| |

হার্ট ও মস্তিষ্কের সম্পর্ক

হার্ট ও মস্তিষ্কের সম্পর্ক নিয়ে গতকাল ফেইসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেয়ার পর একজন ভাইয়া আমাকে ১টি প্রশ্ন ও ২টি মন্তব্য করেছেন। ভাইয়ার প্রশ্ন ও মন্তব্যগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রশ্নটি হলো –

“আচ্ছা, হার্টকে আপনি যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন এবং কোরআনের আয়াত দিয়ে যেভাবে উপসংহার টেনেছেন, এর মানে হলো প্রত্যেক ব্যক্তির হার্ট স্বতন্ত্র ও স্বাধীন চিন্তা-চেতনা ও মানসিকতার অধিকারী।
এখন তো হার্টের সমস্যা হলে হার্ট প্রতিস্থাপন করা যায়। মনে করুন, একজন নাস্তিক ব্যক্তির হার্ট প্রতিস্থাপন করা হলো একজন আস্তিক রোগীর দেহে। তাহলে কি সেই আস্তিক ব্যক্তি হার্ট প্রতিস্থাপনের পর নাস্তিক হয়ে যাবেন?”

প্রথমে দেখুন, ভাইয়ার প্রশ্নটি থেকে দুটি শব্দ তুলে নিলাম। ১ – “ব্যক্তি”, ২ – “ব্যক্তির হার্ট”।

এখানে স্পষ্ট যে ব্যক্তি ও ব্যক্তির হার্টের মাঝে পার্থক্য আছে। একজন মানুষ জীবনে যা কিছু করে, তার সমষ্টি হলো ঐ ব্যক্তি। অর্থাৎ, ব্যক্তিত্বের সমষ্টি হলো একজন ব্যক্তি। অন্যদিকে, হার্ট মানুষকে কাজ করার জন্যে বা ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলার জন্যে চিন্তা ও শক্তি যোগায়।

“ব্যক্তি” ও “হার্ট”-এর মাঝে পার্থক্য এখন বোঝা গেল কি? আসলে, না বোঝাতে পারলে সেটা আমার যোগ্যতার অভাব।

তবে, কোর’আন থেকে উদাহরণ দিলে বিষয়টা খুবই সহজ মনে হবে, ইনশাল্লাহ। আল্লাহ তায়ালা বলছেন –

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَجِيبُوا لِلَّهِ وَلِلرَّسُولِ إِذَا دَعَاكُمْ لِمَا يُحْيِيكُمْ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ يَحُولُ بَيْنَ الْمَرْءِ وَقَلْبِهِ وَأَنَّهُ إِلَيْهِ تُحْشَرُونَ

“হে ঈমানদারগণ, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের ডাকে সাড়া দাও। রাসূল তোমাদেরকে এমন কাজের প্রতি আহবান করে, যা তোমাদেরকে প্রাণবন্ত করে। জেনে রেখো, ব্যক্তি এবং তার হৃদয়ের মধ্যবর্তী স্থানে আল্লাহ থাকেন। বস্তুত: তোমাদের সবাইকে তাঁর নিকট একত্র করা হবে।” [সূরা ৮/আনফাল – ২৪]

দেখুন, এ আয়াতে স্পষ্ট যে, ব্যক্তি ও ব্যক্তির হার্টের মাঝে একটি বড় পার্থক্য আছে।

তো চলুন এবার, ভাইয়ার প্রশ্নতে নজর দেয়া যাক। প্রশ্নের ভূমিকায় ভাইয়া বলেছেন –

““আচ্ছা, হার্টকে আপনি যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন এবং কোরআনের আয়াত দিয়ে যেভাবে উপসংহার টেনেছেন, এর মানে হলো প্রত্যেক ব্যক্তির হার্ট স্বতন্ত্র ও স্বাধীন চিন্তা-চেতনা ও মানসিকতার অধিকারী।”

