| |

ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞান

১ম পর্ব

যুক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে ইসলামকে বুঝতে গেলে অনেকেই বলতে শুরু করেন – ‘দ্যাখ, ইবলিস কিন্তু তোর মত যুক্তি দিতে গিয়েই কাফের হইছিল’।

যুক্তির বিরুদ্ধে ‘যুক্তি’ প্রদান করে অনেকে বলেন…

‘ইবলিস আল্লাহর সামনে ‘যুক্তি’ প্রদান করার কারণে সে কাফির ও শয়তান হয়ে গেছে’।

কিন্তু, আল্লাহ তায়ালা বলেন…

فَسَجَدَ ٱلْمَلَـٰٓئِكَةُ كُلُّهُمْ أَجْمَعُونَ إِلَّا إِبْلِيسَ اسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ

“সমস্ত ফেরেশতা একযোগে সেজদায় নত হল। কিন্তু ইবলিস অহংকার করল এবং সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল”। [সূরা ৩৮ /সাদ – ৭৪]

দেখুন,

আমরা বলি, ইবলিস ‘যুক্তি’ প্রদান করার কারণে কাফির হয়ে গেছে; কিন্তু আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ইবলিস অহংকার করার কারণে কাফির হয়েছে। তাহলে এখানে কার কথা সত্য?

‘যুক্তি’ ও ‘অহংকার’ একে অপরের সম্পূর্ণ বিপরীত। কোর’আনে যতস্থানে ‘যুক্তি-বুদ্ধি’ বা ‘আকলের’ কথা বলা হয়েছে, ততস্থানেই ইতিবাচক ও প্রশংসনীয় অর্থে এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু কোর’আনের যতস্থানে ‘অহংকার’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, ততস্থানেই নেতিবাচক ও নিন্দনীয় অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।

কোর’আনের ভাষ্যমতে, ইবলিস যুক্তি প্রদান করার কারণে নয়, বরং সে তার শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার করেছিল বলেই সে কাফির হয়েছিল। কেউ যদি অহংকারের কারণে অন্যের যুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করে, কিংবা অহংকারের সহিত নামাজ পড়ে বা অন্য কোনো ইবাদতও করে, তাহলেও আল্লাহ তায়ালা তাকে অভিশাপ দেন।

যুক্তি-বুদ্ধি ও অহংকার একেবারেই পরস্পর বিরোধী দুটি ধারণা। অহংকারের কারণে সত্য বা যুক্তিকে অস্বীকার করার নামই কাফের।

২য় পর্ব

পৃথিবীতে পথ চলার দুটি পন্থা রয়েছে।

১। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আগত ওহীর কথা শুনে হুবহু তা মেনে চলা।

অথবা,

২। আল্লাহর দেয়া যুক্তি-বুদ্ধি ব্যবহার করে পথ চলা।

কেউ যদি উপরের যে কোনো একটি পন্থা অথবা উভয় পন্থার সমন্বয়ে পথ চলে, তাহলে তাঁর পথ হারানোর কোনো সম্ভাবনা নেই।

এ কারণে আল্লাহ তায়ালা বলছেন –

وَقَالُوا لَوْ كُنَّا نَسْمَعُ أَوْ نَعْقِلُ مَا كُنَّا فِي أَصْحَابِ السَّعِيرِ

“তারা বলবে, যদি আমরা (রাসূলদের কথা) শুনতাম অথবা আমাদের যুক্তি-বুদ্ধি খাটাতাম, তবে আমরা জাহান্নামবাসীদের মধ্যে থাকতাম না”। [সূরা ৬৭/মুলক – ১০]

এ আয়াতে স্পষ্ট যে, ওহী ও যুক্তি-বুদ্ধির মাঝে কোনো পার্থক্য নেই।

৩য় পর্ব

আল্লাহ তায়ালা সবসময় বলেন,

তোমরা যদি আমার “আয়াত সমূহ” বিশ্বাস কর, তাহলে তোমরা মুসলিম হতে পারবে। কিন্তু, তোমরা যদি আমার “আয়াত সমূহ” অস্বীকার কর, তাহলে তোমরা হতভাগা হয়ে যাবে। [সূত্র ৪৩: ৬৯, ৯০: ১৯]

এখান প্রশ্ন হলো, আল্লাহর “আয়াত সমূহ” কি কেবল কোর’আনে-ই সীমাবদ্ধ?

