| |

আত্মা সম্পর্কে আরজ আলি মাতুব্বরের ভ্রান্তি

যারা ইসলামের বিরোধিতা করে, তাদের প্রধান সমস্যা হলো তাঁরা হয়তো জীবনে একবারও কোর’আন পড়েনি, অথবা, পড়লেও কিছুই বুঝতে পারেনি। বাঙালি সেক্যুলারদের গুরু আরজ আলী মাতুব্বরেরও একই সমস্যা হয়েছে। তিনি হয়তো জীবনে কখনো কোর’আন পড়েননি, অথবা, বাংলা অনুবাদ পড়ে মোটেও বোঝেননি। ফলে, তার মনে ইসলাম সম্পর্কে বেশ কিছু অবান্তর প্রশ্ন জেগেছে, যার উত্তর কোর’আন পড়া যে কোনো মানুষ-ই সহজভাবে বলে দিতে পারে।

যেমন ধরুন, মাতুব্বর আত্মা বিষয়ক বেশ কিছু প্রশ্ন করেছেন। যার উত্তর কোর’আনে সুন্দরভাবে দেয়া আছে।

মাতুব্বর সাহেব বাংলা ভাষায় দক্ষ না হবার কারণে, “আত্মা বিষয়ক” লেখার ভিতরে কখনো ‘আত্মা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, আবার কখনো ব্যবহার করেছেন ‘প্রাণ’ শব্দটি। অর্থাৎ, একটি জগাখিচুড়ী অবস্থা করে ফেলেছেন। অথচ, ভাষাজ্ঞানে দক্ষ যে কেউই জানেন, দুটি শব্দ সমর্থক হলেও প্রত্যেক শব্দের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকে।

বাংলা ভাষায় আত্মা ও প্রাণ শব্দ দুটি সমর্থক বাচক শব্দ হলেও কোর’আনের ভাষায় আত্মা ও প্রাণ শব্দ দুটির মাঝে আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে। আত্মা শব্দের জন্যে কোর’আনে ‘নফস’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। আর, প্রাণ শব্দটির জন্যে কোর’আনে ‘হাই’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। যাই হোক, সে আলোচনা পরে আসছি, তার আগে আরজ আলীর প্রশ্নগুলো একটু দেখে নেয়া যাক।

তার প্রথম প্রশ্ন হলো –

“এই রক্ত-মাংস, অস্থি, মেদ-মজ্জা-গঠিত দেহটাই কি “আমি”? তাই যদি হয়, তবে মৃত্যুর পরে যখন দেহের উপাদান সমূহ পচিয়া-গলিয়া অর্থাৎ রাসায়নিক পরিবর্তনে কতগুলি মৌলিক ও যৌগিক পদার্থে রূপান্তরিত হইবে, তখন কি আমার আমিত্ব থাকিবে না? যদি না-ই থাকে, তবে স্বর্গ-নরকের সুখ-দুঃখ ভোগ করিবে কে?”

মাতুব্বরের এ প্রশ্নটির উত্তর দেয়ার আগে একটি ঘটনা কল্পনা করুন। ধরুন, আপনি ফেইসবুক ব্যবহার করার জন্যে একটা নতুন মোবাইল কিনলেন। এরপর, নতুন মোবাইলে একটি ফেইসবুক একাউন্ট খুললেন। আস্তে আস্তে ফেইসবুকে আপনি বিভিন্ন জনকে লাইক-কমেন্ট করতে লাগলেন, ভালো ভালো লিখা লিখতে লাগলেন, এবং এতে আপনার বন্ধু-বান্ধবও বাড়তে লাগলো। কিছুদিন পর আপনি অনেক বড় একজন সেলিব্রেটি হয়ে গেলেন। একদিন আপনি চলন্ত একটি রিক্সায় বসে ফেইসবুকের ইনবক্স চেক করছিলেন। কিন্তু, রিক্সাটি হঠাৎ ব্রেক করায় আপনার মোবাইলটি হাত থেকে রাস্তায় পড়ে গেলো, এবং পিছন থেকে একটি বাস এসে আপনার শখের মোবাইলটাকে সম্পূর্ণ চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিলো।