বাক্যটির অধিকাংশ ঠিক। কিন্তু সর্বশেষ “অধিকারী” শব্দটি পরিবর্তন করে “পরিবর্তনকারী” শব্দটি বসালে বাক্যটি আরো বেশি সত্য হত।

কারণ,

আরবি ভাষায় ও আল কোর’আনে “হৃদয়” শব্দটিকে বুঝাতে “কালব” [قلب] বিশেষ্যটি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু “কালব” [قلب] শব্দটি যখন ক্রিয়া হিসাবে ব্যবহৃত হয়, তখন তার অর্থ হয় – “পরিবর্তন করা”।

হার্ট মানুষের চিন্তা-চেতনা-মানসিকতার যতটা না অধিকারী, তারচেয়ে অনেক অনেক বেশি মানুষের চিন্তা-চেতনা-মানসিকতার পরিবর্তনকারী এবং নতুন চিন্তার উদ্ভাবনকারী।

এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর কোনো কিছুই অযথা সৃষ্টি করেন নাই। মানুষের শরীরের প্রতিটি অঙ্গই সমান গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি একটি পশমেরও গুরুত্ব রয়েছে। হার্ট ও মস্তিষ্কের সম্পর্ক নিয়ে হৃদয়ের_কথা_১ লেখাটিতে মূলত আমি বলতে চেয়েছি যে, হার্ট ও মস্তিষ্ক কে কিভাবে কাজ করে।

সুতরাং, আমার লেখা থেকে ভাইয়া যে উপসংহার টেনেছেন, আমি ঠিক তা বুঝাতে চাইনি। আমি তাঁর বাক্যটি নিজে লিখলে হয়তো এভাবে লিখতাম – “একটি (স্বতন্ত্র নয়) সুস্থ হৃদয় ব্যক্তির চিন্তার পরিবর্তন ঘটায়।”

এবার, মূল প্রশ্নে আসি। ভাইয়া প্রশ্ন করেছেন –

“এখন তো হার্টের সমস্যা হলে হার্ট প্রতিস্থাপন করা যায়। মনে করুন, একজন নাস্তিক ব্যক্তির হার্ট প্রতিস্থাপন করা হলো একজন আস্তিক রোগীর দেহে। তাহলে কি সেই আস্তিক ব্যক্তি হার্ট প্রতিস্থাপনের পর নাস্তিক হয়ে যাবেন?”

শুরুতেই আমরা কোর’আন থেকে দেখেছি যে, একজন ব্যক্তি ও তার হৃদয়ের মাঝে পার্থক্য আছে। “ব্যক্তি” মানে “হৃদয়” না, আবার “হৃদয়” মানে “ব্যক্তি” না। সুতরাং, “হৃদয়” প্রতিস্থাপনের ফলে একজন “ব্যক্তি” সম্পূর্ণ প্রতিস্থাপিত হয়ে যান না। একজন “আস্তিক ব্যক্তি” হঠাৎ পরিবর্তিত হয়ে একজন “নাস্তিক ব্যক্তি” হয়ে যান না।

তাহলে, হার্টের কাজ কি?

হার্ট নতুন চিন্তার উদ্ভাবন করে, এবং ব্রেইন মেমরির পরিবর্তন ঘটায়। একজন মানুষ সারা জীবনে তার সমস্ত শরীর দিয়ে যতগুলো অভিজ্ঞতা অর্জন করে, ব্রেইন সবগুলো অভিজ্ঞতাকে জমা রাখে। সাধারণত ব্রেইন তার মেমরিতে থাকা অভ্যাসগুলো পুনরাবৃত্তি করে। তাই, হার্ট মানুষের ব্রেইনের মাঝে নতুন চিন্তা যুক্ত করে।

