‘ধর্ম আমার মানবতাবাদ’
বাংলাদেশী কবি-সাহিত্যিকদের অনেকেই একটি কমন কথা বলেন- ‘আমি হিন্দুও না, মুসলিমও না; আমি মানুষ। ধর্ম আমার মানবতাবাদ।’—আপাতদৃষ্টিতে কথাটি খুব চমৎকার। কিন্তু ভ্রান্তিপূর্ণ।
কারণ,
মানুষ ছাড়াও পৃথিবীতে অসংখ্য প্রাণী আছে। তরু-লতা, গাছ-পালা, পশু-পাখি, আরও…; যা কিছু পৃথিবীতে বাস করে আমরা তাদের বলি- ‘পৃথিবীর অধিবাসী’।
পৃথিবীর অধিবাসীদের বিভিন্ন ভাগে ভাগ করলে উন্নত জাতের যে প্রাণী পাওয়া যায় তার নাম মানুষ। আবার মানুষের মাঝে বিভিন্ন ক্যাটাগরি করলে উন্নত ব্যক্তিত্ব ও দায়িত্বসম্পূর্ণ যে মানুষ পাওয়া যায়, তাঁরা হলেন ধার্মিক : হোক হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান।
এখন কেউ যদি বলেন : ‘আমি হিন্দু বা মুসলিম নই, আমি মানুষ’; তার মানে তিনি একস্তর নিচে চলে গেলেন। আবার কেউ যদি বলেন : ‘আমি মানুষ নই, গরু-ছাগলের মত পৃথিবীর অধিবাসী’; তাহলে তিনি আরেকস্তর নিচে নেমে গেলেন। এভাবে ক্রমান্বয়ে যার যত ইচ্ছা নিচু স্তরে নেমে যাওয়াতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু বিপদ হলো যখন কেউ সব স্তরকে এক করে ফেলে।
প্রাণ আছে বলেই পশু ও মানুষের স্বভাব-আচরণ-মর্যাদা যেমন এক নয়; কথা বলতে পারে বলেই একজন মানুষ ও ধার্মিকের দায়িত্ব-যোগ্যতা-মর্যাদা এক নয়।
উদাহরণ এক।
সরকারি চাকরি যারা করেন তাদের সকলকে বলা হয়- সরকারি লোক। এদের মধ্যে দায়িত্ব ও যোগ্যতায় যারা নিচে থাকেন তারা পুলিশ; যারা উপরে থাকেন তারা সচিব।
পুলিশ, সচিব, এমপি, মন্ত্রী, স্পিকার, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী—সবাই সরকারি লোক; কিন্তু সবার মর্যাদা, সম্মান ও দায়িত্ব এক নয়। যিনি যত উপরস্তরের, তার দায়িত্ব যেমন বেশি, সম্মানও বেশি।
এখন কেউ যদি সচিবের চাকরি ছেড়ে পুলিশের চাকরি নেন, তাতে দোষের কিছু নেই; যার ইচ্ছা তিনি নিচুস্তরে নামতে পারেন। কিন্তু যখন কেউ বলে, সব সচিবকে চাকরি ছেড়ে পুলিশের স্তরে নেমে যেতে হবে—তখন মহাবিপদ ঘটে। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা সে-বিপদের পথেই সবাইকে ডাকেন। মুসলিম, বৌদ্ধ, হিন্দু বা খ্রিস্টান—সবাইকে বলেন, তোমাদেরকে মানুষ হয়ে যেতে হবে।
উদাহরণ দুই।
সরদার ফজলুল করিম তার বইয়ে লিখেছেন, মগবাজারের এক দোকানী একবার তাকে জিজ্ঞেস করল : চাচা আপনি কি হিন্দু? তিনি বললেন : ‘আমি মানুষ’। দোকানী আবার প্রশ্ন করল : আপনি চাচা মুসলমান? তিনি বললেন : ‘আমি মানুষ’। আরজ আলী মাতুব্বরকে কেউকেউ প্রশ্ন করতেন, আপনি কোন ধর্মের মানুষ? তিনি বলতেন – মানবতাবাদ।
দেখুন, সরদার ফজলুল করিমকে যদি ভিন্নভাবে জিজ্ঞেস করা হয় : চাচা আপনি কি বাংলাদেশি না পাকিস্তানি? তখন তিনি কি বলবেন – ‘না, আমি মানুষ’। কিংবা আরজ আলী মাতুব্বরকে যদি প্রশ্ন করেন, আপনি কোন দেশের মানুষ? তখন তিনি কি বলতেন – ‘মানবতাবাদ’। নিশ্চয়ই না।
দেশের পরিচয় দেয়ার ক্ষেত্রে তারা কেনো ‘মানুষ’ নামের সাইনবোর্ডটা সামনে আনেন না? কারণ একটাই। মানুষ-পরিচয়ের সাথে দেশ-পরিচয়ের কোনো বিরোধ নেই। সবাই মানুষ; কিন্তু দেশের পরিচয় ভিন্ন-ভিন্ন থাকতে পারে।
আমাদের কথাও ঠিক এমন। হিন্দু, মুসলিম বা খ্রিস্টান—সবাই মানুষ। কিন্তু মানুষের স্তর অতিক্রম করে যখন কেউ আরও উন্নত ও পরিশুদ্ধ স্তরে পোঁছেন, তখন তাঁর পরিচয় হয় – মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান। এর মধ্যে বিভক্তি নেই; আছে দায়িত্ব ও যোগ্যতার স্তরবিন্যাস।
পশুর কাজ কেবল খেয়ে বেঁচে থাকা; মানুষের কাজ তা নয়। মানুষের দায়িত্ব কেবল নিজেকে রক্ষা করা; কিন্তু ধার্মিকের দায়িত্ব বিশ্বজগতকে রক্ষা করা। পৃথিবীর সব অধিবাসী অর্থাৎ পশু, মানুষ ও ধার্মিক সকলের দায়িত্ব-যোগ্যতা-মর্যাদা এক নয়।
হিন্দু বা মুসলিম মাত্রই মানুষ। কিন্তু মানুষ মাত্রই ধার্মিকতার স্তরে উন্নীত নয়। এর জন্যে অতিরিক্ত শ্রম দিতে হয়, কষ্ট করতে হয়, দায়িত্ব নিতে হয়।
বুদ্ধিজীবীদের ভ্রান্তি হলো – তারা যখন নিজেরা হিন্দু বা মুসলিম পরিচয় ছেড়ে দিয়ে মানুষ-স্তরে নেমে আসেন, মূলত তারা তখন দায়িত্বে অবহেলা করেন। এবং অন্যদেরকেও তাদের মত নিচু স্তরে নেমে আসতে বাধ্য করেন।
July 4, 2015 at 3:42 PM ·