আপনি অনেক বড় একজন ফেইসবুক সেলিব্রেটি। রাস্তায় পড়ে আপনার শখের মোবাইলটি চূর্ণ-বিচূর্ণ হবার সাথে সাথে কি আপনার এতদিনের প্রিয় ফেইসবুক একাউন্টটিও ধ্বংস হয়ে গিয়েছে?

না। একজন ছোট বাচ্চাও জানে যে, মোবাইল ভাঙলেও ফেইসবুকের কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু আরজ আলী মাতুব্বর সহজ এ জিনিসটা বুঝলেন না। তিনি প্রশ্ন করলেন, “মৃত্যুর পরে যখন দেহের উপাদান সমূহ পচিয়া-গলিয়া অর্থাৎ রাসায়নিক পরিবর্তনে কতগুলি মৌলিক ও যৌগিক পদার্থে রূপান্তরিত হইবে,তখন কি আমার আমিত্ব থাকিবে না?” এ প্রশ্নের উত্তরে দার্শনিক মাতুব্বরকে একজন ছোট বাচ্চাও উল্টা প্রশ্ন করে বসবে যে, “আপনার মোবাইলটা রাস্তায় পড়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হলে কি আপনার ফেইসবুক একাউন্টটি থাকবে না?”

ফেইসবুক ব্যবহার করতে হলো মোবাইল বা ল্যাপটপ জাতীয় একটি ডিভাইস ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু, সে মোবাইল বা ল্যাপটপটি নষ্ট হয়ে গেলেও, আপনার ফেইসবুক একাউন্টটি আগের মত অক্ষত-ই থেকে যাবে। অর্থাৎ, নতুন কোনো ডিভাইসে ফেইসবুক লগইন করলে আপনার একাউন্টটি আবার সচল হয়ে যাবে।

আপনি কোন ধরণের মোবাইলে বা কোন ধরণের ল্যাপটপে ফেইসবুক ব্যবহার করছেন, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো ফেইসবুকের সাহায্যে আপনি কি করছেন, কি লিখছেন বা কার সাথে চ্যাট করছেন, এসব।

এখানে মাতুব্বরকে সহজে উত্তর দেয়ার জন্যে আমরা বলতে পারি, আমাদের শরীর বা রক্তমাংস এসব হলো মোবাইল বা ল্যাপটপের মতো। কিন্তু আমাদের আত্মা হলো ফেইসবুক একাউন্টের মতো। এই পৃথিবীতে আমাদের শরীর ধ্বংস হয়ে গেলেও আখিরাতে নতুন শরীরে যখন আমাদের আত্মাকে লগইন করা হবে, তখন আমরা আবার আমাদের সেই ‘আত্মা’কে খুঁজে পাব। ফেইসবুকে যেমন সকল এক্টিভিটি সংরক্ষিত থাকে, আমাদের এ দুনিয়ার সকল এক্টিভিটিও আখিরাতে সংরক্ষিত থাকবে।

*******************

আত্মা সম্পর্কে আরজ আলী মাতুব্বরের দ্বিতীয় প্রশ্নটি হলো –

“প্রাণ কি অরূপ না সরূপ? প্রাণ যদি অরূপ বা নিরাকার হয়, তবে দেহাবসানের পরে বিশ্বজীবের প্রাণসমূহ একত্র হইয়া একটি অখণ্ড সত্তা বা শক্তিতে পরিণত হইবে না কি? অবয়ব আছে বলিয়াই পদার্থের সংখ্যা আছে, নিরবয়ব বা নিরাকারের সংখ্যা আছে কি? আর সংখ্যা না থাকিলে তাহার স্বাতন্ত্র্য থাকে কি? পক্ষান্তরে প্রাণ যদি সরূপ বা সাকার হয়, তবে তাহার রূপ কি?”