উত্তর – না।

কেননা, তিনি বলছেন যে,

وَفِى ٱلْأَرْضِ ءَايَـٰتٌۭ لِّلْمُوقِنِينَ وَفِىٓ أَنفُسِكُمْ ۚ أَفَلَا تُبْصِرُونَ

“বিশ্বাসীদের জন্যে পৃথিবীতে “আয়াত” রয়েছে, এবং তোমাদের নিজেদের মধ্যেও “আয়াত” রয়েছে; তোমরা কি তা দেখ না?” [সূরা ৫১/যারিয়াত – ২০ ও ২১]

এবং,

سَنُرِيهِمْ ءَايَـٰتِنَا فِى ٱلْءَافَاقِ وَفِىٓ أَنفُسِهِمْ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُ ٱلْحَقُّ ۗ أَوَلَمْ يَكْفِ بِرَبِّكَ أَنَّهُۥ عَلَىٰ كُلِّ شَىْءٍۢ شَهِيدٌ

“আমি তাদেরকে পৃথিবীর দিগন্তে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে আমার “আয়াত সমূহ” প্রদর্শন করাব; ফলে তাদের কাছে ফুটে উঠবে যে, এটি সত্য। এটা কি তোমার রবের জন্যে যথেষ্ট নয় যে, তিনি সববিষয়ে অবহিত?” [সূরা ৪১/ফুসসিলাত – ৫৩]

এ আয়াত দুটি অনুযায়ী, কোর’আন ছাড়াও কমপক্ষে আরো দুটি স্থানে আল্লাহর “আয়াত” রয়েছে।

এক – পৃথিবীতে।
দুই – আমাদের নিজেদের মধ্যে।

সুতরাং, কেউ যদি আল্লাহর “আয়াত সমূহ” বিশ্বাস করতে চায়, তাহলে তাঁকে তিনটি স্থানে যেতে হয়, এবং তিনটি কাজ করতে হয়।

এক – কোর’আন বুঝতে হয়।
দুই – পৃথিবীকে দেখতে হয়।
তিন – নিজেকে জানতে হয়।

 

৪র্থ পর্ব

আল্লাহর আয়াত বা আল্লাহর সত্য তিনটি স্থানে খুঁজে পাওয়া যায়। নিজের মধ্যে, পৃথিবীতে এবং আল কোর’আনে।

কিছু কিছু সূফী-বাউল কেবল তার নিজের ভিতরে থাকা সত্যকে স্বীকার করে, কিন্তু বাইরে থাকা পৃথিবীর সত্য ও আল কোর’আনের সত্যকে স্বীকার করে না।

তেমনি,

কিছু কিছু বিজ্ঞানী কেবল পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা সত্যগুলোকে স্বীকার করে, কিন্তু নিজের মধ্যে থাকা সত্যকে উপলব্ধি করতে পারে না, এবং কোর’আনের সত্যকেও বুঝতে পারে না।

তেমনি,

কিছু কিছু ধার্মিক কেবল কোর’আনের সত্যকে বিশ্বাস করে, কিন্তু পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা সত্যকে বুঝতে চায় না, এবং নিজের মধ্যে থাকা সত্যকেও উপলব্ধি করতে পারে না।
______

যারা উপরোক্ত সবগুলো সত্য বা সবগুলো আয়াতকেই স্বীকার করে, তারাই কেবল সত্যের বিশ্বাসী হতে পারে।

৫ম পর্ব

সুন্নাতুল্লাহ কি এবং কেন?