এবার, ১ম মন্তব্যটি দেখা যাক। মন্তব্যের শুরুতে ভাইয়া বলেছেন –

“বৈজ্ঞানিক তথ্য-প্রমাণের সাথে কোরআনের আয়াতের মিল দেখানো বা বেমিল খুঁজে বের করাকেও আমি সঠিক মনে করি না। কারণ, দুইটা সম্পূর্ণ দুই ডোমেইনের জিনিস। তাই কোরআন ও বৈজ্ঞানিক তথ্যের মধ্যে সাযুজ্য থাকাটা আবশ্যিক নয়।”

এই মন্তব্যটির সাথে আমি পূর্ণ একমত। বিজ্ঞান দিয়ে কোর’আনের কোনো আয়াত প্রমাণ করতে পারলে, আমরা কোর’আনের সেই আয়াতটি বিশ্বাস করব; আর বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণ করতে না পারলে, আমরা বিশ্বাস করব না; – বিষয়টা এমন না।

এ ক্ষেত্রে, আমি আসলে ইব্রাহীম (আ)-এর একটি সুন্নাত অনুসরণ করতে চাই। আল্লাহ তায়ালা কোর’আনে ইব্রাহীম (আ)-এর সুন্নতটি উল্লেখ করে বলেন –

وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّ أَرِنِي كَيْفَ تُحْيِي الْمَوْتَىٰ قَالَ أَوَلَمْ تُؤْمِن قَالَ بَلَىٰ وَلَٰكِن لِّيَطْمَئِنَّ قَلْبِي قَالَ فَخُذْ أَرْبَعَةً مِّنَ الطَّيْرِ فَصُرْهُنَّ إِلَيْكَ ثُمَّ اجْعَلْ عَلَىٰ كُلِّ جَبَلٍ مِّنْهُنَّ جُزْءًا ثُمَّ ادْعُهُنَّ يَأْتِينَكَ سَعْيًا وَاعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ

আর স্মরণ কর, যখন ইব্রাহীম বলল, হে আমার পালনকর্তা! কিভাবে তুমি মৃতকে জীবিত কর? – আমাকে দেখাও। আল্লাহ বললেন, তুমি কি বিশ্বাস কর না? ইব্রাহীম বলল, অবশ্যই বিশ্বাস করি, কিন্তু আমার হৃদয়কে প্রশান্ত করার জন্যে দেখতে চাই। আল্লাহ বললেন, তাহলে চারটি পাখী ধরে নাও, এবং সেগুলোকে নিজের পোষ মানিয়ে নাও। অতঃপর সেগুলোর দেহের এক এক অংশ এক এক পাহাড়ের উপর রেখে দাও। তারপর সেগুলোকে ডাক; তোমার নিকট দৌড়ে চলে আসবে। আর জেনে রাখো, নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী, অতি জ্ঞান সম্পন্ন।” [সূরা ২/বাকারা – ২৬০]

#হৃদয়ের_কথা_১ লেখাটিতে আমি আসলে আমার হৃদয়কে প্রশান্ত করার জন্যে বিজ্ঞান থেকে কিছু উদাহরণ দিয়েছি।

তারপর, ২য় মন্তব্যে ভাইয়া বলেছেন –

“মন বা মাইন্ড বলতে বস্তুবাদীরা ব্রেইন বা ব্রেইনের কিছু কাজের ফলাফলকে বুঝিয়ে থাকে সাধারণত। এর কাউন্টার হিসেবে কেউ যদি মাইন্ড বলতে হার্ট তথা হৃদপৃন্ডকে বুঝায়, তাহলে সেটাও সমস্যাজনক। কারণ, হার্টও একটি বস্তুই। মাইন্ড বা মন হলো এমন এক অবস্তুগত ব্যাপার, যা ব্রেইনও নয়, হার্টও নয়। এটি তৃতীয় আরেকটি ব্যাপার। যেহেতু এটি অবস্তু, তাই ব্রেইন বা হার্টের যে কোনো একটির সাথেও যদি মাইন্ডকে মিলিয়ে ফেলা হয়, তাহলে তাৎপর্যগত দিক থেকে এর কোনো হেরফের হয় না। এইটা হলো বস্তুবাদী বনাম অবস্তুবাদী বা ইসলামের দিক থেকে মাইন্ড নিয়ে কথা।”

