নীরবতা : জ্ঞানী ও ধার্মিক মানুষের প্রধান পরিচয়

পৃথিবীর সবগুলো ধর্ম নীরবতার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। আল্লাহ তায়ালা মূসা আ.-কে তাঁর এক প্রজ্ঞাবান বান্দার নিকট পাঠিয়েছেন, কিভাবে নীরবতা অর্জন করতে হয় তা শিখতে। মূসা আ. যখন সে বান্দার নিকট গিয়ে বললেন, “আমি কি এ শর্তে আপনাকে অনুসরণ করতে পারি যে, সত্যপথের যে জ্ঞান আপনাকে শেখানো হয়েছে, তা থেকে আমাকে কিছু শিক্ষা দিবেন?” [সূরা কাহাফ – ৬৬] তখন জ্ঞানী ও ধার্মিক বান্দাটি মূসা আ.-কে বললেন, “আপনি আমার সাথে কিছুতেই ধৈর্যধারণ করে থাকতে পারবেন না” [সূরা কাহাফ – ৬৭] মূসা আ. বললেন, “আল্লাহ চাহেন তো আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন”। তখন সে প্রাজ্ঞ বান্দাটি মূসা আ. প্রথম নীরবতার শিক্ষা দিলেন। তিনি বললেন, “যদি আপনি আমার অনুসরণ করেনই তবে কোনও বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করবেন না, যে পর্যন্ত না আমি নিজেই সে সম্পর্কে আপনাকে কিছু বলি।” [সূরা কাহাফ – ৭০]

মূসা আ. তাঁর ইহুদী জাতিকে ভর্ৎসনা করেছিলেন একই কারণে; তারা অধিক প্রশ্ন করত এবং অধিক কথা বলত। এ প্রসঙ্গে কোর‘আনুল কারীমে বলা হয়েছে, “যখন মূসা আ. তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন, আল্লাহ তোমাদেরকে একটি গরু জবাই করতে আদেশ করেছেন। তারা বলল, তুমি কি আমাদের সাথে উপহাস করছ? মূসা আ. বললেন, মূর্খদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে আমি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি।” [সূরা বাকারা – ৬৭] 

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে নীরবতা শিক্ষা দিয়েছেন। আবূ হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল স. বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভাল কথা বলে; না হয় নীরব থাকে” –(বুখারি ও মুসলিম)। তিনি আরও বলেন, “যে ব্যক্তি নীরব থাকে, সে মুক্তি পায়” -(তিরমিযি)। অন্য রেওয়াতে বলেন, “নীরব থাকা হল হিকমাহ বা প্রজ্ঞা। কম লোকই এর উপর আমল করে।” আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. বর্ণনা করেন, রাসূল স. বলেন, “প্রকৃত মুসলমান সে-ই, যার জিহ্বা ও হাত থেকে সকল মুসলমান নিরাপদে থাকে” –(বুখারি)। সুলাইমান আ. তাঁর জাতিকে বলতেন, “কথা বলা যদি রুপা হয়, তবে চুপ থাকা যেন স্বর্ণ”। গৌতম বুদ্ধ-ও তাঁর শিষ্যদের সর্বপ্রথম নীরবতা পালনের শিক্ষা দিতেন।

কেবল আধ্যাত্মিকতা বা ধর্ম চর্চার জন্যে নীরবতা অর্জন করতে হয়, তা নয়; আইন, যুদ্ধ, বিতর্ক বা সঙ্গীত চর্চাসহ জাগতিক নানা ক্ষেত্রে সফলতা অর্জনের জন্যেও নীরবতাকে একটি আবশ্যকীয় উপাদান হিসাবে বিবেচনা করা হয়। পৃথিবীর অধিকাংশ বিতর্ক শুরু হয় নীরবতা ভঙ্গের কারণে, যদিও বিতর্কে জয়ী হবার প্রধান উপায় নীরবতা পালন করা। নীরবতা যে কখনো কখনো একটি বড় প্রশ্নের উত্তর, একটা শক্তিশালী প্রতিবাদ-প্রতিরোধ হতে পারে; তা অনেক মানুষই বোঝে না বলেই পৃথিবীতে এত অশান্তি, এত কষ্ট। 

