জাতীয় ধর্ম কেন প্রয়োজন?
আমাদের একটা জাতীয় ফুল, জাতীয় ফল, জাতীয় ভাষা যেমন আছে, তেমনি আমাদের একটা জাতীয় ধর্মও আছে। সেটা ইসলাম।
জাতীয় ভাষা কেন আমাদের প্রয়োজন?
প্রতিটি অঞ্চলের মানুষ তাদের নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে—যেমন, নোয়াখালীর মানুষ সিলেটের ভাষা বুঝতে পারেন না, আর চট্টগ্রামের মানুষ বরিশালের ভাষা বুঝতে অসুবিধা বোধ করেন। ফলে আমাদের এমন একটি জাতীয় ভাষার প্রয়োজন, যা নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও সিলেটের সবার কাছে বোধগম্য হবে। সেই ভাষাই হলো আমাদের জাতীয় ভাষা—বাংলা।
আমাদের একটা জাতীয় ধর্ম কেন প্রয়োজন?
মাজার ভক্তি করা লোকদের মধ্যে কিছু নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস ও যুক্তি আছে। আবার, যারা মাজার বিরোধিতা করেন, তাঁদেরও নিজস্ব ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও যুক্তি রয়েছে। কিন্তু তারা একে অপরের ধর্মবোধ ও যুক্তি বোঝেন না। তাই, এমন একটি কমন ধর্মীয় বোধ বা মূল্যবোধের প্রয়োজন, যা মাজারপন্থী ও মাজারবিরোধী উভয়েই বুঝতে এবং গ্রহণ করতে সক্ষম হবে। সেই মূল্যবোধই হলো আমাদের জাতীয় মূল্যবোধ বা ধর্ম—ইসলাম।
এখন একটা প্রশ্ন আসতে পারে। এ দেশে তো হিন্দু, বোদ্ধ, খ্রিস্টান, শিখ নানা ধর্মের মানুষ আছে, তাহলে ইসলাম জাতীয় ধর্ম হয় কীভাবে? এটার উত্তর পাবেন অন্য একটা প্রশ্নে। এদেশে চাকমা, মণিপুরী, রাখাইন সহ অনেক ভাষা আছে। তাদের নিজস্ব বর্নমালা ও সাহিত্যও রয়েছে। তাহলে এ দেশের জাতীয় ভাষা বাংলা কেন?
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, এ দেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, শিখসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বসবাস করে, তাহলে ইসলাম কীভাবে জাতীয় ধর্ম হতে পারে? এর উত্তর পেতে হলে আমরা জাতীয় ভাষার উদাহরণ দেখতে পারি। এদেশে চাকমা, মণিপুরী, রাখাইনসহ অনেক ভাষা রয়েছে, তাদের নিজস্ব বর্ণমালা ও সাহিত্যও আছে। তাহলে প্রশ্ন হলো, বাংলা কেন জাতীয় ভাষা? যে কারণে বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা, একই কারণে ইসলাম আমাদের জাতীয় নৈতিকতা।
মূল বিষয়টা হলো, একটি দেশ বা রাষ্ট্রে একটি ভাষাকে জাতীয় ভাষা ঘোষণা করার অর্থ এই নয় যে অন্য ভাষাগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে। একইভাবে, একটি ধর্মকে জাতীয় ধর্ম হিসেবে বিবেচনা করার মানে এই নয় যে অন্যান্য ধর্ম আঘাতপ্রাপ্ত হবে বা তাদের গুরুত্ব হারাবে।
যেমন শাপলা আমাদের জাতীয় ফুল। এর মানে এই নয় যে কেউ এ দেশে জবা বা হাসনেহেনা গাছ লাগাতে পারবে না।
জাতীয় প্রতীক ও ভিন্নমতের প্রতি ভালোবাসা
জাতীয় ভাষা, ধর্ম, কিংবা ফুল—এসব প্রতীক আসলে একটি জাতির ঐক্য এবং পরিচয় বহন করে। এগুলোকে ঘিরে ছোট ছোট ভিন্নমত থাকলেও তা ভালোবাসা ও সহানুভূতির মাধ্যমে গ্রহণ করা উচিত, যাতে বিভিন্ন মতের মানুষও আমাদের কাছ থেকে সম্মান ও আস্থা পেতে পারে।
যেমন শাপলা আমাদের জাতীয় ফুল। এর মানে এই নয় যে কেউ এ দেশে জবা বা হাসনেহেনা গাছ লাগাতে পারবে না।
জাতীয় ভাষা, জাতীয় ধর্ম, কিংবা জাতীয় ফুল—এসব প্রতীক আসলে একটি জাতির ঐক্যের মন্ত্র। এগুলোকে ঘিরে ছোট ছোট ভিন্নমত থাকলেও তাদেরকে ভালোবাসা, দয়া ও সম্মানের মাধ্যমে গ্রহণ করা উচিত, যাতে বিভিন্ন মতের মানুষও জাতীয় ঐক্যবদ্ধ মানুষদের থেকে সম্মান ও আস্থা পেতে পারে।
উপরের লেখার বিপরীতে ফরহাদ মজহারের যুক্তিযুক্ত লেখা
ফেইসবুকে একজন ভাই আমার এক সাক্ষাৎকার উল্লেখ করে লিখেছেন, “আপনি বলেছেন, ‘রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকে না। ধর্ম থাকে মানুষের। রাষ্ট্র কি নামাজ-কালাম পড়তে পারে?’
