তাই সবার ইকামাতে দ্বীনের কাজ ফেলে খেদমতে দ্বীনের কাজে ফিরে আসা প্রয়োজন, তখনি সমস্যাটা শুরু হয়।