গণতন্ত্র, জামায়াতে ইসলামি ও কারযাভি
গণতন্ত্র বিষয়ে ইউসুফ আল কারযাভি, মাওলানা মওদূদী ও অধ্যাপক গোলাম আজমের চিন্তার পার্থক্য।
গণতন্ত্র সম্পর্কে মাওলানা মওদূদী বলেন –
“”আমি মুসলমান ভাই-ভগ্নিদেরকে পরিষ্কাররূপে বলে দিতে চাই যে, বর্তমান যুগের ধর্মহীন গণতন্ত্র সম্পূর্ণরূপে আপনাদের দ্বীন ও ইমানের পরিপন্থী জিনিস। উনার সম্মুখে আপনাদের মাথা অবনত করে দেয়ার অর্থ কুরআন হতে মুখ ফিরিয়ে থাকা। আপনারা যদি উহার প্রতিষ্ঠা ও স্থায়িত্বের কাজে অংশগ্রহণ করেন, তবে উহা হবে আপনাদের রাসূল সা এর সাথে বিশ্বাসঘাতকতার নামান্তর। আর যদি আপনারা উহার পতাকা উড্ডীন করতে দণ্ডায়মান হয়, তবে উহা হবে আপনার আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহীর পতাকা উত্তোলনের শামিল।” (মাওলানা মওদুদী, ইসলাম ও ধর্মহীন গণতন্ত্র, পৃ: ২৬)
মাওলানা মওদূদী যতটা কঠোরভাবে গণতন্ত্রকে ইসলামের বিপরীতে দাঁড় করিয়েছেন, অধ্যাপক গোলাম আজম ততটা কঠোর হয়নি গণতন্ত্রের বিষয়ে।
মাওলানা মওদূদীর বইয়ের নাম ‘ইসলাম ও ধর্মহীন গণতন্ত্র’, আর অধ্যাপক গোলাম আজমের এ বিষয়ের বইয়ের নাম ‘ইসলাম ও গণতন্ত্র’। গোলাম আজম ‘গণতন্ত্র’ শব্দটির সাথে ‘ধর্মহীন’ শব্দটা বাদ দিয়ে বইয়ের নাম রাখায় সহজেই অনুমেয় যে, মাওলানা মওদূদীর সাথে গোলাম আজমের এ ক্ষেত্রে চিন্তার পার্থক্য রয়েছে।
গোলাম আজমের মতে, ইসলামের সাথে গণতন্ত্রের তেমন কোনো বিরোধ নেই। তবে একটা পার্থক্য রয়েছে। তাঁর ভাষায় –
“প্রচলিত গণতন্ত্র পাশ্চাত্য থেকেই আমদানি হয়েছে। ঐ গণতন্ত্রে জনগণের সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত। সার্বভৌমত্ব মানে আইন রচনার সর্বোচ্চ শক্তি। আইনের সর্বজনীন সংজ্ঞা হলো “Law is the will of the sovereign” (সার্বভৌম সত্তার ইচ্ছাই আইন)। আধুনিক গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় জনগণই সার্বভৌম সত্তা।”(গোলাম আজম, ইসলাম ও গণতন্ত্র, পৃ ৫)
“প্রকৃতপক্ষে ইসলাম ও পাশ্চাত্যের গণতন্ত্রে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ইসলামে সার্বভৌমত্ব আল্লাহর, আর পাশ্চাত্য গণতন্ত্রে জনগণই সার্বভৌমত্বের অধিকার।” (গোলাম আজম, ইসলাম ও গণতন্ত্র, পৃ ৬)
“ইসলামকে বিজয়ী আদর্শ হিসাবে কায়েম করার উদ্দেশ্যে যারা ইকামাতে দ্বীনের আন্দোলনে সক্রিয় তাদের মধ্যে কেউ কেউ গণতন্ত্রকে কুফরি মতবাদ বলে প্রচার করেন। এ কথা অবশ্যই সত্য যে জনগণের সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে যে গণতন্ত্র চালু আছে তা নিঃসন্দেহে কুফরি।” (গোলাম আজম, ইসলাম ও গণতন্ত্র, পৃ ১০)
গোলাম আজমের মতে, যে গণতন্ত্রে বলা হয়, জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, সে গণতন্ত্র কুফরি। এ ছাড়া গণতন্ত্রের সাথে ইসলামের কোনো পার্থক্য নেই।