জ্বি। আমি বলেছি।
এরপর ভাই লিখেছেন:
“আপনার প্রতি আমাদের বিনীত প্রশ্ন, রাষ্ট্রের যদি ভাষা থাকতে পারে, তাহলে ধর্ম থাকতে পারবে না কেন? রাষ্ট্রের আদর্শ-দর্শন থাকতে পারলে ধর্ম থাকতে পারবে না কেন? রাষ্ট্র মানুষ না হওয়া সত্ত্বেও গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার মতো মতবাদ যদি রাষ্ট্রের থাকতে পারে, তাহলে তার ধর্ম থাকতে পারবে না কেন?”
ভাল প্রশ্ন। এই ধরণের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নিয়ে আমাদের আন্তরিক ভাবেও আলোচনা করা উচিত।
১. রাষ্ট্রের ভাষা থাকতে পারে না। কারন রাষ্ট্র কথা বলে না। ভাষা দরকার হয় সরকারি কাজকর্মে। তাই রাষ্ট্রের একটা সরকারি ভাষা থাকে যার দ্বারা রাষ্ট্রের কার্যাবলী সম্পাদিত হয়। কেউ নোয়াখালি, কেউ সিলেট, কেউ রংপুর, কেউ চট্টগ্রামের ভাষা ইত্যাদিতে সরকারি কাজকর্ম করলে সেটা জটিলতা তৈরি করে। তাই কথাটা আসলে ‘রাষ্ট্রভাষা’ না, এতে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। আসলে হবে সরকারি কার্য প্রণালী পরিচালনার ভাষা বা সরকারি ভাষা।
২. তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্যও মাতৃভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা্র বাইরে আরেকটি ভাষা তৈরির দরকার হয়। সমাজে ব্যবসা বাণিজ্যের বিস্তৃতি ঘটতে থাকলে নোয়াখালি, সিলেট, রংপুর, চট্টগ্রামের মানুষ নিজেদের সঙ্গে কথা বলার জন্য বাজার ব্যবস্থার মধ্যে আরেকটি ভাষা গড়ে তোলে, ভাষার ইতিহাস ও বিবর্তন বোঝার জন্য ভাষাবিদরা ভাষার সমাজতত্ত্বের এই সকল নানান দিক নিয়ে গবেষণা করে থাকেন। আমাদেরও সমাজের নানান স্তরে নানান সামাজিক ভাষা আছে। জীবন্ত ভাষা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজের শক্তি নিয়ে হাজির থাকে।
৩. আবার সমাজ আরও অগ্রসর হলে সমাজে বিভিন্ন এলাকার মানুষ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা তর্ক বিতর্ক সাহিত্য কাব্য ইত্যাদি করতে গিয়ে সকলের কাছে কমবেশী গ্রহণযোগ্য একটি ভাষা তৈরি করে। এটা সংবাদপত্র বা সাহিত্যের ভাষা। এই ভাষা মূলত সাহিত্য চর্চা ও সংবাদপত্র বিকাশের মধ্য দিয়ে হাজির হয়। একে বলা হয় ‘প্রমিত ভাষা’। অর্থাৎ ভাষার একটা স্টেন্ডার্ড তৈরি হয়। সেটা নিয়ম মেনে গড়ে ওঠে তা না। সেখানে ঐতিহাসিক দুর্ঘটনাও ভূমিকা রাখে। যেমন বাংলা সাহিত্যের ভাষা। ইংরেজের জাহাজ কলকাতার সুতানটি গ্রামে নোঙর