এখানে মাতুব্বর একটি শিশুসুলভ প্রশ্ন করেছেন। তাঁর প্রশ্নটি হলো, প্রাণের কি আকার আছে, না নেই? যদি আকার থাকে, তাহলে প্রাণ দেখতে কেমন?

বিজ্ঞান সম্পর্কে যাদের সামান্যতম জ্ঞান আছে, তারাও জানেন যে, পৃথিবীতে দুই ধরণের বস্তু আছে। এক ধরণের বস্তুকে আমরা খালি চোখে দেখতে পাই, অথবা শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারা বুঝতে পারি। কিন্তু আরেক ধরণের বস্তুকে খালি চোখে তো দূরে থাক, শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারাও দেখা সম্ভব না। এ ধরণের বস্তুকে বলা হয় ‘ডার্ক ম্যাটার’। ‘ডার্ক ম্যাটার’ মানে অদৃশ্য বস্তু; এর আকার বা আকৃতি কেউ জানে না, কিন্তু বস্তু হিসাবে এগুলোকে স্বীকার করতে হয়।

নাসা বিজ্ঞানীদের মতে, বিশ্বজগতে আমরা আমরা যা কিছু দেখতে পারি, অথবা অনুমান করতে পারি, তার পরিমাণ হলো ৪.৯%। এর বাইরে, বিশ্বজগতের ২৬.৮% বস্তু এবং ৬৮.৩% শক্তি হলো অদৃশ্য। অর্থাৎ, ৯৫.১% অদৃশ্য বস্তু ও শক্তির দ্বারা আমাদের এ বিশ্বজগত পরিচালিত হচ্ছে।

অর্থাৎ, আকার এবং নিরাকারের সমন্বয়ে আমাদের এই বিশ্বজগত পরিচালিত হয়। সমস্ত বিশ্বজগতের ৪.৯%-কে অনুমান করা যায়; এরা কখনো দৃশ্য হয়, কখনো এদের আকার থাকে, অথবা কখনো এদেরকে সংখ্যা দ্বারা নির্ণয় করা যায়। কিন্তু ৯৫.১% হলো অদৃশ্য বস্তু ও শক্তি; এদের আকার নির্ণয় করা যায় না, অথবা এদেরকে সংখ্যা দ্বারাও গণনা করা যায় না।

আমরা মানুষ জাতি এই বিশ্বজগতের-ই একটি অংশ। উপরের হিসাব অনুযায়ী, আমাদের দৃশ্যমান শরীর যদি ৪.৯% হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের অদৃশ্য আত্মা হবে ৯৫.১%।

আরজ আলী মাতুব্বর বিজ্ঞান জানতেন না বলেই, উপরোক্ত হিসাবটি মিলাতে পারেননি। ফলে একটি শিশুসুলভ প্রশ্ন করে বসেছেন। কিন্তু বিজ্ঞান যখন বিশ্বজগতের হিসাব মিলাতে যায়, তখন তাঁদেরকে অনেক অদৃশ্য বস্তু ও অদৃশ্য শক্তিকে স্বীকার করে নিতে হয়। তেমনি আমরা যখন মানব জীবনের হিসাব মিলাতে যাই, তখন আমাদেরকেও একটি অদৃশ্য আত্মাকে স্বীকার করে নিতে হয়।