এবার আসি ইউসুফ আল কারযাভি চিন্তায়। ইউসুফ আল কারযাভির মতে, ইসলামি রাষ্ট্র মানেই আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। যে ধরণের গণতন্ত্র গোলাম আজমের মতে কুফরি, সে ধরণের গণতন্ত্র ইউসুফ আল কারযাভির মতে কুফরি নয়। কারণ, ইউসুফ আল কারযাভি বলেন, “জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী মানে, জনগণ আইন প্রণেতা নির্বাচন করতে পারবে, জনগণ আইন প্রণেতাদেরকে নির্বাচনের মাধ্যমে পরিবর্তন করতে পারবে, আইন প্রণেতার ভুল আইনের বিপরীতে জনগণ প্রতিবাদ করতে পারবে। এই অর্থেই জনগণ সার্বভৌমত্ব ক্ষমতার অধিকারী।” জনগণ আল্লাহর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। ফলে, যে গণতন্ত্রে বলে, জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, সে গণতন্ত্র কুফরি নয়।
কারযাভির মতে, পাশ্চাত্য আধুনিক গণতন্ত্রের সাথে ইসলামি রাষ্ট্রের তেমন কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য কেবল এটাই যে, আমেরিকা ও ইউরোপ আইন প্রণয়নের সময়ে তাদের নিজেদের ধর্ম ও ঐতিহ্যকে রেফারেন্স হিসাবে গ্রহণ করে, চীন ও রাশিয়া তাদের ধর্ম ও ঐতিহ্যকে গ্রহণ করে, আর ইসলামি রাষ্ট্রে ইসলামকে রেফারেন্স হিসাবে গ্রহণ করা হয়। তিনি বলেন, “ইসলামি রাষ্ট্র মানেই আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র”। পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের যে অংশকে গোলাম আজম কুফরি বলেন, সে অংশকে ইউসুফ আল কারযাভি কুফরি বলেন না।
কারযাভির মতে, পশ্চিমারা তাদের ধর্ম ও ঐতিহ্যকে রেফারেন্স হিসাবে গ্রহণ করার পরেও একই বিষয়ে বিভিন্ন জন যেমন বিভিন্ন মতামত প্রদান করার সুযোগ থাকে, তেমনি ইসলামি রাষ্ট্রে ইসলামকে রেফারেন্স হিসাবে গ্রহণ করার পরেও একই বিষয়ে বিভিন্নজন বিভিন্ন মত দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। কারণ, ইসলামের অনেকগুলো মেথডলজি বা মাজহাব রয়েছে। ইসলামে রেফারেন্স হিসাবে কুরআন ও হাদিসে যা রয়েছে তা সুস্পষ্ট, কেউ এর ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। আর যে আইন কুরআন ও হাদিসের আলোকে প্রণয়ন করা হয়, তা নিয়ে জনগণ ভিন্ন মত দিতে পারে। খারিজিরা যেমন বলতো, إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ বা আইনদাতা কেবল আল্লাহ। এর বিপরীতে আলী রা বলতেন, তাদের এ কথা ঠিক হলেও কথাটার উদ্দেশ্য ঠিক নেই।
যারা জনগণ ও আল্লাহকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে, জনগণের সার্বভৌমত্ব বলা গণতন্ত্রকে কুফরি বলেন, তাদের সাথে এ বিষয়ে ইউসুফ আল কারযাভির চিন্তার মিল নেই।
এ ভিডিও এর ১৩ মিনিট থেকে
https://youtu.be/jGHYZv09q4o