করেছিল, বা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারনে কলকাতা বাংলার জমিদারদের শহর হয়ে উঠেছিল বলে উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের হাতে একটা বাংলাভাষা গড়ে ওঠে, একেই প্রমিত ভাষা বলা হয়। বাংলা সাহিত্যে উচ্চ বর্ণের হিন্দুর এই ভাষাই, আমরা চাই বা না চাই ব্যবহার করি। বাংলা ভাষাকে ধর্ম ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলের ভাষা হিশাবে রূপ দেওয়াই আমাদের সাহিত্য ও দর্শনের দিক থেকে ঢাকার প্রধান একটি কাজ।
কলকাতাকেন্দ্রিক উচ্চ বর্ণের ভাষা বদলাবার জন্য স্বাধীন বাংলাদেশে তরুণরা নতুন ভাষা তৈরির চেষ্টা করে। কিন্তু সেটাও আপনা আপনি সার্বজনীন হবে না। সেটা ঢাকার ভাষা বা আরও সুনির্দিষ্ট ভাবে বাড্ডা অঞ্চলের ভাষা হবে বলা যায়। ঢাকার কুট্টিদের উর্দু মেশানো দুর্দান্ত ভাষাকে আমরা কিন্তু কবর দিয়ে দিয়েছি। অথচ সাহিত্য নতুন ভাষা তৈরি করে, এর মধ্য দিয়ে জনগণ নতুন ভাবে নিজেদের নিয়ে ভাবে এবং নিজেদের বিকাশ নিশ্চিত করে।
৪. কিন্তু ধর্মের ভূমিকা আরও বড়ো, বিস্তৃত এবং গভীর। ইসলাম ঐতিহাসিক ভাবে বিপ্লবী এবং যুগান্তকারী ধর্ম। তাকে প্রচলিত ধর্মতত্ত্ব দিয়ে পুরাপুরি বোঝা যায় না। যীশুর ঐতিহাসিকতা নিয়ে তর্ক আছে, কৃষ্ণ, বিষ্ণু বা রাম সমসাময়িক বা ঐতিহাসিক চরিত্র নন, তাঁরা পুরাণের চরিত্র। এর দ্বারা তাঁরা হেয় বা ক্ষুদ্র হয়ে যান না, কিন্তু ইসলামের সঙ্গে পার্থক্য বোঝার জন্য এই সত্য মনে রাখা জরুরি। বিপরীতে মোহাম্মদ (সা) একজন ঐতিহাসিক চরিত্র, আল্লার রসুল এবং সেনাপতি। তাঁর আবির্ভাব একটি বিশ্ব-ঐতিহাসিক ঘটনা, বা ইতিহাসের একটি ছেদবিন্দু।
ইসলামের আবির্ভাবের পর মানবেতিহাস ভিন্ন হবার কথা ছিল, সেটা হয় নি। কারন আমরা ইহুদি-খ্রিস্টিয়-গ্রিক চিন্তার আধিপত্যের অধীনে পাশ্চাত্যের গোলাম হয়ে রয়েছি। এমনকি পাশ্চাত্য ‘ধর্ম’-কে যেভাবে বুদ্ধি-জ্ঞান-প্রজ্ঞা-বিজ্ঞান থেকে আলাদা ভাবে বোঝে, কিম্বা সজীব ও সক্রিয় চিন্তার বিপরীতে স্রেফ বিশ্বাস (FAITH) বলে দাবি করে — আমরাও ইসলামকে বুদ্ধি-জ্ঞান-প্রজ্ঞা-বিজ্ঞান থেকে আলাদা ভাবে স্রেফ ‘বিশ্বাস’ হিশাবে বুঝি। এই ভুল থেকে ইসলামের ক্ষয়ের শুরু। অথচ ‘ঈমান’ মানে গায়েবে ‘আত্মসমর্পন’। ইসলাম আমরা আসলে হারিয়ে ফেলেছি। এটা আমাদের জন্য আত্মঘাতী হয়েছে।