*******************

“সাধারণত আমরা জানি যে, মন ও প্রাণ এক নহে। কেননা উহাদের চরিত্রগত পার্থক্য বিদ্যমান। আমরা আমাদের নিজেদের উপলব্ধি হইতে জানিতে পাইতেছি যে, “মন” প্রাণের উপর নির্ভরশীল কিন্তু “প্রাণ” মনের উপর নির্ভরশীল নয়। মন নিষ্ক্রিয় থাকিলেও প্রাণের অভাব পরিলক্ষিত হয় না। কিন্তু প্রাণ নিষ্ক্রিয় হইলে মনের অস্তিত্বই থাকে না। যেমন ক্লোরোফরম প্রয়োগে মানুষের সংজ্ঞা লোপ ঘটে, অথচ দেহে প্রাণ থাকে, শ্বাসক্রিয়া, হৃৎক্রিয়া এমন কি পরিপাক ক্রিয়াও চলিতে থাকে। অথচ তখন আর মনের কোন ক্রিয়াই প্রকাশ পায় না। গভীর সুনিদ্রাকালেও কোন সংজ্ঞা থাকে না, ইহা হইতে স্পষ্টই বুঝা যায় যে, প্রাণবিহীন মন থাকিতেই পারে না, কিন্তু মন বা সংজ্ঞাহীন প্রাণ অনেক সময়ই পাওয়া যায়। ইহাতে অনুমতি হয় যে, মন আর প্রাণ এক নহে। ইহাও অনুমতি হয় যে, সংজ্ঞা চেতনা বা সুখ-দুঃখের অনুভূতি মনেরই, প্রাণের নয়। প্রাণ রাগ, শোক, ভোগ ও বিলাসমুক্ত। এক কথায় প্রাণ চির নির্বিকার।

জীবের জীবন নাকি যমদূত (আজরাইল) হরণ করেন। কিন্তু তিনি কি প্রাণের সহিত মনকেও হরণ করেন? অথবা প্রাণ যেখানে যে অবস্থায় থাকুক না কেন, মনকে তৎসঙ্গে থাকিতেই হইবে, এরূপ কোন প্রমাণ আছে কি? নতুবা মনবিহীন প্রাণ পরকালের সুখ-দুঃখ ভোগ করিবে কিরূপে?”

উপরের লিখাটি সেক্যুলারদের গুরু আরজ আলী মাতুব্বরের। তিনি এখানে দুটি কথা বলেছেন। ১, মন ও প্রাণ দুটি পরস্পর ভিন্ন। ২, “মন” প্রাণের উপর নির্ভরশীল কিন্তু “প্রাণ” মনের উপর নির্ভরশীল নয়। অর্থাৎ, মনের অনুপস্থিতিতে প্রাণের অস্তিত্ব থাকে, কিন্তু প্রাণের অনুপস্থিতিতে মনের অস্তিত্ব থাকে না।

মাতুব্বরের প্রথম কথাটির সাথে আমি একমত। অর্থাৎ, মন ও প্রাণ দুটি ভিন্ন জিনিস। কিন্তু, মাতুব্বরের দ্বিতীয় কথাটি বৈজ্ঞানিকভাবে সম্পূর্ণ ভুল।

মন ও প্রাণ দুটি পরস্পর স্বতন্ত্র ও ভিন্ন জিনিস। প্রাণ সৃষ্টি হয় পানি থেকে, কিন্তু মন সৃষ্টি হয় মানুষের বিভিন্ন কাজের উপর ভিত্তি করে। মানুষ যখন ঘুমায়, তখন তার মনের অস্তিত্ব অনুভব করা না গেলেও, প্রাণের অস্তিত্ব অনুভব করা যায়। আবার, মানুষ যখন হার্ট অ্যাটাক করে, তখন তার প্রাণের অস্তিত্ব অনুভব করা না গেলেও, সে নিজে তার মনের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারে। অর্থাৎ, মানুষের মন তার প্রাণের উপর নির্ভরশীল নয়। প্রাণের অনুপস্থিতিতেও মানুষের মন ও স্মৃতি শক্তি আগের অবস্থায় থাকে।