সুন্নাতুল্লাহ হলো আল্লাহর এমন কিছু নিয়ম, যা বিশ্বের সকল স্থানে, সব সময়, সবার জন্যে, সমানভাবে প্রযোজ্য। অর্থাৎ, নবী, রাসূল, মুমিন, মুসলিম, সাধারণ মানুষ, পশু, পাখি, গাছ, গাছালি, সাগর, নদী, পৃথিবী বা বিশ্বের সবার জন্যে সব সময় প্রযোজ্য ও অপরিবর্তনীয় নিয়মগুলোই হলো সুন্নাতুল্লাহ বা আল্লাহ রীতিনীতি।

পৃথিবীতে যে জাতি যতবেশি সুন্নাতুল্লাহ জানতে পারে, সে জাতি পৃথিবীতে ততবেশি সম্মানিত হতে পারে।

বর্তমান মুসলিমদের পিছিয়ে পড়ার একমাত্র কারণ, তারা সুন্নাতুল্লাহ সম্পর্কে একেবারেই আরবের জাহেল বা অজ্ঞদের মত আচরন করে। বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য সুন্নাতুল্লাহকে না জেনে, আমরা সারা জীবন যতই ‘ধর্ম-ধর্ম’ করি না কোনো, ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ হবে না।

[বিস্তারিত দেখুন, আল কোর’আন, ৪০: ৮৫, ১৭: ৭৭, ৩৩: ৬২, ৪৮: ২৩, ৪০: ৮, ৩৩: ৩৮, ৪২: ১৩, ৫: ৪৮]

৬ষ্ঠ পর্ব

ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞানের খুবই সুন্দর একটি সমন্বয় রয়েছে সূরা আনকাবুতের ৪৩ থেকে ৪৫ নং আয়াতে।
_________
৪৩ নং আয়াত হলো ধর্ম ও দর্শনের সম্পর্ক।

وَتِلْكَ ٱلْأَمْثَـٰلُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِ ۖ وَمَا يَعْقِلُهَآ إِلَّا ٱلْعَـٰلِمُونَ

“এ সকল উদাহরণ আমি মানুষের জন্যে দিয়ে থাকি। কিন্তু জ্ঞানীরা ছাড়া অন্য কেউ তা বোঝে না”। [সূরা ২৯/আনকাবুত – ৪৩]

দার্শনিক তারাই যারা সাধারণ বিষয়গুলোকে অসাধারণ ভাবে দেখে। আল্লাহ তায়ালা কোর’আনে মানুষের জন্যে অসংখ্য উদাহরণ দিয়েছেন। কিন্তু জ্ঞানী ও দার্শনিকগণ ব্যতীত অন্য কেউ সেই উদাহরণগুলোর আসল মর্ম উদ্ধার করতে পারে না।
_________
৪৪ নং আয়াতে বিজ্ঞান ও ধর্মের সম্পর্ক।

خَلَقَ ٱللَّهُ ٱلسَّمَـٰوَ‌ٰتِ وَٱلْأَرْضَ بِٱلْحَقِّ ۚ إِنَّ فِى ذَ‌ٰلِكَ لَءَايَةًۭ لِّلْمُؤْمِنِينَ

“আল্লাহ যথার্থরূপে আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। ঈমানদার সম্প্রদায়ের জন্যে এখানে নিদর্শন রয়েছে”। [সূরা ২৯/আনকাবুত – ৪৪]

কোর’আনের মত আসমান ও জমিনে আল্লাহর অসংখ্য আয়াত বা চিরন্তন সত্য (Universal Truth) রয়েছে। ঈমানদার সম্প্রদায়ের উচিত সেই চিরন্তন সত্যগুলো খুঁজে বের করা।
_________
৪৫ নং আয়াতে উপরোক্ত দুটি আয়াতের সম্পর্ক।

ٱتْلُ مَآ أُوحِىَ إِلَيْكَ مِنَ ٱلْكِتَـٰبِ وَأَقِمِ ٱلصَّلَوٰةَ ۖ إِنَّ ٱلصَّلَوٰةَ تَنْهَىٰ عَنِ ٱلْفَحْشَآءِ وَٱلْمُنكَرِ ۗ وَلَذِكْرُ ٱللَّهِ أَكْبَرُ ۗ وَٱللَّهُ يَعْلَمُ مَا تَصْنَعُونَ

