We want justice – আগামীদিনের রাজনৈতিক শ্লোগান
শিশু-কিশোরদের “We want justice” কথাটাই ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রাজনীতির ভিত্তি হবে। কারণ, বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বড় অভাব হচ্ছে জাস্টিস বা ন্যায়নীতির। যারা বাংলাদেশের জনগণকে ন্যায়নীতি দিতে পারবে, জনগণ তাদেরকেই সমর্থন করবে।
কথাটা একটু ব্যাখ্যা করে বলি।
জাস্টিস বা ন্যায়নীতি শব্দটির বিপরীত শব্দ হলো দুর্নীতি। কোনো দেশে যখন ন্যায়নীতি হারিয়ে যায়, তখন দুর্নীতি বেড়ে যায়। উল্টো করে বললে, কোনো দেশে যখন দুর্নীতি বেড়ে যায়, তখন ন্যায়নীতি হারিয়ে যায়। বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বেশি সয়লাব হচ্ছে দুর্নীতির, এবং সবচেয়ে বেশি অভাব হচ্ছে ন্যায়নীতির।
অনেক মনে করেন, বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা হলো দারিদ্রটা, কিন্তু কথাটা ঠিক নয়। দুর্নীতি-ই হলো বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা। কারণ, দুর্নীতি-ই হলো যাবতীয় উন্নয়নের অন্তরায়। জনগণের ভ্যাট ও ট্যাক্সের টাকা যখন মন্ত্রী-এমপি ও সরকারী কর্মচারীরা চুরি করে খেয়ে ফেলে, তখন জনগণ দরিদ্র হয়ে যায়।
শিশু-কিশোরদের “We want justice” বা “আমরা ন্যায়নীতি চাই” কথাটার মানে হলো, আমরা দুর্নীতি থেকে মুক্তি পেতে চাই। “আমরা ন্যায়নীতি চাই” এবং “আমরা দুর্নীতি থেকে মুক্তি পেতে চাই” কথা দুটির অর্থ একই। এখানে পার্থক্য হলো, প্রথম কথাটি ইতিবাচক, এবং শেষের কথাটি হলো নেতিবাচক। বাংলাদেশের শিশু-কিশোররা নেতিবাচক বাক্যটি ব্যবহার না করে, ইতিবাচক কথাটি বলে আন্দোলন করছে, যা ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
একটি রাষ্ট্রের মূলভিত্তি হচ্ছে ন্যায়নীতি। ন্যায়নীতির অভাবে যে কোনো রাষ্ট্র ভেঙ্গে পড়ে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি যখন ভেঙ্গে পড়ে যাচ্ছিলো, তখনি বাংলাদেশের শিশু-কিশোররা চিৎকার করে বলে উঠলো – We want justice. এ কারণে, ভবিষ্যতে যারা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতি করবে, তাঁদেরকে প্রমাণ করতে হবে যে, তাঁরা দুর্নীতি মুক্ত সৎ মানুষ। এবং তাদের শ্লোগান হতে হবে – We want justice.