বর্তমানে বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কারের ফলে, সেক্যুলারদের গুরু মাতুব্বরের কথাগুলোকে এখন অবান্তর মনে হয়। উদাহরণ স্বরূপ বিজ্ঞানী Jeffrey Long এর “Evidence of the afterlife” বইটির কথা উল্লেখ করা যাক। এ বইটি লেখার আগে তিনি একটি গবেষণা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন, যার নাম – “Near death experiences research foundation”। সংগঠনটির ওয়েব সাইট হলো – http://www.nderf.org। এ সংগঠনটির যাবতীয় বৈজ্ঞানিক রিসার্চ প্রমাণ করে যে মাতুব্বরের কথাগুলো সম্পূর্ণ অবান্তর।

সংগঠনটি প্রায় ২৫ বছর থেকে ‘মৃত্যু পরবর্তী জীবন’ নিয়ে গবেষণা করছে। প্রথমে আসুন, তাদের গবেষণার পদ্ধতিটা একটু বলি।

কোনো মানুষ এক্সিডেন্ট হলে বা হার্ট অ্যাটাক করলে, ঐ মানুষটির হার্ট ও ব্রেইন উভয়টি যখন নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, তখন ডাক্তারগণ তাকে বলে ‘ক্লিনিক্যাল ডেথ’। অর্থাৎ, ডাক্তারগণ তখন ঐ মানুষটিকে মৃত বলে ঘোষণা করে। কিন্তু, আল্লাহর ইচ্ছায় এরপরও কিছু কিছু মানুষ তাদের নতুন জীবন ফিরে পায়।
যেসব মানুষ এভাবে মৃত্যুর একেবারে নিকটে গিয়ে আবার জীবন ফিরে পায়, তাদের নিয়েই উপরোক্ত সংগঠনটি গবেষণা করে। বিশ্বের যেখানে যেখানে ‘ক্লিনিক্যাল ডেথ’ মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়, সেসব জায়গা থেকে তারা তথ্য সংগ্রহ করে। এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের অভিজ্ঞতা তারা তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। এসব তথ্যগুলোকে বিভিন্নভাবে গবেষণা করে ডাক্তার জাফরি লং একটি বই লিখেছেন, যার নাম – ‘পরকালের প্রমাণ’ বা ‘Evidence of the afterlife’।
গবেষণাটির মূল পয়েন্টগুলো হলো –

১। মানুষ তার শরীরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। মানুষ যখন ক্লিনিক্যাল ডেথ হয়ে যায়, তখন তার হার্ট ও ব্রেইন সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলেও, সে সবকিছু দেখতে পারে ও বুঝতে পারে। অর্থাৎ, মানুষের প্রাণ নিষ্ক্রিয় হলেও, তার মন তখন সক্রিয় থাকে।

২। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের এবং বিভিন্ন বয়সের মানুষের ‘ক্লিনিক্যাল ডেথ’ এর অভিজ্ঞতাগুলো সবার ক্ষেত্রে প্রায় একই হয়ে থাকে।

৩। ‘ক্লিনিক্যাল ডেথ’ এর সময়ে মানুষ যেসব অভিজ্ঞতা অর্জন করে, তা স্বপ্ন দেখার মত নয়। আশেপাশের মানুষগুলো তখন কে কি কথা বলছে এবং কে কি করছে, সবকিছু তারা বাস্তবিকভাবে দেখতে ও শুনতে পায়। পরবর্তীতে তারা ঐসব ঘটনা হুবহু বর্ণনা করতে পারে।

৪। ‘ক্লিনিক্যাল ডেথ’ এর সময়ে মানুষ বিশ্ব অস্তিত্বের সাথে এক হয়ে যায়। ফলে বাধাহীনভাবে সর্বত্র চলাফেরা করার একটি অবস্থা সৃষ্টি হয়। কখনো কখনো তারা ইচ্ছা করে শরীরে ফিরে আসে, আবার কখনো কখনো অনিচ্ছাকৃতভাবে তাদেরকে শরীরে ফিরে আসতে হয়।

৫। এ সময়ে তারা একটি আলো দেখতে পারে এবং জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ জীবনটাকে একসাথে দেখতে পারে।

