আয়া সোফিয়ার মসজিদে প্রত্যাবর্তন
বাংলাদেশ থেকে তুরস্কে পড়াশোনা করতে আসার পর প্রথমেই যা দেখতে চেয়েছিলাম, তা হলো আয়া সোফিয়া। কিন্তু আমার বিশ্ববিদ্যালয় আয়া সোফিয়ার শহরে অর্থাৎ ইস্তানবুলে ছিল না। আমার বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ইস্তানবুলের পাশে বুরসা শহরে। ফলে আয়া সোফিয়া আর দেখা হলো না আমার। কয়েক মাস পর একদিন এক তুর্কি বন্ধু বললেন, ‘আমরা আগামীকাল ফজরের নামাজ পড়ব আয়া সোফিয়ার প্রাঙ্গণে, তুমি চাইলে আমাদের সঙ্গে যেতে পার। আমরা রাতে রওনা হব, সেখানে গিয়ে ফজরের নামাজ পড়ে আবার ফিরে আসব।’ তুর্কি বন্ধুর কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলাম এবং আয়া সোফিয়ায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলাম।
ফজরের নামাজের প্রায় এক ঘণ্টা আগে গিয়ে আমরা আয়া সোফিয়ায় পৌঁছলাম। সেখানে গিয়ে আমি অবাক, তুরস্কের নানা প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ এসেছে আয়া সোফিয়ার সামনে ফজরের নামাজ পড়ার জন্য। আয়া সোফিয়ার ভেতরে নামাজ পড়ার অনুমতি যেহেতু ছিল না, তাই সামনে বিশাল মাঠে আমরা নামাজ পড়লাম। মক্কা থেকে একজন ইমাম এসে নামাজ পড়ালেন। নামাজ শেষে সবাই আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন আয়া সোফিয়া খুলে দেওয়ার শক্তি অর্জনের জন্য। এভাবে প্রতি বছর তুরস্কের হাজার হাজার মানুষ কয়েকবার করে আয়া সোফিয়ার সামনে এসে ফজরের নামাজ পড়ে যান এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করে যান। আল্লাহ তুরস্কের মানুষের দীর্ঘদিনের দোয়া কবুল করলেন। আয়া সোফিয়ার ভেতরে নামাজ পড়ার মতো শক্তি আল্লাহ তুরস্কের মানুষকে দান করলেন।
১০ জুলাই ২০২০ সালে তুরস্কের শীর্ষ প্রশাসনিক আদালত থেকে রায় এলো মুসলিমদের পক্ষে। ৮৬ বছর পর আবার মুসলিমরা আয়া সোফিয়ায় নামাজ পড়ার অধিকার ফিরে পেলেন। ১৪৫৩ সালের ২৯ মে ইস্তানবুল বিজয় করে আয়া সোফিয়ার স্থাপনাটি খ্রিস্টানদের কাছ থেকে নিজের পকেটের টাকা দিয়ে কিনে নেন সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মাদ। এরপর প্রায় ৭০০ বছর মসজিদ হিসেবে থাকা আয়া সোফিয়াকে ১৯৩৪ সালে জাদুঘরে রূপান্তরের ঘোষণা দেয় তুরস্কের তৎকালীন সেক্যুলার সরকার। যে স্থানে হাজার হাজার বছর ইবাদাত করেন খ্রিস্টান ও মুসলিমরা, সে স্থানে যে কোনো ধরনের ইবাদতকে নিষিদ্ধ করা হলো। এই জুলুমের বিরুদ্ধে তুরস্কের ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা লড়ে এসেছেন প্রায় ৮৫ বছর। অবশেষে অদালতের রায়ের মাধ্যমে ধার্মিক মানুষ তাদের অধিকার ফিরে পেলেন। দীর্ঘদিন ধরে চলমান থাকা মামলার রায়ে আয়া সোফিয়াকে মিউজিয়ামে রূপান্তর সংক্রান্ত আইনকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর করতে আইনগত কোনো বাধা থাকল না।
বাংলাদেশের কেউ কেউ আয়া সোফিয়ার সঙ্গে বাবরি মসজিদের বা আল-আকসার বা স্পেনের মসজিদগুলোরও তুলনা করেন। তাদের মতে, আয়া সোফিয়া যদি গির্জা থেকে মসজিদ হতে পারে, তাহলে বাবরি মসজিদটা মন্দির হতে সমস্যা কি? প্রথম কথা হলো, আয়া সোফিয়াকে সুলতান ফাতিহ মেহমেত জোর করে নয়, বরং কিনে নিয়েছেন। এটা সুলতানের নিজের ফাউন্ডেশনের সম্পদ। অন্যদিকে বাবরি মসজিদ বা অন্য যে মসজিদগুলো মন্দির বা গির্জা হয়েছে, তা কিনে নেওয়া হয়নি।
দ্বিতীয় কথা হলো, সুলতান ফাতিহ মেহমেত অমুসলিমদের ইবাদাতের স্বাধীনতাকে খুব ভালোভাবে রক্ষা করেছেন। সুলতান মেহমেত ইস্তানবুুল বিজয় করার পর খ্রিস্টানদের সঙ্গে একটি চুক্তি করেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ইস্তানবুল বিজয়ের আগে যেভাবে খ্রিষ্টানদের ইবাদাত ও সংস্কৃতি পালন করার স্বাধীনতা ছিল, ইস্তানবুল বিজয়ের পরও ঠিক একইভাবে খ্রিষ্টানদের পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করা হবে। কেউ ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। যারা অমুসলিমদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করত, তাদের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নেওয়া হতো।