ভাইয়ার দ্বিতীয় মন্তব্যটি ব্যাখ্যা করার জন্যে আমাকে আরো কয়েক হাজার শব্দ লিখতে হবে। এমনিতেই এ স্ট্যাটাসে ১ হাজার শব্দ হয়ে গেছে। সময় পেলে অন্য কোনো দিন লিখব, ইনশাল্লাহ। এখন কেবল একটি পয়েন্ট উল্লেখ করে রাখি।

বাংলা ভাষায় ‘অন্তর’ ও ‘হৃদয়’ শব্দ দুটি দিয়ে একই অর্থ বুঝালেও, কোর’আনে শব্দ দুটির অর্থ ও ব্যবহার ভিন্ন ভিন্ন।

হার্ট বা হৃদয়কে বুঝানো জন্য কোর’আনে “কালব” [قلب] শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু মাইন্ড বা অন্তর বা মন শব্দটি বুঝাতে “ফুয়াদ” [فُؤَادُ] শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।

এখন, যে কারো মনে হতে পারে, ‘হৃদয়’ ও ‘অন্তর’ একই। কিন্তু কোর’আনে দুটি শব্দকে পাশাপাশি ব্যবহার করে, ‘হৃদয়’ ও ‘অন্তর’-এর পার্থক্য দেখানো হয়েছে। আল্লাহ বলেন –

وَأَصْبَحَ فُؤَادُ أُمِّ مُوسَىٰ فَارِغًا إِن كَادَتْ لَتُبْدِي بِهِ لَوْلَا أَن رَّبَطْنَا عَلَىٰ قَلْبِهَا لِتَكُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ

“মূসা জননীর অন্তর অস্থির হয়ে পড়ল। আমি যদি তাঁর হৃদয়কে দৃঢ় করে না দিতাম, তবে তিনি মূসার পরিচয় তো প্রকাশ করেই দিতেন। (আমি তাঁর হৃদয় দৃঢ় করলাম) যাতে তিনি একজন আস্থাশীল বা বিশ্বাসী হতে পারেন। [সূরা ২৮/কাসাস – ১০]

ফিরাউন যখন শিশু মূসাকে পানি থেকে তুলে নিলেন, তখন মুসা (আ)-এর মায়ের অবস্থা বর্ণনা করার জন্যে এই আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু এখানে মূসার মায়ের ‘অন্তর’ ও ‘হৃদয়ের’ পার্থক্যটাও খুঁজে পাবেন।

এটাই হলো কোর’আনের বিশেষত্ব বা মুজিযা। এর প্রতিটি শব্দ ও অক্ষর-ই গুরুত্বপূর্ণ। কোর’আনের যে কোনো একটি শব্দের স্থানে অন্য একটি সমর্থক শব্দ বসালে সম্পূর্ণ আয়াতের অর্থ ও প্রসঙ্গ-ই পরিবর্তন হয়ে যায়।

আরো পোস্ট

One Comment

  1. ভাইয়া তার মানে ব্রেন চিন্তা করে এবং বাস্তবায়ন করে এবং হার্ট চিন্তার পরিবর্তন করে।।কিন্তু আমার প্রশ্নটা হচ্ছে তাহলে এই ‘আমি’ টা কে?এই আমি কি ব্রেন এবং হার্ট মিলিয়ে কিছু একটা??আমি তো রুহ এবং নফস মিলিয়েই আমি।নফস এবংরুহের সাথে হার্ট ব্রেনের কোন আলোকপাত করা যায় কি

একটি মন্তব্য লিখুন

আপনার ইমেইল অ্যাড্রেস প্রকাশ করা হবে না। তারকা (*) চিহ্নিত ঘরগুলো পূরণ করা আবশ্যক