উপরোক্ত গবেষণাটি প্রমাণ করে যে, মানুষের মন যেমন প্রাণের উপর নির্ভরশীল নয়, তেমনি মানুষের প্রাণও মনের উপর নির্ভরশীল নয়। মানুষ মরে গেলেও তার মন ও স্মরণ শক্তি ঠিকই থেকে যায়।

এ তো গেলো একজন ডাক্তারের রিসার্চ নিয়ে কথা বললাম। কিন্তু মৃত্যু পরবর্তী জীবন নিয়ে এখন অনেক বিজ্ঞানী ও ডাক্তার-ই গবেষণা করছেন। তাদের মধ্যে কয়েক জন হলেন – Dr. Sam Parnia, Dr. Jeffrey Long, Dr. Mary Neal, Dr. Kevin Nelson, Dr. Peter Fenwick, Dr. Mario Beauregard

উপরোক্ত ডাক্তার ও বিজ্ঞানীদের কথা শুনলে আপনার কাছে সহজেই মনে হবে যে, আমরা বাঙালিরা পড়াশুনা করি না বলেই আরজ আলী মাতুব্বরের মত একজন মানুষকে আমরা ‘দার্শনিক’ ভেবে বসে আছি।

এ নিয়ে যারা বিস্তারিত জানতে আগ্রহী, অথবা যারা আরজ আলীর মত আখিরাতকে বিশ্বাস করেন না, তাদের জন্যে কমেন্টে কিছু পিয়ার রিভিউড জার্নাল, স্কলারলি জার্নাল, এবং ভিডিও শেয়ার করছি। দেখুন এবং আরজ আলী মাতুব্বরের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নিন।

*******************

আত্মা সম্পর্কে আরজ আলী মাতুব্বরের চতুর্থ প্রশ্নটি হলো –

“প্রাণের সহিত দেহ ও মনের সম্পর্ক কি? দেহ জড় পদার্থ। কোন জীবের দেহ বিশ্লেষণ করিলে কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, লৌহ,ফসফরাস ইত্যাদি নানা প্রকার মৌলিক পদার্থের বিভিন্ন অনুপাতে অপূর্ব সংমিশ্রণ দেখা যায়। পদার্থসমূহ নিষ্প্রাণ। কাজেই পদার্থসমূহের যথানুপাতে সংমিশ্রিত অবস্থাকেই প্রাণ বলা যায় না। পদার্থ সমূহের যথানুপাতে সংমিশ্রণ এবং আরও কিছুর ফলে দেহে প্রাণচাঞ্চল্য দেখা যায়। ঐ “আরও কিছু” কে আমরা মন বলিয়া থাকি। কিন্তু মানুষের দেহ, মন ও প্রাণে কিছু সম্পর্ক বা বন্ধন আছে কি? থাকিলে তাহা কিরূপ? আর না থাকিলেই বা উহারা একত্র থাকে কেন?”

এখানে দেহ, মন, প্রাণ ও আত্মা সবকিছুকে একসাথে জট বাঁধিয়ে ফেলেছেন আরজ আলী মাতুব্বর। মন ও আত্মার আলোচনা ভিন্ন। আমরা সে আলোচনা অন্যদিন করব, ইনশাল্লাহ। আজকে এখানে কেবল দেহ ও প্রাণের সম্পর্কটি বোঝার চেষ্টা করব।

প্রথমত দেখুন, তিনি বলেছেন যে, “দেহ জড় পদার্থ”। কিন্তু, একজন নবম শ্রেণীর ছাত্রও জানে, আমাদের দেহ গঠিত হয় অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোষের মাধ্যমে। প্রতিটি কোষের নিজস্ব ও স্বতন্ত্র একটি জীবন প্রক্রিয়া আছে। প্রতিটি কোষের-ই প্রাণ আছে। শরীরের কিছু কোষ নতুন করে জন্মগ্রহণ করে, আবার কিছু কোষ মারা যায়। সারা জীবন-ই মানুষের শরীরের মধ্যে এ প্রক্রিয়াটি চলতে থাকে। মানুষের শরীরের প্রতিটি কোষ-ই আলাদা আলাদাভাবে প্রাণযুক্ত ও জীবন্ত।

তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, মানুষের কোষগুলোকে ভাগ করলে বিভিন্ন কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, লৌহ, ফসফরাস ইত্যাদি পাওয়া যায়। কিন্তু, মাতুব্বর সাহেব এটা জানতেন না যে, পদার্থের পরমাণু কখনো স্থির থাকে না, এবং পরমাণু কখনো জড় বস্তুর মতো আচরণ করে না। আমরা জানি যে, প্রতিটি পরমাণুর তিনটি মৌলিক কণিকা থাকে। এরা হচ্ছে ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রন। এ তিনটি কণিকা বিভিন্ন সংখ্যায় একত্রিত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন পরমাণু গঠন করে। প্রোটন এবং নিউট্রন একত্রিত হয়ে নিউক্লিয়াস গঠন করে আর এদেরকে ঘিরে ইলেকট্রন সার্বক্ষণিক ঘুরতে থাকে। সুতরাং, মানুষের শরীরের কোষগুলো ভেঙ্গে যখন পরমাণুতে পরিণত হয়, তখনো কিন্তু তাকে জড় বস্তু হিসাবে বিবেচনা করা যায় না। কিন্তু, আরজ আলী বললেন, মানুষের দেহ নাকি জড় পদার্থ।

আরজ আলীর এসব ভ্রান্তি থেকে মুক্ত হবার জন্যে আমাদেরকে প্রথমে বুঝতে হবে, প্রাণ ও জড়বস্তুর মাঝে পার্থক্য কি এবং সম্পর্ক কি?

সহজ একটি উদাহরণ কল্পনা করুন। পানি হলো একটি জড় বস্তু। কিন্তু পানির অপর নাম জীবন বা প্রাণ। মানুষ পানি পান করতে পারলে প্রাণ সচল থাকে, কিন্তু পানি পান করতে না পারলে মানুষ মারা যায়। তাহলে এখনে ঘটনাটি কি ঘটলো? পনির মত একটি জড় বস্তু মানুষের প্রাণ ফিরে পেতে সাহায্য করলো। এটি আল্লাহর ইচ্ছায় হয়ে থাকে।

এবার, একটি আপেল কল্পনা করুন। এটি একটি জড়বস্তু। কিন্তু আপনি যখন এ আপেলটি খাবেন, সাথে সাথে আপনার শরীরের কোষগুলো কাজ করতে শুরু করবে, এবং আপনার মধ্যে প্রাণের সঞ্চারণ হবে। এখানে, আপেলের মত একটি জড় বস্তু আপনার প্রাণকে শক্তি প্রদান করলো।

আমরা আমাদের প্রাণকে অনুভব করার জন্যে যা কিছু গ্রহণ করি বা যা কিছু বর্জন করি, সবই জড়বস্তু। অর্থাৎ, পৃথিবীর প্রতিটি বস্তুই একইসাথে জীবিত ও মৃত। কখনো একটি বস্তুকে আমাদের কাছে মৃত অনুভব হয়, আবার কখনো সেই একই বস্তুকে আমাদের কাছে জীবিত অনুভব হয়।

আমরা যেসব বস্তুর নড়াচড়া ও বার্ধক্য অনুভব করতে পারি, তাঁদেরকে বলি প্রাণী, আর যেসব বস্তুর নড়াচড়া ও বার্ধক্য অনুভব করতে পারি না, তাঁদেরকে বলি জড়পদার্থ। কিন্তু, প্রতিটি জড় পদার্থের মধ্যেই প্রাণ লুকিয়ে থাকে।

আল্লাহ তায়ালা জড়বস্তু থেকে প্রাণের সৃষ্টি করেন, আবার, প্রাণ থেকে জড় বস্তু সৃষ্টি করেন। কোর’আনে বলা হচ্ছে –