তৃতীয় কথা হলো, তুরস্কের আদালত কোনো গির্জাকে মসজিদ করেনি, তারা একটি জাদুঘরকে মসজিদ করেছেন। ফলে বাবরি মসজিদের যুক্তি এখানে খাটে না। এ ছাড়া তুরস্কের প্রেসিডেন্ট তার আয়া সোফিয়া সম্পর্কিত বক্তব্যে স্পষ্ট বলেছেন, ‘আমাদের সারাদেশে মসজিদের পাশাপাশি হাজার হাজার বছরের ঐতিহাসিক অনেক গির্জা রয়েছে। বর্তমানে ৪৩৫টি গির্জা ও উপাসনালয় রয়েছে, যা আমাদের আশপাশের অন্য অঞ্চলে দেখা যায় না। এটাই আমাদের সঙ্গে তাদের পার্থক্য।’ এরদোয়ান আরও বলেন, ‘আয়া সোফিয়ার দরজা সব দেশি ও বিদেশি, মুসলিম ও অমুসলিমের জন্য খোলা থাকবে। আয়া সোফিয়া সব মানুষের সম্পদ। আয়া সোফিয়ার বর্তমান অবস্থায় এটি সব মানুষকে আগের চেয়ে বেশি ভালোবাসা নিয়ে আলিঙ্গন করবে।’
কেউ কেউ মনে করেন, তুরস্কের ফাতিহ সুলতান মেহমেত খ্রিষ্টানদের গির্জা ‘আয়া সোফিয়া’ জোর করে কিনে নিয়ে মসজিদ বানিয়ে খ্রিষ্টানদের ওপর জুলুম করেছেন। এখানে আসলে কোনো জুলুম হয়নি, খ্রিষ্টানরা স্বেচ্ছায় বিক্রি করেছিলেন। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, সুলতান মুহাম্মদ আসলে প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা একটি রাজনৈতিক নিয়ম মেনেছেন। রাসুল (সা.) এর আগ থেকেই শহরের প্রধান উপাসনালয়ে যাবতীয় রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালিত হতো। কেউ যখন কোনো ভূখণ্ড জয়লাভ করত, তখন সে ভূখণ্ডের সবচেয়ে বড় যে উপাসনালয়ে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা হতো, তা নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নিত। বাকি উপাসনালয়ে যে যার মতো ইবাদত করতে পারত। যেমন- ইহুদিদের দ্বিতীয় বৃহত্তম উপাসনালয় ছিল সিরিয়ায়। খ্রিষ্টানরা যখন সিরিয়া জয় করে, তখন ইহুদিদের সেই উপাসনালয়কে খ্রিস্টানদের রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সেটাকে গির্জায় রূপান্তরিত করেছে। এরপর মুসলিমরা সিরিয়া জয় করার পর একই কারণে ওই গির্জাকে মসজিদে পরিণত করেছে। এখন তার নাম ঞযব গড়ংয়ঁব ড়ভ ঔড়ন। এ ছাড়া, সিরিয়ার সবচেয়ে বড় উমাইয়া মসজিদও একইভাবে সৃষ্টি হয়েছে।
ইয়াহইয়া (আ.) নির্মিত খ্রিষ্টানদের একটি গির্জার সঙ্গেই এই মসজিদটি ৭০৬ সালে নির্মাণ করেন ষষ্ঠ উমাইয়া খলিফা আল ওয়ালিদ। পরে সে গির্জাটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। একই ধারাবাহিকতায় ১৪৫৩ সালে ফাতিহ সুলতান মুহাম্মাদ ইস্তানবুল জয় করার পর খ্রিষ্টানদের রাজনৈতিক ভবন আয়া সোফিয়াকে মুসলিমদের রাজনৈতিক ভবনে পরিণত করেন। এ ছাড়া ইস্তানবুলের সব গির্জার চাবি খ্রিষ্টানরা সুলতানের কাছে পাঠানোর পরও তিনি সেসব চাবি আবার খ্রিষ্টানদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। মুসলিমদের থেকে অমুসলিমরা গ্রিস দখল করার পর, গ্রিসের সব মসজিদ ভেঙে ফেলা হয় এবং এখন পর্যন্ত গ্রিসে উল্লেখযোগ্য কোনো মসজিদ নেই। কিন্তু মুসলিমরা কখনও কোনো গির্জা ভাঙেনি। তারা শহরের প্রধান গির্জা বা রাজনৈতিক কেন্দ্রটি শুধু অধিকারে নিয়েছে। এটি একটি রাজনৈতিক অধিকারও বটে। তাই আসলে সুলতান ফাতিহ কোনো জুলুম করেননি, বরং অন্য শাসকদের চেয়ে বেশি দয়াবান ছিলেন খ্রিষ্টানদের ওপর।
যাই হোক, দেরিতে হলেও তুরস্কের মুসলিমরা তাদের দীর্ঘদিনের সম্পদ আয়া সোফিয়াকে অবৈধ দখলমুক্ত করতে পেরেছে। এ আনন্দে ভাসছে তুরস্কের ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা ও আমাদের মত তুরস্কে থাকা বিদেশিরাও। এমনকি সারা বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে হতাশার সময় এটি একটি বিশাল সুসংবাদ হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছে।
https://www.alokitobangladesh.com/print-edition/islamosomaj/3786/%E0%A6%87%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%B6%E0%A7%8B%E0%A6%A7-%E0%A6%93-%E0%A6%AE%E0%A7%8B%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%86%E0%A6%A8%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6?fbclid=IwAR2SuuV6os2MOgf8l5_tC_KrKyJw0_x0PE7BD961KjAOmA3bKZ8vTdmSW7g