দুই
শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সারা দেশের মানুষ বলছে, “We want justice”; “আমরা ন্যায়নীতি ও ন্যায়বিচার চাই”। কিন্তু, সরকার বলছে, আমরা তো ন্যায়নীতির মাঝেই আছি, এবং ন্যায়বিচারও করছি।
এখানে স্পষ্ট যে, জনগণ যেটাকে ন্যায় মনে করে, সরকার সেটাকে ন্যায় মনে করে না। আবার, সরকার যেটাকে ন্যায় মনে করে, জনগণ সেটাকে ন্যায় মনে করে না। অর্থাৎ, জনগণ ও সরকার দুই পক্ষের কাছে ন্যায়ের ধারণা দুই রকম।
পৃথিবীতে যারা অন্যায় ও জুলুম করে, তারা কখনোই বলে না যে, “আমরা জুলুম করছি”। তারা জুলুমকে ন্যায় মনে করে।
ফিরাউন কখনোই ভাবতো না যে, সে মানুষের উপর জুলুম করছে। ফিরাউন ভাবতো, সে ন্যায়ের চর্চা করছে। বনী ইসরাইলের উপর ফিরাউন যে অত্যাচার ও নির্যাতন করতো, সেটাকে সে ন্যায় মনে করতো। ফিরাউনের যুক্তি হলো, বনী ইসরাইলের লোকজনকে যেহেতু আমি খাওয়াচ্ছি, সুতরাং তারা আমার দাসত্ব করবে – এটাই স্বাভাবিক এবং এটাই ন্যায়। অর্থাৎ, ফিরাউন যা বলবে, তা করাই হলো ন্যায়; আর ফিরাউনের কথার বিপরীত হলো অন্যায়।
ফিরাউন সহ পৃথিবীর ইতিহাসে সকল স্বৈরাচার চারটি ভিত্তির উপর ভর করে ন্যায়ের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে।
১) যার শক্তি বেশি, তার অধিকার বেশি।
২) যার সম্পদ বেশি, তার অধিকার বেশি।
৩) যার সম্মান বেশি, তার অধিকার বেশি।
৪) যারা সংখ্যায় বেশি, তাদের অধিকার বেশি।
অর্থাৎ, ফিরাউনদের নিকট শক্তি, সম্পদ, সম্মান ও সংখ্যার বিবেচনায় অধিকার ও ন্যায়-অন্যায় নির্ধারিত হয়।
কিন্তু ইসলামে উপরোক্ত চারটি ভিত্তির উপর মানুষের অধিকার কিংবা নায়-অন্যায় নির্ধারিত হয় না। ইসলামে ন্যায়-অন্যায় ও অধিকার নির্ধারিত হয় ভিন্ন চারটি ভিত্তির উপর।
১) মানবিকতা – প্রত্যেক মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও বংশ রক্ষার অধিকার রয়েছে। একইসাথে, প্রত্যেক মানুষের বিশ্বাসের স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে।
২) যে যতটুকু পরিশ্রম করবে, সে ততটুকু পাবার অধিকার রয়েছে।
৩) চুক্তি বা ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে একে অপরের নিকট অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
৪) যে যতটুকু অপরাধ করেছে, সে ততটুকু শাস্তি পেতে হবে। কেউ তার শক্তি, সম্পদ ও সম্মানের কারণে শাস্তি থেকে মুক্তি পাবে না।
উপরোক্ত চারটি ভিত্তির উপর ভর করেই কেবল ইসলামে অধিকার ও ন্যায়-অন্যায় নির্ধারিত হয়। তাই, জালিমের ন্যায়ের ভিত্তি এবং ইসলামের ন্যায়ের ভিত্তি এক নয়।
এ কারণেই, পৃথিবীর কোনো স্বৈরাচারী শাসক-ই তাদের জুলুমকে অন্যায় মনে করে না, বরং তারা তাদের জুলুমকে বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে ন্যায় সাব্যস্ত করে।
তিন
২০১৮ সালের কিশোর বিদ্রোহের মূল শ্লোগান হলো – We want justice; অর্থাৎ আমরা ন্যায়পরতা, ন্যায়নীতি, সততা, সমতা, নিরপেক্ষতা ও ন্যায়বিচার চাই। কেবল একটি বাংলা শব্দ দিয়ে জাস্টিস (justice) শব্দটির অর্থ বোঝা যায় না, তাই অনেকগুলো বাংলা শব্দের সমন্বয়ে জাস্টিস শব্দের অর্থ করতে হলো।
কোর’আনে অন্তত ২৫টি আয়াতে ন্যায়বিচার বা জাস্টিস প্রতিষ্ঠা করার জন্যে আদেশ দেয়া হয়েছে। প্রতি শুক্রবার ইমাম সাহেব তাঁর খুতবা ও বক্তব্য শেষে যে আয়াতটি পাঠ করেন, সেখানেও ন্যায়বিচার, ন্যায়পরায়ণতা, জাস্টিস ও আদালত প্রতিষ্ঠার জন্যে আদেশ দেয়া হয়েছে।