“পড়ুন আপনার প্রতি প্রত্যাদিষ্ট কিতাব। সালাত কায়েম করুন, নিশ্চয় সালাত অশ্লীল ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখে। আল্লাহর স্মরণ সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ জানেন তোমরা যা কর। [সূরা ২৯/আনকাবুত – ৪৫]

বিশ্বজগতে যত চিরন্তন সত্য রয়েছে তা পড়ে দেখার জন্যে বলা হচ্ছে এ আয়াতে। জ্ঞানীগণ কোর’আন ও বৈজ্ঞানিক চিরসত্যগুলো পড়ে পড়ে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি করাই ধর্মের কাজ।
_________

উপরোক্ত তিনটি আয়াত অনুযায়ী, প্রতিটি মানুষের প্রথমত জ্ঞানী বা দার্শনিক হওয়া প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত বিশ্বজগৎ সম্পর্কে বিজ্ঞানী হওয়া প্রয়োজন। তৃতীয়ত আল্লাহর সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি করা বা ধার্মিক হওয়া প্রয়োজন।

 

৭ম পর্ব

 

ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞান –এ তিনটি বিষয় হলো তিনটি ভাষার মত। ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ –এ কথাটি বাংলায় না বলে আরবি বা ইংরেজিতে বললেও যেমন একই অর্থ হয়, তেমনি কোনো কিছুকে ধর্ম, দর্শন বা বিজ্ঞানের ভাষায় প্রকাশ করলেও একই অর্থ হয়।

পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ-ই কিছু না কিছু বিষয় বিশ্বাস করে। কেউ তার বিশ্বাসকে প্রকাশ করে ধর্মের ভাষায়, কেউ তার বিশ্বাসকে প্রকাশ করে দর্শনের ভাষায়, আবার কেউ তার বিশ্বাসকে প্রকাশ করে বিজ্ঞানের ভাষায়।

যেমন, বস্তুবাদ একটি বিশ্বাসের নাম।

একজন বস্তুবাদী ধার্মিক আল্লাহর সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি করার চেয়ে মসজিদের সৌন্দর্যকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। একজন বস্তুবাদী দার্শনিক সত্যের স্বতন্ত্র-স্বাধীন-একক সত্ত্বাকে স্বীকার না করে বস্তুর মাঝে সত্য খুঁজতে থাকে। তেমনি, একজন বস্তুবাদী বিজ্ঞানীও স্রষ্টাকে বোঝার চেষ্টা না করে তার বস্তুগত সৃষ্টিকে বোঝার চেষ্টা করতে থাকে।

এখানে ধর্ম, দর্শন বা বিজ্ঞানের কোনো সমস্যা নেই, সমস্যা হলো মানুষের বস্তুবাদী চেতনার।

৮ম পর্ব

জ্ঞান নামক শরীরের হার্ট হলো ধর্ম। ব্রেইন হলো দর্শন, এবং হাত-পা হলো বিজ্ঞান। ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞান হলো জ্ঞান নামক শরীরের তিনটি অঙ্গ।

ধর্ম ছাড়া জ্ঞান প্রাণহীন, দর্শন ছাড়া জ্ঞান অসুস্থ, এবং বিজ্ঞান ছাড়া জ্ঞান অচল। একটি অঙ্গ ছাড়া অন্যটির মূল্য নেই।

আল্লাহর কাছে ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞান বলে আলাদা কোনো ভাগ নেই, সব-ই জ্ঞান। কিন্তু মানুষ জ্ঞানকে হাজারো ভাগে বিভক্ত করেছে। তাই এখন জ্ঞানের একটি অংশ অন্য একটি অংশকে সহ্য করতে পারে না। অথচ, জ্ঞানের এক অংশ ব্যতীত অন্য অংশ মূল্যহীন।

আরো পোস্ট

একটি মন্তব্য লিখুন

আপনার ইমেইল অ্যাড্রেস প্রকাশ করা হবে না। তারকা (*) চিহ্নিত ঘরগুলো পূরণ করা আবশ্যক