ইমাম আবু হামিদ আল গাজালি বলেছেন, নীরবতার মাধ্যমে সাতটি সফলতা অর্জন করা যায় ১)পরিশ্রম ছাড়াই ইবাদত, ২) অলংকার ছাড়াই সৌন্দর্য, ৩) ক্ষমতা ছাড়াই প্রভাব বিস্তারকারী, ৪) প্রাচীর ছাড়াই দুর্গ, ৫) ওজর- আপত্তি প্রকাশ করা থেকে নিরাপত্তা, ৬) কিরামান কাতিবীন ফেরেশতাদের জন্য প্রশান্তির কারণ, ৭) নিজের দোষ- ত্রুটিসমূহের আচ্ছাদন।

নীরবতা মানে নির্জন-নিভৃত-একলা হয়ে যাওয়া নয়। সমাজের সাথে থেকেই নীরবতার চর্চা করতে হয়। যারা একা একা চলাফেরা করে, কিন্তু মনে মনে অন্যের সাথে তর্ক করে; তাদেরকে নীরব বলা যায় না। যারা কোলাহল-বিতর্কের মাঝে থেকেও নিজেকে নীরব রাখতে পারেন, তারাই প্রকৃত অর্থে নীরব মানুষ। তুমুল বিতর্কের মাঝেও যদি কখনও নীরব থাকার সুযোগ হয়, বুদ্ধিমানেরা তা কাজে লাগায়, অজ্ঞরা সে সুযোগ হারায়।

যখন শব্দ দিয়ে কোনও কিছু বোঝানো কষ্টকর হয়ে পড়ে, তখন আমরা দৃশ্যের সাহায্য নিই। যখন দৃশ্যের সাহায্যেও কোনও কিছু বোঝানো যায় না, তখন নীরব থাকতে হয়। নীরবতা সবচেয়ে শক্তিশালী একটি ভাষা, যা কেবল দীর্ঘ চর্চা ও সাধনার মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব। নীরবতা অনেক কথা-ই বলতে পারে, যা শব্দের মাধ্যমে বলা সম্ভব না। নীরবতার এক প্রচণ্ড শক্তি আছে। শব্দ দিয়ে যা বোঝানো সম্ভব না, নীরবতা তা অনায়াসে বুঝিয়ে দেয়।

মানুষ তার দক্ষতা-যোগ্যতা-ক্ষমতা অন্যের নিকট প্রকাশ করতে চায়। লেখক চায় অন্যরা তার লেখা পড়ুক, বক্তা চায় তার কথা শুনুক, অভিনেতা চায় তার অভিনয় দেখুক, কিন্তু জ্ঞানীরা চায় অন্যরা তার নীরবতা উপলব্ধি করুক। নীরবতা জ্ঞানের দরজা। জ্ঞানের দরজা খুলে গেলে ঠোটের দরজা বন্ধ হয়ে যায়, আর ঠোটের দরজা খুলে গেলে জ্ঞানের দরজা বন্ধ হয়ে যায়।

একটা মানুষ তার জন্মের পাঁচ বছরের মধ্যে পূর্ণরূপে কথা বলতে পারে, অথচ নীরবতা শিখতে তার সারা জীবন লেগে যায়। কেউ কেউ কখনোই পারে না নীরবতা শিখতে। কারণ মানুষ কথা বলা শিখে অন্য মানুষের কাছ থেকে, কিন্তু নীরবতা শিখতে হয় আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে। নীরবতা পৃথিবীর কঠিন কাজগুলোর একটি; অনবরত চেষ্টা-সাধনা না করলে এবং আল্লাহ তায়ালার সাহায্য কামনা না করলে, কেউ এ গুণ অর্জন করতে পারে না। কথা বলার শক্তি-সুযোগ থাকলেই কথা বলতে হবে, এমন ধারণা পোষণ করে কেবল অজ্ঞরা। পৃথিবীর সর্বশক্তিমান, মহাজ্ঞানী, পরাক্রমশালী আল্লাহ তায়ালা সবসময় নীরব-ই থাকেন। মানুষের মাঝে যিনি যত নীরবতা পালন করেন, তিনি ততই জ্ঞান, ক্ষমতা ও ধার্মিকতা অর্জন করতে পারেন। 

May 28, 2015 at 10:55 PM ·

আরো পোস্ট