৫. পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে, বুদ্ধিবৃত্তিক, দার্শনিক এবং ভাবগত লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের আবার বিশ্বসভায় প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। ইতিহাস, প্রজ্ঞা ও দার্শনিক বিচার ছাড়া ইসলামকে পূর্ণ ভাবে বোঝা কিম্বা ইসলামের আদর্শিক বা ভাবগত শক্তি আমরা পুনরুদ্ধার করতে পারব না। আমাদের সজীব ও সক্রিয় চিন্তায় ইসলামকে মানবেতিহাসের প্রধান ঘটনা বা ঐতিহাসিক ছেদবিন্দু হিশাবে ফিরিয়ে আনতে হবে। একে আমি ‘মক্কা বিজয়’ বা বিশ্ব বিজয়ের লক্ষে প্রজ্ঞা, সামরিকতা ও রুহানি অভিযান হিশাবে বুঝি। নাফসানিয়াতের বিপরীতে রুহানিয়াত কায়েমের কর্তব্য আমাদের সামনে হাজির হয়ে গিয়েছে। ইনশাল্লাহ, বাংলাদেশ সেই ক্ষেত্রে নেতৃত্বের ভূমিকা রাখবে।
৬. এই জন্য বাংলাদেশে তরুণদের নেতৃত্বে যে গণঅভ্যুত্থান ঘটে গেল সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব দ্বারা তাকে সাময়িক রুখে দেওয়া হয়েছে। সাময়িক রুখে দিতে পারলেও সেটা সাময়িক। প্রজ্ঞার তুফান হয়ে গণমানুষের সামষ্টিক রুহানি শক্তি হয়ে ইসলাম আবার ফিরে আসবে।
৭. তাহলে বিজয়ী গণঅভ্যুত্থানের পরে আগামিতে যে রাষ্ট্র গঠন করবার জন্য আমরা ভাবব সেখানে ধর্মের ভূমিকা কি হবে তাকে হাল্কা কোন প্রশ্ন দিয়ে মামুলি কায়দায় বোঝা যাবে না। কুতর্কেও তার মীমাংসা হবে না। গভীরে ডুবতে হবে: বুদ্ধি, জ্ঞান ও প্রজ্ঞাসহ আল্লাহ মানুষকে অন্য যে সকল মানবিক বৃত্তি দিয়ে দুনিয়ায় তাঁর প্রতিনিধি হবার গুণসম্পন্ন করে সৃষ্টি করেছেন তার মর্যাদা রাখতে জানতে হবে। তাই ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম বানাবার দাবি জানালে সেটা হবে না।
৮. আধুনিক পাশ্চাত্য রাষ্ট্র মূলত খ্রিস্টিয় রাষ্ট্র। তার ওপর ইসলামি জোব্বা পরালে সেটা ইসলামি হয়ে যায় না। ইসলামি রাষ্ট্রের দাবি তাই ইসলাম বিরোধী দাবি।
যেমন, আধুনিক রাষ্ট্র দাবি করে রাষ্ট্রই সার্বভৌম। বিপরীতে ইসলাম দাবি করে সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লার এবং একমাত্র মানুষই তাঁর যোগ্য খলিফা বা ইহলোকে তাঁর প্রতিনিধি। ফেরেশতারা যে মানুষ সৃষ্টির বিরোধিতা করেছিলো, আল্লাহ রুহানি গুণ সম্পন্ন সেই মানুষ সৃষ্টি করে যে রুহানি শক্তিকে সিজদা দিতে ফেরেশতাদের আদেশ দিয়েছিলেন কে সেই ‘মানুষ’? কি সেই ‘শক্তি’? জানতে হবে।
রুহানিয়াতের এই গোড়ার প্রশ্ন সমাধানের মধ্যে বাংলাদেশে আগামি রাষ্ট্রের রূপকল্প আমরা আন্দাজ করতে শিখব।
ইনিকিলাব জিন্দাবাদ।