إِنَّ ٱللَّهَ فَالِقُ ٱلْحَبِّ وَٱلنَّوَىٰ ۖ يُخْرِجُ ٱلْحَىَّ مِنَ ٱلْمَيِّتِ وَمُخْرِجُ ٱلْمَيِّتِ مِنَ ٱلْحَىِّ ۚ ذَ‌ٰلِكُمُ ٱللَّهُ ۖ فَأَنَّىٰ تُؤْفَكُونَ

“নিশ্চয় আল্লাহই বীজ ও আঁটি থেকে অঙ্কুর সৃষ্টিকারী। তিনি জড় থেকে প্রাণ বের করেন, এবং প্রাণ থেকে জড় বের করেন। তিনি আল্লাহ, অতঃপর তোমরা কোথায় বিভ্রান্ত হচ্ছ?” [সূরা ৬ / আন’আম – ৯৫]

অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন –

أَوَلَمْ يَرَ ٱلَّذِينَ كَفَرُوٓا۟ أَنَّ ٱلسَّمَـٰوَ‌تِ وَٱلْأَرْضَ كَانَتَا رَتْقًۭا فَفَتَقْنَـٰهُمَا ۖ وَجَعَلْنَا مِنَ ٱلْمَآءِ كُلَّ شَىْءٍ حَىٍّ ۖ أَفَلَا يُؤْمِنُونَ

“কাফেররা কি ভেবে দেখে না যে, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিল, অতঃপর আমি উভয়কে পৃথক করে দিলাম। আমি প্রাণবান সবকিছুকে পানি থেকে সৃষ্টি করলাম। এরপরও কি তারা বিশ্বাস স্থাপন করবে না?” [সূরা ২১/ আম্বিয়া – ৩০]

কোর’আনের এ দুটি আয়াত থেকে আমরা এমন একটি সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, বিশ্বজগতের প্রতিটি ক্ষুদ্র কণিকার মধ্যে একটি নির্দিষ্ট প্রাণ আছে, এবং প্রতিটি ক্ষুদ্র কণিকার একটি নির্দিষ্ট আকৃতি আছে। কিছু বস্তুর প্রাণ আমরা অনুভব করতে পারি, এবং কিছু বস্তুর প্রাণ আমরা অনুভব করতে পারি না। একইভাবে, কিছু বস্তুর আকৃতি আমরা দেখতে পাই, এবং কিছু বস্তুর আকৃতি আমরা দেখতে পাইনা।

দেহ ও প্রাণ একটির সাথে অপরটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমরা দেহ দেখতে পাই, কিন্তু প্রাণ দেখতে পাই না। দেহের আকৃতি আমরা নির্ণয় করতে পারি, কিন্তু প্রাণের আকৃতি নির্ণয় করতে পারি না।

অর্থাৎ, যে কোনো বস্তুর ক্ষুদ্র কণিকার সাথেই তার প্রাণ থাকে। কিন্তু আমরা কখনো সেই প্রাণকে অনুভব করতে পারি, আবার কখনো পারি না। মানুষ যখন মারা যায়, তখন তার প্রাণ তার সাথেই থাকে, কিন্তু আমরা মৃত ব্যক্তির প্রাণকে অনুভব করতে পারি না। যেমন, একটি টেবিলের পরমাণুর ঘূর্ণায়নকে আমরা অনুভব করতে পারি না।

আরজ আলী মাতুব্বর উপরোক্ত কোর’আনের দুটি আয়াত বুঝতে পারলে, দেহ ও প্রাণ নিয়ে তার মাঝে কোনো ভ্রান্তি সৃষ্টি হতো না।

আরো পোস্ট

একটি মন্তব্য লিখুন

আপনার ইমেইল অ্যাড্রেস প্রকাশ করা হবে না। তারকা (*) চিহ্নিত ঘরগুলো পূরণ করা আবশ্যক