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَىٰ وَيَنْهَىٰ عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنكَرِ وَالْبَغْيِ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ
“আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ এবং আত্মীয়-স্বজনকে দান করার জন্যে আদেশ দিচ্ছেন। এবং তিনি অশ্লীলতা, অসৎকর্ম এবং সীমালঙ্ঘন করতে নিষেধ করছেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পার”। [সূরা ১৬/নাহল – ৯০]
জাস্টিস কি, এবং জাস্টিস কিভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হয়, সে সম্পর্কে কোর’আনে অসংখ্য দিক-নির্দেশনা রয়েছে। বলতে গেলে সম্পূর্ণ কোর’আনেই ন্যায় ও অন্যায় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কোর’আনে বলা হয়েছে, তোমরা ন্যায় কথা বলবে, এমনকি তা তোমাদের আত্মীয়-স্বজনদের বিরুদ্ধে গেলেও। [সূত্র: সূরা ৬/আন’আম – ১৫২]
অর্থাৎ, কোর’আনের মৌলিক একটি বিষয় হলো জাস্টিস বা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। যখন কোথাও জাস্টিস বা ন্যায়বিচার হারিয়ে যায়, তখন সেখানে জাস্টিস প্রতিষ্ঠার জন্যে চেষ্টা করা, আন্দোলন করা বা জিহাদ করাটা ইসলামের একটি মৌলিক কাজ হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের শিশু-কিশোর-ছাত্ররা “We want justice” বলে যে আন্দোলন শুরু করেছে, সেটি ইসলামের মৌলিক একটি আন্দোলন।
কোর’আনে সরকার গঠন বা সরকার পরিবর্তনের জন্যে সরাসরি কোনো আদেশ দেয়া হয়নি, কিন্তু ন্যায় বিচার, আদালত (عدالة), বা জাস্টিস (justice) প্রতিষ্ঠার কথা সরাসরি বলা হয়েছে ২৫ বারেরও বেশি।
চার
তরুণদের আন্দোলন সফল হয়েছে। তাই এ আন্দোলন থেকে ইসলামী দলগুলোর অনেক কিছুই শেখার আছে।
১) বাংলাদেশের জন্যে শেখ মুজিব খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ডিসকোর্স বা বয়ান। তাই শেখ মুজিবকে বর্তমান আওয়ামীলীগের বাইরে চিন্তা করতে হবে। শেখ মুজিবকে মুসলিম লীগের একজন একনিষ্ঠ কর্মী হিসাবে গ্রহণ করে ইসলামী রাজনীতিতে তার স্থান করে দেয়া প্রয়োজন।
এ কাজটা তুরস্কেও হয়েছে। তুরস্কের বর্তমান ক্ষমতাশীল ইসলামপন্থী দল একে পার্টি তাদের জাতীর পিতা মোস্তফা কামালকে নতুনভাবে এবং নতুন বয়ানে হাজির করেছিলেন। এখনো এরদোয়ান তার অনেক বক্তব্যে মোস্তফা কামাল থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে নিজের মতকে প্রতিষ্ঠিত করেন। সুতরাং, কোটা সংস্কার আন্দোলনের মতোই শেখ মুজিবকে সাথে নিয়েই ইসলামপন্থীদের রাজনীতির পথ খোঁজা প্রয়োজন।
২) রাসুল (স)-এর দাওয়াতি কাজে, মসজিদে ও জিহাদে নারীদের যেমন অংশগ্রহণ ছিলো, তেমনি ইসলামী রাজনীতিতেও পুরুষদের সাথেই নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কোটা সংস্কার আন্দোলন সফল হবার পিছনে নারীরা অনেক বেশি ভূমিকা পালন করেছিলেন।
৩) দেশপ্রেমের ভিত্তিতে কিভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বৈষম্যকে প্রতিহত করা যায়, এটি এই আন্দোলন থেকে শেখার আছে। ইসলামী রাজনীতি করতে হলে, নামে ‘ইসলামী’ না হয়ে, কাজে ‘ইসলামী’ হওয়া প্রয়োজন। কোথায় কোথায় বৈষম্য ও জুলুম রয়েছে, এবং কিভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, মানুষকে তা স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয়া প্রয়োজন। অর্থাৎ, সকল বৈষম্যের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক স্পষ্ট বয়ান তৈরি করতে হবে, যাতে সবাই বুঝতে পারে যে এটা বৈষম্য।